ইতালির ঐক্য প্রতিষ্ঠায় মাৎসিনি কাভুর ও গ্যারিবল্ডির ভূমিকা আলোচনা কর
উনবিংশ শতাব্দীর ত্রিরিশ এর দশকে শুরুতে ইতালির ঐক্য আন্দোলন এক ধ্রুবতারার আবির্ভাব হয় তিনি ছিলেন জোসেফ মাৎসিনি ৷ তিনি ছিলেন সুলেখক, চিন্তাবিদ ও দেশপ্রেমিক ৷ ঐতিহাসিক হ্যাডেনের মতে ,"মাৎসিনি ছিলেন ইতালির পুনর্জাগরণের আধ্যাত্মিক শক্তি ৷"
দেশবাসীকে স্বাধীনতা অর্জনের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য মাৎসিনি ১৮৩১ সালে ইয়ং ইতালি নামে একটি দল গঠন করেন ৷ এই দলের আদর্শ ছিল স্বাধীনতা ঐক্য গণতন্ত্র সাম্য ও মানবতা অখন্ড ও ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক ইতালি প্রতিষ্ঠা এই দলের মূল লক্ষ্য ছিল ৷ তার বাণী ছিল"Never rise in any other name than that of italy and all of italy ৷" তিনি ছিলেন গভীরভাবে জাতীয়তাবাদী ৷ তিনি উপলব্ধি করেছিলেন স্বাধীনতা ও ঐক্যবদ্ধ ইতালীয় প্রজাতন্ত্র স্থাপনের পথে প্রধান বাধা হল অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্যবাদ। সুতরাং ইতালির উপর থেকে অস্ট্রিও কর্তৃত্বের বিলোপ ঘটালেই ঐক্যবদ্ধ ইতালি গঠনে সম্ভব হবে ৷ এর ফলে অস্ট্রিও উপনিবেশ শাসনের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন গড়ে তোলে ৷ ইতালি দলের নেতৃত্বে এই গন আন্দোলন"Risorgigimento" নামে বিখ্যাত ৷ মাৎসিনির আদর্শের দ্বারা পরিচালিত এই গণনা আন্দোলন পূর্ণতা পায় ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে ৷
![]() |
মিলানের পাঁচ দিন , ১৮-২২ মার্চ ১৮৪৮ |
১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব শুরু হলে তার ঢেউ ইতালিতে এসে পৌঁছায় ৷ ইতালির সর্বোচ্চ গণ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ৷ মাৎসিনির নেতৃত্বে ইয়ং ইতালি দল ইতালির ঐক্য আন্দোলনে চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে ৷ রোমে গণঅভ্যুত্থান শুরু হলে পোপ পলায়ন করে ৷ মাৎসিনির নেতৃত্বে রোম ও টাস্কনিতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় । কিন্তু ইতালীয় মানুষের এই বিদ্রোহর সাফল্য ছিল সামরিক কিছুদিনের মধ্যে অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সের সেনাবাহিনী বিদ্রোহী দমন করে ৷ পোপকে তার হৃত ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়, ক্রমে প্রজাতন্ত্রকে ধ্বংস করে দেয়া হয় ৷ মাৎসিনি লন্ডনে আশ্রয় নেয় ৷
স্বাধীনতা অর্জনের ব্যর্থ হলেও ইতালির ঐক্য আন্দোলনের মাঝখানের অবদান কখনো অস্বীকার করা যায় না । ইতালির মানুষের মনে দেশপ্রেম ও জাতীয়তা বোধের সঞ্চার করে তিনি ইতালির স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন ।
![]() |
সান মার্কো প্রজাতন্ত্রের ঘোষণার পরে ড্যানিয়েল মানিন এবং নিকোলো টমাসেও |
ক্যাভুর
ইতালির ঐক্য আন্দোলনের রক্ষণশীল গোষ্ঠীর অন্যতম উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ছিলেন কাউন্ট ক্যাভুর ৷ ১৮৫২ সালে তিনি শ্যাডিনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হলে ইতালির রাজনীতিতে তার প্রভাব সামগ্রিকভাবে বৃদ্ধি পায় ৷ ক্যাভুর কার্য পদ্ধতির প্রথম ধাপ ছিল স্বাধীনতা অর্জনের নেতৃত্ব দেওয়ার উপযোগী করে পিডমন্ড শার্টেনিয়ার রাজ্যকে গড়ে তোলা ৷ তিনি কৃষি শিল্প বাণিজ্যের আধুনিকরণ, রেলপথ নির্মাণ, সামরিক বাহিনীর পুনর্গঠন প্রভৃতি নানা সংস্কারের মাধ্যমে পিডমন্ড শার্ট ইনিয়ার শক্তি বৃদ্ধি করেন ৷
পিডমন সাডেনিয়াকে পুনগঠিত করার পর ক্যাভুর অস্ট্রিয়ার হাত থেকে ইতালিকে মুক্ত করতে তৎপর হন ৷ ১৮৫৪ সালে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৷ এই যুদ্ধে ক্যাভুর রাশিয়ার বিপক্ষে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ও তুরস্কের পক্ষে যোগদান করেন ৷ ১৮৫৬ সালে যুদ্ধের অবসান ঘটলে শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ৷ ক্যাভুর প্যারিসে শান্তি সম্মেলনে ইতালির অনৈক্য সমস্যাকে আন্তর্জাতিক সমস্যার পরিণত করে ৷
