সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতন্ত্রে উত্তরণ সংক্রান্ত বিবরণ
সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতন্ত্রে উত্তরণ সংক্রান্ত বিবরণ
ইউরোপ তথা বিশ্ব ইতিহাসে সামন্ততন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ বা বিবর্তন বা রূপান্তর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে স্বীকৃত । এই পর্ব ইতিহাসের যুগাসন্ধিক্ষ পর্ব নামে পরিচিত । সামন্তবাদ থেকে ধনতন্ত্রে উত্তরণের বিষয়ে ঐতিহাসিক মহলে অনেক বিতর্ক ও আপত্তি রয়েছে এবং ফলস্বরূপ, এটি আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয় হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে । ব্রিটিশ মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ মরিস ডবের ১৯৪৭ প্রকাশিত "Studies in the development" গ্রন্থে আলোচনা করেছেন । এই বইতে মরিস ডবের দাবি অনুসারে, সামন্ততন্ত্রের অভ্যন্তরীণ গতিশীলতা এটিকে অধঃপতনের বা Internal condition দিকে চালিত করেছে এবং এটি সামন্ত ব্যবস্থার বা Production relation সম্পর্ক এবং এর অভ্যন্তরীণ অবস্থা উভয়ের মধ্যেই সামন্ততন্ত্রের পতন সূচিত হয় ৷ যার পরবর্তী প্রক্রিয়া হিসেবেবা গণতন্ত্র বা পুঁজিবাদের বিকাশের পথ পায় ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
ভূমিদাস প্রথাকে অবলম্বন করে যে গ্রাম নির্ভর কৃষি কেন্দ্রিক অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল তাতে উৎপাদন সংঘটিত হয় একান্তভাবে গ্রামীণ বা আঞ্চলিক চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে ৷ জনসংখ্যা বাড়লেও সামন্ত ব্যবস্থার উৎপাদনের হার সেভাবে বাড়েনি । সীমাবদ্ধ এই আঞ্চলিক অর্থনীতি অর্থাৎ Economy of no outlet একটি পর্যায়ে দুর্বল হয়ে পড়ে ৷ এছাড়াও খাজনা নগরীকরণ অর্থাৎ ভাড়ার পরিবর্তন সামন্ত ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ভূমিকা প্রথার অবসান ঘটায় ৷ যা সামন্ত ব্যবস্থাকেই দুর্বল করে এবং ধনতন্ত্র বিকাশের পদ প্রশস্ত করে ৷
মার্কিন অর্থনীতিবিদ পল সুইজি সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয় সম্পর্কে মরিস ডবের সামন্ততন্ত্রের অন্তবিরোধ তথ্য স্বীকার না করেই ইউরোপীয় অর্থনীতির ক্রমশ দূর বাণিজ্যিক প্রবণতাকে সামন্ত ব্যবস্থার দুর্বলতার অন্যতম কারণ এবং পুঁজিবাদের বিকাশের প্রধান শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন ৷ ১৯৫০ এর দশকে সাইন্স এন্ড সোসাইটি নামক পত্রিকায় "Feudalism: A critique প্রবন্ধে সুইজি Commercialization বা বাণিজ্যিকরণ তত্ত্বের অবতারণা করে বলেন একাদশ শতকের শেষ লগ্ন হতে ভূমধ্যসাগরীয় এবং উত্তর সাগরীও বাণিজ্য বাড়তে থাকার ফলে ইউরোপীয় অর্থনীতির সামন্ত প্রবণতা পরিত্যাগ করে গণতান্ত্রিক প্রবণতা মুক্ত হয়ে ওঠে ৷ যার মধ্য দিয়ে ইউরোপে যুগ সন্ধিক্ষণ বা রূপান্তর পর্ব ও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, সুইজির মতে দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকে ইউরোপের নগরায়ন প্রক্রিয়া সামন্ত ব্যবস্থা ধ্বংস ও ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ ত্বরান্বিত করে ৷
যুগসন্ধিক্ষণ বা রূপান্তরের বিতর্কে মরিস ডব এবং পল সুইজির পাশাপাশি রবার্ট গেনার ১৯৭০, দশকে Past and present পত্রিকায় "প্রাক শিল্প ইউরোপের কৃষি শ্রেণীর কাঠামো এবং অর্থনীতির উন্নয়ন" প্রবন্ধের বাণিজ্যিকরণ তথ্য ও জনসংখ্যা তত্ত্বের মাধ্যমে সামন্ততন্ত্রের অবসান সংক্রান্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ নাৎসাত করে দিয়ে সামন্ত ব্যবস্থার পতন এবং ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশের নৌপথৌ থেকে বল অর্থনীতিকেই নয় সামন্ত ব্যবস্থার রাজনৈতিক সংঘাতকেও এই ব্যবস্থা দুর্বলতার প্রধান কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন ৷
যুগসন্ধিক্ষণ সংক্রান্ত বিতর্কে প্রবক্তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে নানা আঙ্গিক প্রাধান্য পেয়েছে যেমন, আর্থসামাজিক , রাজনৈতিক, জনসংখ্যা তত্ত্ব তবে এইটুকু নিশ্চিত যে সামন্ততন্ত্রের পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল চতুর্দশ শতাব্দীতে ৷ ঘটনার কালক্রম সম্বন্ধে ঐক্যমতের কারণে চতুর্দশ শতকে ইউরোপের অর্থনীতি সংকটের মুখোমুখি হয় যা সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর অবশিষ্ট বৈশিষ্ট্য গুলিকে অপসারিত করে ধনন্তন্ত্রের আগমনের পথ প্রস্তুত করে ৷