ভারতে চরমপন্থী আন্দোলনের উদ্ভবের কারণগুলি কী ছিল। এর সীমাবদ্ধতা আলোচনা করো। অথবা, ভারতে সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের কারণগুলি আলোচনা কর।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা, ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবোধ এবং প্রথম পর্বের জাতীয় নেতাদের সংস্কার আন্দোলন জাতীয় কংগ্রেসের এক শ্রেনীর নেতাদের সংগ্রামী মনোভাবকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে নি। কংগ্রেসের ঘোষিত উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও পদ্ধতির মধ্যে পূর্ন স্বাধীনতার আকাঙ্খা প্রতিফলিত না হওয়ায় তারা উগ্র-স্বাদেশীকতার প্রচারে উৎসাহী ছিলেন। নরমপন্থীদের আবেদন-নিবেদন মূলক রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে কংগ্রেসের এই অনুগামীদের আকাঙ্খা থেকেই জন্ম হয় সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদ তথা চরমপন্থী গোষ্ঠীর। এই চরমপন্থী গোষ্ঠীর প্রবক্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন-লালা লাজপৎ রায়, বিপিনচন্দ্র পাল, বালগঙ্গাধর তিলক, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ চরমপন্থী আন্দোলনের কারণঃ
কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতাদের আবদেন-নিবেদন নীতির প্রতি ব্রিটিশ সরকারের ঔদাসীন্য কংগ্রেসের তরুন সদস্যদের অসহিষ্ণু করে তোলে। শেষ পর্যন্ত তারা এই রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন। অরবিন্দ 'ইন্দুপ্রকাশ' পত্রিকায় ক্ষোভের সাথে বলেন, 'কংগ্রেসের কার্যকলাপ অবৈধ'। তিলক বলেন, 'স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার, তা আমি অর্জন করবই'। ব্রিটিশ সরকারের সীমাহীন শোষণ, বৈষম্যমূলক করবিন্যাস, দেশীয় শিল্পের ধবংস -প্রাপ্তি এবং দেশবাসীর বেকারত্ব ভারতবাসীকে নিদারুন অর্থ সংকটের মুখে ফেলে। দাদাভাই নৌরজী বলেন, ভারতের দুর্দশা থেকে মুক্তির উপায় হল স্বায়ত্ত-শাসন। ইহা প্রচারিত হওয়ায় ভারতবাসী প্রবলভাবে ব্রিটিশ বিদ্বেষী হয়ে ওঠে।
রাজনারায়ণ বসুর উদ্যোগ ও হিন্দু মেলার কার্যকলাপ, বঙ্কিমচন্দ্রের সর্বত্যাগী হওয়ার আহবান ও বন্দেমাতরম মন্ত্র, বিবেকানন্দের স্বদেশ-প্রীতি, দয়ানন্দের শ্রষ্ঠত্ব হিন্দুধর্ম প্রতিষ্ঠার আদর্শ কংগ্রেসের নবীন সম্প্রদায়কে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। এ সময় আমেরিকার শিকাগোতে বিশ্বধর্ম মহাসভায় হিন্দু-ধর্ম
সম্বন্ধে বিবেকানন্দের দৃপ্ত ভাষন শিক্ষিত যুব-গোষ্ঠীর মধ্যে অনুপ্রেরণা সঞ্চার করে। ১৮৭৯-৯০ খ্রিঃ মধ্যে ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। এই দুর্ভিক্ষের সময় সরকারের নির্মম উদাসীনতা ভারতীয়দের ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। ক্ষরা, দুর্ভিক্ষ, প্লেগ, মনুস্তরে মানুষ যখন না খেতে পেয়ে মারা যায়, তখন ব্রিটিশ সরকার সাহায্যের পরিবর্তে নিজ স্বার্থ রক্ষায় মশগুল ছিল। ব্রিটিশের সরকারের এই দায়িত্বহীনতার সমুচিত জবাব দিতে চরমপন্থী মানসিকতার উদ্ভব ঘটে।
বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে ব্যাপক প্লেগ দেখা দিলে তা দমনের নামে ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচার মানুষকে স্তম্ভিত করে দেয়। আক্রান্ত জনগনের চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে ত্রাণকার্যের ওই অর্থ মহারানী ভিক্টোরিয়ার সিংহাসন আরোহনের হীরক-জয়ন্তী উৎসবে ব্যয় করা হয়। সরকার এই অনাচার ও নৈরাজ্যমূলক ভূমিকার জন্য চরমপন্থী গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। সমকালীন বেশ কিছু সংবাদ পত্র ও সাময়িক পত্র সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটাতে সাহায্য করেছিল। অরবিন্দের 'বন্দেমাতরম', বিপিনচন্দ্রের 'নিউ-ইন্ডিয়া', শিশির কুমার ঘোষের 'অমৃতবাজার পত্রিকা', ঈশ্বর গুপ্তের 'সম্বাদ প্রভাকর' প্রভৃতিতে ব্রিটিশের সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকার তীব্র সমালোচনা -মূলক লেখা উগ্র সংগ্রামী মানসীকতার জন্ম দেয়।
