প্যালেস্টাইন সমস্যার প্রেক্ষাপট লেখো । এক্ষেত্রে ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রভাব আলোচনা করো।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি উত্তপ্ত হতে থাকে । এখানকার সবচেয়ে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র প্যালেস্টাইনকে কেন্দ্র করে এসময় থেকে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল, তা থেকেই উদ্ভব হয়েছিল পালেস্টাইন সমস্যার । এই সমস্যার কেন্দ্র ছিল জিওনবাদী আন্দোলন ও আরব-জাতীয়তাবাদের মধ্যে । পরস্পর বিরোধী জাতীয়তাবাদের উদ্ভব মধ্যপ্রাচ্যের সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র ক্ককষ্ট্র প্যালেস্টাইনে বিশ শতকের প্রথমার্ধে আরব ইহুদীদের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয়,পরিচিত ছিল আরব-জাতীয়তাবান ও ইহুদী-জিওনহাদ নামে । এই দুই জাতীয়তাবাদী মনোভাব ছিল পরস্পরবিরোধী। ফলে প্যালেস্টাইন সমস্যা আরও গভীর হয়ে ওঠে ৷
মধ্যপ্রাচ্য ও সুয়েজ খাল অঞ্চলে নিজ সাম্রাজাবাদী ও বাণিজ্যিক স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে ব্রিটেন প্যালেস্টাইনের কর্তৃত্ব নিজ অধিকারে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল। এজন্য ব্রিটেন দ্বি-চারিতার পথ গ্রহন করে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যালফু ঘোষণা করেন প্যালেস্টাইনে ইহুদীদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র গড়ে তোলা হবে। আবার ব্রিটিশ সেনাপতি ম্যাকমোহন প্রতিশ্রুতি দেন যে, প্যালেস্টাইন একটি আরব রাষ্ট্র হিসাবেই থাকবে। প্যালেস্টাইন ছিল ইহুদী, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের পবিত্র স্থান। এই তিন ধর্মের কাছেই প্যালেস্টাইনের গুরুত্ব ছিল সমধিক। এরফলে প্যালেস্টাইনের অধিকার নিয়ে এই তিন ধর্মের অনুগামীদের মধ্যে সংঘর্ষ ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে যে খনিজ তেল উত্তোলন করা হয় তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হত যে পাইপ লাইনের মাধ্যমে সেই পাইপ লাইন ছিল পালেস্টাইনের মধ্যে । ফলে পালেস্টাইনের অধিকার নিয়ে স্বস্ত ছিল খুবই স্বাভাবিক।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন দেশের ইহুদিরা আরব রাষ্ট্রগুলিকে সম্পূর্ন অগ্রাহ্য ও অবজ্ঞা করে দলে দলে প্যালেস্টাইনে বসবাস করতে শুরু করে। পশ্চিমী শক্তিবগ ইয়দিদের এই অনৈতিক কাজকে নীরবে সমর্থন করায় প্যালেস্টাইন সমস্যা এক জটিল সমস্যায় পরিণত হয় ৷ দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধের পরবর্তীকালে দুই বৃহৎ শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রেক্ষিতে ইউরোপে যে ঠান্ডা লড়াইয়ের সূত্রপাত হয়, তা অচিরেই সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। সেই প্রভাবের ক্ষেত্র কেবল রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি প্রভৃতি সমঞ্জ কিছুকেই প্রভাবিত করেছিল।
ঠান্ডা লড়াই দ্বি-মেরুকরণ রাজনীতির সৃষ্টি করেছিল। অর্থাৎ যুদ্ধ পরবর্তীকালে বিশ্বে যে দুটি মহাশক্তির তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার বিকাশ ঘটেছিল, তাতে অন্য কোনো শক্তির ভূমিকা মোটেই গুরুত্বপূর্ন ছিল না। এই উভয় শক্তিকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালে অর্থনীতি ও সামরিক দুনিয়া দু-আগে ভাগ হয়ে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর দুই মহাশক্তির মধ্যে কোনো যুদ্ধ বাধেনি। কিন্তু ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রভাবে বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রায়শই যুদ্ধ লেগেই ছিল। যেমন- কোরিয়ার যুদ্ধ, ভিয়েতনামের যুদ্ধ প্রভৃতি যুদ্ধ ঠান্ডা লড়াইয়েরই ফল। ঠান্ডা লড়াইয়ের একটি অনুষঙ্গ ছিল বৃহৎ-শক্তিবর্গের আঞ্চলিক সামরিক জোট গড়ে তোলা। ঐসব সামরিক জোটগঠন বিশ্ব-শান্তির পক্ষে কখনোই বাঞ্ছনীয় ছিল না। এগুলি একদিকে যেমন উষ্ণ যদ্ধের আশঙ্কাকে জিইয়ে রেখেছিল, তেমনি অন্যদিকে জাতিপুঞ্জের গুরুত্বকে বহুলাংশে হ্রাস করেছিল। এছাড়া ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রভাবে বিশ্বে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা ভয়াবহ আকার ধারন করেছিল।
ঠান্ডা লড়াইয়ের আবর্ত থেকেই জন্ম নিয়েছিল তৃতীয় বিশ্বের ধারনা। এজন্য সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের ঠান্ডা লড়াইয়ের আবর্তে শামিল করতে চায়নি। তবুও ঐসময় তৃতীয় বিভিন্ন দেশের মধ্যে যে সংঘর্ষ ঘটেছিল, তার পিছনে বহু ক্ষেত্রেই ঠান্ডা লড়াইয়ের ভূমিকা ছিল ৷
ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রভাবেই বিশ্বে জন্য নিয়েছিল জোটনিরপেক্ষতা । এই জোটনিরপেক্ষতা নীতি হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা সোভিয়েত রাশিয়া কোনো জোটের সাথেই নিজেদের যুক্ত না করা । অর্থাৎ কী গণতান্ত্রিক ধনতন্ত্রবাদের জোট, কী সমাজতান্ত্রিক শিবির-উভয়ের থেকেই সমদূরত্ব বজায় রাখা । ঠান্ডা লড়াই প্রত্যেক দেশকে নিজ নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে আধুনিক সমরাস্ত্র সংগ্রহ করার প্রতিযোগিতায় নামিয়েছিল । ফলে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় প্রবলভাবে বেড়ে যায় । এজন্য প্রতিটি দেশেরই আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা প্রবলভাবে ব্যহত হয় ।
দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধের পর হতে উনবিংশ শতকের নবম দশক পর্যন্ত এই ঠান্ডা লড়াই চলছিল মার্কিন-সোভিয়েত শিবিরের মধ্যে । অবশেষে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে গেলে এই ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান ঘটে । ঠান্ডা লড়াই ছিল মূলত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যেকার দ্বন্দ্ব যা বিশ্বের অধিকাংশ দেশগুলিকেই প্রভাবিত করেছিল ।