Drain of Wealth বা সম্পদের বহির্গমন বলতে কী বোঝো বা,সম্পদের নির্গমন কাকে বলে? উপনিবেশিক ভারতের অর্থনীতিতে তার প্রভাব আলোচনা কর।
ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে সমুদ্রের অপরপ্রান্ত থেকে আগত ইংরেজরা ভারতে বাণিজ্যিক বিস্তার ঘটাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল ৷ বাণিজ্যের সাথে সাথে রাজনৈতিক ক্ষমতাও অধিক প্রয়োজনীয় বলে তারা বিবেচনা করে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের উন্মত্ত খেলায় তারা মেতে ওঠে ৷ অবশেষে ইংরেজরা জয়লাভ করলে তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য সার্থক হয় ভারতের অফুরন্ত সম্পদ তারা গ্রাস করতে থাকে ৷ ভারতের এই অফুরন্ত সম্পদের নিরলাসে ব্রিটিশ যাত্রাই সম্পদের নিগমের নামে পরিচিত ৷
জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দরা মনে করেন ভারতের এই দরিদ্রতার এক গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো ভারত থেকে ইংল্যান্ডে সম্পদের নির্গমন ৷ জাতীয়তাবাদী নেতা ও ঐতিহাসিক দাদাভাই নওরজি তার "The British rule of India" গ্রন্থে প্রথম সম্পদ নিরসনের ধারণাটি তুলে ধরেন ৷ রমেশ চন্দ্র মজুমদার তার "Economic history in India" গ্রন্থে বলেছেন প্রতিবছরের মোট রাজস্বের প্রায় অর্ধেক ভারত থেকে নিঃশেষিত হতো ৷ ডঃ ইরফান হাবিব বলেছেন পলাশীর যুদ্ধের পর দুর্নীতিমূলক কর ব্যবস্থা একচেটিয়া বাণিজ্যিক প্রভৃতির ফলে ভারত থেকে যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ রপ্তানি করা হতো তাকেই সম্পদের নির্গমন বা Drain of wealth বলা চলে ৷
পলাশীর যুদ্ধের পর যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে কেন্দ্রীভূত হতো তাড়াতাড়ি একটি বড় অংশ স্বদেশ প্রেরণ করত ৷ ঐতিহাসিক ত্রিপাঠী তার "India today" গ্রন্থে এই জাতীয় প্রচেষ্টাকে সরাসরি লুন্ঠনের পর্যায়ে বলে উল্লেখ করেছেন ৷
পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলার মনসদে বসেন মীরজাফর রবার্ট ক্লাইভ তার কাজ থেকে প্রচুর অর্থ ও সম্পদ লুট করে স্বদেশে পাঠিয়ে দেন, মীরজাফরের পর মির কাসিম বাংলার সিংহাসনে বসেন ইংরেজদের বাণিজ্য ভাটা পড়ে । তাই ইংরেজরা মীর কাসিম কেউ সরিয়ে মীর জাফরকে আবার সিংহাসনে বসায় ৷ মির্জাফরের মৃত্যুর পর তার পুত্র নাজিম-উদ দৌলার কাছ থেকে ইংরেজরা প্রচুর অর্থ পুরস্কার স্বরূপ গ্রহণ করেন ৷ তাছাড়া কোম্পানির কর্মচারীরা বেআইনিভাবে দত্তক প্রদর্শন করে বিনাশুলকে ব্যক্তিগত বাণিজ্য চালিয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন ৷
ঐতিহাসিক পার্সিভ্যাল স্পিয়ার এই কারণে পলাশীর পরবর্তী যুগকে প্রকাশ্য ও নির্লজ্জের যুগ বলে চিহ্নিত করেছেন ৷ উপার্জিত অর্থের প্রায়ই সমস্ত টাকায় কোম্পানির কর্মচারীরা স্বদেশে পাঠিয়ে দিত কিন্তু দেওয়ানী লাভের পর সম্পদের নিগরনের বিষয়টি এক নতুন রূপ পরিগ্রহ করে পণ্য সামগ্রী ক্রয় করে স্বদেশের রপ্তানি শুরু করে এবং এইভাবেই বাংলা কেউ শোষণ করে তারা কয়েক বছরের মধ্যে উদ্বৃত্ত অর্থের মালিক হয়ে ওঠেন ৷ কোম্পানির ভারতে পণ্য কেনার জন্য স্বদেশ থেকে অর্থ আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয় পরিবর্তে উদবৃত্ত রাজস্বের টাকা দিয়েই মাল কিনে ব্যবসা শুরু করে ৷
সম্পদের নির্গমন এর আরো কতগুলি দিক ছিল কোম্পানি নানারকম কর ধার্য করে যুদ্ধের ব্যয়ভার মেটাতো ৷ ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ দমনে যে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়েছিল তার ঋণ কর দাতাদের ওপর আরোপিত হয় ৷ একেই বলে 'মাছের তেলে মাছ ভাজা' এছাড়াও যেসব ইংরেজ সৈনিক ভারতীয় সেনায় ভর্তি হতো তাদের শিক্ষা,খাওয়া-দাওয়া , জাহাজ ভাড়া সমস্ত ভারতীয় কর দাতাদের দিতে হতো ৷ মনে রাখা দরকার ১৮৫৮ থেকে ১৯১৪ সালে অনেকগুলি যুদ্ধ হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থে এই যুদ্ধ গুলির খরচের মোটা অংশ ছিল ভারতের ফলে আমাদের কর ভান্ডার থেকেই মোটা টাকা বিদেশে চালানো হতো ৷
পরিশেষে বলা যায় দীর্ঘকাল ধরে সম্পদের নির্গমন ভারতের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙে দিয়েছিল এই অর্থনীগণ মনের ফলে ভারতের চিরাচরিত কুটির শিল্প ভারতীয় জনগণের আর্থিক পরি কাঠামো ভেঙে পড়ে ভারতের শস্য শ্যামলা গ্রামগুলি শুকিয়ে যায় ৷ ভারতের সম্পদ ইংল্যান্ডকে সুখী করে তোলে পরিবর্তে ভারতকে করে তোলে রিক্ত ও নিঃস্ব ৷