লর্ড কার্জনের প্রতিক্রিয়াশীল নীতি, কংগ্রেস সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গী এবং বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের চেতনার প্রসার ঘটায়। কার্জনের বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও কলকাতা কর্পোরেশন আইন জনগনের সামনে সাম্রাজ্যবাদের চেহারাকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। এভাবে তাঁর স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষের আগুন বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা ঘৃতাহুতির কাজ করে। এভাবেই বঙ্গভঙ্গই ভারতে চরমপন্থা উনোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সে সময় কিছু আন্তর্জাতিক ঘটনা ভারতে চরমপন্থী মতবাদের উদ্ভব ও বিকাশে সাহায্য করেছিল। বুয়র যুদ্ধে ব্রিটেনের পরাজয় এবং রুশ-জাপান যুদ্ধে জাপানের অসাধারণ সাফল্য ইউরোপীয়দের শ্রেষ্ঠত্বের অলীক মহিমাকে ক্ষুন্ন করে। এই সংবাদ ভারতীয় জাতীয়বাদকে উদ্দীপিত করে।
সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উদ্ভব এবং প্রসারের ক্ষেত্রে লোকমান্য তিলকের অবদান অন্যতম। দেশবাসীর মনে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের আদর্শ সঞ্চার করার জন্য তিনি শিবাজী উৎসবের আয়োজন করেন। দ্বিধাহীন কণ্ঠে তিনি বলেন, স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার। তাঁর এই বৈপ্লবিক দাবি ভারতীয় যুব-মানসে উত্তেজনার সৃষ্টি করে।
সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদ সর্বপ্রকার ত্রুটির উপরে উঠতে পারে নি। এর নেতৃবৃন্দ ভারতের অগণিত সাধারণ মানুষ, শ্রমিক ও কৃষকদের জাতীয় আন্দোলনের সাথে সম্পূর্নভাবে যুক্ত করতে অসমর্থ হন। তাঁদের ওপর সমাজতান্ত্রিক আদর্শ কোনরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি। ফলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠনের কোনো পরিকল্পনা তাঁরা গ্রহন করেনি। সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ ভারত যে বহু জাতি, ধর্ম ও ভাষাভাষী অধ্যুষিত দেশ তা উপলব্ধি করতে পারেন নি।
■ তাঁদের হিন্দুধর্ম ও উচ্চবর্ণের মানুষের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ কালক্রমের জাতীয় সংহতির পক্ষে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং সাম্প্রদায়িকতার বীজ জাতীয় জীবনে উপ্ত হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এরূপ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। ঐ বীজ থেকে সৃষ্ট বৃক্ষ ভারতের জাতীয় জীবনে বিষময় ফলের জন্ম দেয়।
সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদীদের উন্মেষের ফলে ভারতবাসী প্রকাশ্যে স্বাধীনতার অধিকারের দাবী ঘোষনা করে। তবে কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন যে, সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক দিক দিয়ে কোন বিশেষ পট-পরিবর্তন সূচনা করে না। তাঁদের মতে এট ছিল মূলত কংগ্রেসের আভ্যন্তরিন রাজনীতিতে ক্ষমতা দখলের লড়াই-এর পরিণতি। তাঁরা মনে করেন এর নেতারা হিন্দুধর্ম ও তার ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের আদর্শ প্রচার করায় জাতীয় আন্দোলন সংকীন হয়ে পড়েছিল।