সন্ধি স্বাক্ষর করে দেশে ফিরে ক্যাভুর নানাভাবে অস্ট্রিয়াকে যুদ্ধের জন্য প্ররোচনা দিতে থাকে, উত্তেজিত অস্ট্রিয়া ১৮৫৯ সালে পিডমন্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ৷ এই যুদ্ধে ফ্রান্স পিডমন্ডের পক্ষে নেয় ৷ শেষ পর্যন্ত ফরাসি রাজা তৃতীয় নেপোলিয়ান হঠাৎ ক্যাভুরকে গোপন করে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ভিল্লাফ্রাঙ্ক সন্ধি স্বাক্ষর করে যুদ্ধ থেকে সরে আসেন ৷ এই যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত পিডমন্ড,লম্বার্ডি ও মিলান উদ্ধার সফল হয় ৷ তবে ভেনিস অস্ট্রিয়া দখলে চলে যায় ৷ অস্ট্রিয়া ও পিঠমন্ড যুদ্ধ চলাকালে ইতালি তাসকানি, মোজনা,পার্মা ও রোমে ব্যাপক গণ আন্দোলন শুরু হয় ৷ এই রাজ্যগুলি সঙ্গে সংযুক্তির ইচ্ছা প্রকাশ করলে ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়া আপত্তি জানায় । কিন্তু ক্যাভুর ফ্রান্সকে স্যাভায় ও নিস দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে ফ্রান্স আপত্তি প্রত্যাহার করে নেয় ৷ ফলে উত্তর ভেনিস ও পোপের রোম ব্যতীত সমগ্র উত্তর ও মধ্য ইতালি পিডমন্ডের পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ হয় ৷
ক্যাভুর তার মৃত্যুর আগে প্রায় সমগ্র ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সফল হয় ৷ তার মৃত্যুর কিছুকালের মধ্যেই ভেনিসিয়া ও রোম ইতালির অধিকার আছে ৷ তার সুযোগে নেতৃত্বকেই ইতালীয় ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হয় ।
গ্যারিবল্ডিঃ
![]() |
১৮৩৩ সালে ইয়ং ইতালির সদর দপ্তরে গ্যারিবাল্ডি এবং মাজিনির মধ্যে প্রথম সাক্ষাৎ |
ইতালির ঐক্য আন্দোলনের এক অবিস্মরণীয় নেতা হলেন গ্যারিবল্ডি ৷ বুরবো রাজা দ্বিতীয় ফ্রান্সের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলন শুরু করে ও সিসিলি প্রদেশের মানুষজন আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তারা দেশপ্রেমিক বীর গ্যারিবল্ডির কাছে আবেদন জানায় ৷
গ্যারিবল্ডি মাত্র ১০৯০ জন লাল কুর্তা বাহিনীর গরিলা সদস্যদের নিয়ে দক্ষিণ ইতালিত অভিযান চালায় ৷ এই যুদ্ধে ২৫ হাজার পূর্ব সেনাকে হারিয়ে তিনি শিশিলি জয় করেন ৷ এরপর তিনি নিজেকে সিসিলির ডিটেক্টর রূপে ঘোষণা করেন ৷ গ্যারিবল্ডি তোরিনা ও ফ্রাঙ্কলিন নামক দুটি জাহাজ করে তার গরিলা বাহিনীর দ্বারা নেপলস জয়ের প্রচেষ্টা চালান । গ্যারিবল্ডির উদ্দেশ্য ছিল পোপের কাছ থেকে সাম্রাজ্য উদ্ধার করা এবং দক্ষিণ ইতালিকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র রূপে প্রতিষ্ঠা করা ৷
গ্যারিবল্ডি পপের কাছ থেকে সাম্রাজ্য উদ্ধার করেননি বা দক্ষিণ ইতালিতে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র গড়ে তোলেনি ৷ ক্যাভুরের পরামর্শ অনুযায়ী ইমানুয়েল গ্যারিবল্ডির বশ্যতা মেনে নিলে তিনি সিসিলি ও নেপালস এর অধিকার ত্যাগ করেন ৷ আর এই আত্মত্যাগের জন্যই ইতালি এক ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধের হাত থেকে মুক্তি পায় । গ্যারিবল্ডির মতো খাঁটি দেশ প্রেমিকের কাছে নিজের স্বার্থ ও ক্ষমতা অপেক্ষা মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও ঐক্যের মূল্য ছিল অনেক বেশি ।
ছবির সূত্রঃ- উইকিপিডিয়া
ইতিহাসের কন্ঠস্বর /itihasherkonthoshor
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ইতালির ঐক্য প্রতিষ্ঠায় মাৎসিনি কাভুর ও গ্যারিবল্ডির ভূমিকা আলোচনা কর Mazzini, Cavour and Garibaldi in establishing the unity of Italy এই নোটটি পড়ার জন্য