ফরাসি বিপ্লবের আর্থ সামাজিক কারণ গুলি আলোচনা করো
বিপ্লব হঠাৎ করে বা একটি মাত্র কারণে ঘটে না বিপ্লবের পাশ্চাত্যে থাকে দীর্ঘদিন প্রস্তুতি বা বহুবিধ কারণ ৷ এগুলি রাতারাতি বা একটি নির্দিষ্ট কারণে ঘটে না। শোষণ যখন তীব্র মাত্রায় পৌঁছায় এবং শাসকশ্রেণী অত্যাচারী হয়ে ওঠে তখন মানুষ বিপ্লবের পথে যায়। এই বিবৃতিটি ফরাসি বিপ্লবের সাথে সম্পর্কিত।
Table of Contents
অর্থনৈতিক কারণঃ
ফরাসি বিপ্লবের পেছনে যেসব অর্থনৈতিক কারণ ছিল সেগুলি হল:--
রাজ পরিবারের বিলাসবহুল জীবনঃ
ফরাসি রাজতন্ত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ঐশ্বর্যময় জীবনযাপন ৷ ইতিহাসবিদ গুডউইনের মতে রাষ্ট্রের সামগ্রিক আই এর একদশমাংশ ছিল রাজপরিবারের ভরণ পোষণের দিকে । ফরাসি অর্থনৈতিক সংকটের অন্যতম কারণ ছিল রাজপরিবারের ব্যয় কমাতে অক্ষমতা ।
আরও পড়ুন
ভ্রান্ত যুদ্ধনীতিঃ
ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সংকট বেশিরভাগ পূর্বের রাজাদের বোকা যুদ্ধ কৌশলের কারণে হয়েছিল । চতুর্দশ লুই ইউরোপ জুড়ে ক্ষমতা অর্জনের জন্য অনেক যুদ্ধ করেছিলেন । পঞ্চদশ লুই এর অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়েছিল । আমেরিকান স্বাধীনতা আন্দোলনে ষোড়শ লুই এর বিশাল আর্থিক অবদান দেশটির অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছিল । এই সময়ে, ফ্রান্সের সামরিক ও যুদ্ধের ব্যয় তার মোট জাতীয় রাজস্বের অর্ধেক ছিল।
কর বৈষম্যঃ
ফ্রান্সে কর ব্যবস্থা ছিল বৈষম্যমূলক । ফরাসি সমাজে দুটি প্রাথমিক শ্রেণী ছিল অধিকারভোগী এবং অধিকার বঞ্চিত। অন্য কথায়, একটি শ্রেণী বিনা মূল্যে সমস্ত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে উপকৃত হতো, যেখানে অন্য শ্রেণী কর প্রদান করলে এই সুযোগ-সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত হতো । এই কর বৈষম্য দ্বারা বিপ্লবীরা বিপ্লবী হতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল ।মুদ্রাস্ফীতিঃ
অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে, ফ্রান্সের জনসংখ্যা একটি ব্যতিক্রমী উচ্চ গতিতে বৃদ্ধি পায় । কিন্তু তার বিপরীতে উৎপাদনের সৃষ্টির কোনো উত্থান ঘটেনি । কৃষকদের সতর্ক অবস্থানের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলের উল্লেখযোগ্য ক্ষতির ফলে কৃষি উৎপাদন হ্রাস এবং শস্যের দাম 60-65% বৃদ্ধি পেয়েছে । কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে কৃষকদের মজুরি বাড়ানো সম্ভব হয়নি । যে অথচ অর্থ সংকটের জন্য মজুরি বৃদ্ধি করা যায়নি ৷ দেশে ব্যাপক হারে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে এই পরিস্থিতি যে কোন দেশেই বিপ্লব গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অনুকূল ফ্রান্সও এর থেকে আলাদা ছিল না।
সামাজিক কারণঃ
ফরাসি বাসিরা তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল । পুরোহিত শ্রেণী ছিল প্রথম যাজক শ্রেণী , দ্বিতীয় হল অভিজাত শ্রেণি আর তৃতীয় সম্প্রদায় হল বুর্জোয়া কৃষক ও নগরবাসী,প্রলেতারিয়েত শ্রেণী ।
প্রথম সম্প্রদায়ঃ
এর ফ্রান্সে যাজক সম্প্রদায় ছিল প্রথম শ্রেণী এরা ছিল মোট জনসংখ্যার 1 শতাংশ কম ফ্রান্সের মোট জমির এক দশম অংশ ছিল এই শ্রেণীর অধিকারের । এরা জনগণের কাছ থেকে ধর্ম কর আদায় করত এরা রাষ্ট্রকে কোন কর কোন প্রকার কর দিত না । পুরোহিতদের দুটি শ্রেণি ছিল: উচ্চ যাজক এবং নিম্ন যাজক । গির্জার রাজস্বের সিংহভাগই ভোগ করত মুষ্ঠিমেয় উচ্চতর যাজকরা । ফলস্বরূপ, উচ্চ যাজকরা হয়ে উঠেছিল বিলাসী ও দুর্নীতি পরায়ণ । ফরাসি বিপ্লবের আগে, দার্শনিকরা চার্চের দুর্নীতি ও ভ্রষ্টাচারের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করায় এদের ওপর সাধারন মানুষের ভক্তি শ্রদ্ধায় ফাটল ধরে । নিকৃষ্ট যাজক অবশেষে বিপ্লবীদের সাথে যোগ দেয় কারণ তাদের মধ্যে তাদের পারস্পরিক শত্রুতা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল ।
দ্বিতীয় সম্প্রদায়ঃ
আভিজাত ছিল ফ্রান্সের দ্বিতীয় শ্রেণী। অভিজাত শ্রেণী মোট জনসংখ্যার মাত্র 1 থেকে 1.5 শতাংশ । ফ্রান্সের সমগ্র ভূখণ্ডের এক-তৃতীয়াংশ এই অভিজাতদের দখলে ছিল। তারা সরকারকে কোন প্রকার কর প্রদানের পরিবর্তে জনগণের কাছ থেকে জবরদস্তির কর সংগ্রহ করত । তাদের অর্থলিপ্সা সম্পদের অভাব জনগণকে ক্ষুব্ধ করে, যা বিপ্লবের উত্থানে সহায়তা করেছিল
তৃতীয় সম্প্রদায়ঃ
ফ্রান্সের তৃতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল বুর্জোয়া কৃষক ও নগরবাসী,প্রলেতারিয়েত শ্রেণী । ফরাসি জনগণের ৯৭ শতাংশ ছিল তৃতীয় সম্প্রদায়ের সদস্য । প্রথম ও দ্বিতীয় সম্প্রদায়ের মানুষরা তৃতীয় সম্প্রদায়ের মানুষদের ঘৃণার চোখে দেখতো । এরা সব দিক থেকে বঞ্চিত হতে হতে যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেল তখনই বিপ্লবের পথে পা বাড়ালো ।
মূল্যায়নঃ
ফরাসি বিপ্লব গড়ে ওঠার পেছনে যে একাধিক কারণ ছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ । ফরাসি সমাজের বৈশিষ্ট্যযুক্ত তিনটি শ্রেণী ব্যবস্থা বিপ্লবের ফুলিঙ্গ গুলি নিহত ছিল । আর এই ফুলিঙ্গ বিস্ফোরিত হয় আর্থিক সংকটের কারণে । একটি বিপ্লবী আন্দোলনের মাধ্যমে পুরাতন তন্ত্র কে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দেয় ৷