তাইপিং বিদ্রোহের পটভূমি ব্যাখ্যা কর।

তাইপিং বিদ্রোহের পটভূমি ব্যাখ্যা কর।

 তাইপিং বিদ্রোহের পটভূমি ব্যাখ্যা কর।

ধুনিক চিনের ইতিহাসে মধ্য উনিশ শতকে শুরু হয়েছিল বিদ্রোহ ও অভ্যুত্থান পর্ব । আধুনিক ও প্রাক-আধুনিক পর্বের মধ্যে এই বিদ্রোহ হল বিভাজন রেখা ৷ পশ্চিমি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চিন সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিল, বৈদেশিক আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারেনি। অসম্মান ও বিপর্যয়ের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল গোটা দেশ। চিনে আফিমের ব্যবসা বেড়ে চলেছিল, নিঃশেষিত হয়ে যায় তার রৌপ্য ভাণ্ডার। সরকার করভার বাড়িয়ে ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কৃষকদের দুর্দশা বেড়েছিল। রুপোর টাকা টায়েল ও তামার মুদ্রার মধ্যে বিনিময় হার ছিল ১-১০০০। আফিম যুদ্ধের পর তা দু-গুণ হয়ে যায়, অর্থাৎ দু-হাজার তামার মুদ্রা দিয়ে এক টায়েল সংগ্রহ করা যেত । এর ফল হয়েছিল দু-রকম, কৃষকেরা ও দিনমুজরোরা তাম্র মুদ্রায় তাদের মজুরি পেত বা কৃষিজ পণ্য বিক্রি করত । সেই নিরিখে তাদের মজুরি বা দাম অর্থের হয়ে যায়, অপরদিকে তারা উৎপন্ন পণ্যে রাজস্ব দিত দুর্নীতিগ্রস্ত কর্চারীরা তা নগদে রুপান্তরিত করে নিত বেশি হারে, সব মিলিয়ে কৃষকদের দেয় রাজস্বের হার দু-গুন হয়ে যায়।

আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন

উনিশ শতকের মধ্যভাগে চিনে অনেকগুলি বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। ১৮৫১-১৮৬৮ পর্যন্ত চলেছিল নিয়েন বিদ্রোহ, ১৮৫৫-১৮৭৩ পর্যন্ত উনান অঞ্চলে ছিল মুসলিম বিদ্রোহ, উত্তর-পশ্চিমে ১৮৬২-১৮৭৬ পর্যন্ত চলেছিল তুঙ্গান বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহগুলির মধ্যে ব্যাপকতম ও দীর্ঘস্থায়ী হল তাইপিং বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়ে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল, চিনের মোট আঠারোটি প্রদেশের মধ্যে বোলোটিতে তা ছড়িয়ে পড়েছিল, আর ৬০০ শহর তাইপিং বিদ্রোহীরা ফধ্বংস করেছিল। কার্ল মার্কস জানিয়েছেন যে ইংরেজ কামান বলপ্রয়োগে চিনের ওপর নেশার দ্রব্য আফিম চাপিয়ে দিলে বিপ্লবের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল। কোয়াংজুং, কিয়াংসি ও দক্ষিণ হুনান অঞ্চল জুড়ে অশান্তি ও নৈরাজ্য দেখা দিয়েছিল। এর পেছনে অবশ্যই গভীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ ছিল। চিনের সমাজ ও অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। চিনে একটি ধারণা বহুকাল ধরে সচল। ছিল যে শাস্তি ও নৈরাজ্য চক্রাকারে আবর্তিত হয়, এভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা পায়। শান্তির সময়ে জনসংখ্যা বাড়ে, নৈরাজ্য পর্বে জনসংখ্যা কমে যায়, ভারসাম্য রক্ষা পায় ৷ চিনের আগের দেড়শো বছরে আপেক্ষিক শান্তির সময়ে জনসংখ্যা বেড়ে চলেছিল, সেই অনুপাতে কৃষিযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়েনি। ১৭৪১ খ্রিস্টাব্দে চিনের জনসংখ্যা ছিল ১৪৩ মিলিয়ন, ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে তা বেড়ে হয় ৪৩০ মিলিয়ন, বেড়েছিল ২০০%। ঠিক সেই পর্বে কৃষি জমির বৃদ্ধি ঘটেছিল মাত্র ৩৫%। মানুষ ও জমির অনুপাতে এই পরিবর্তনের ফলে কৃষকের চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমেছিল । তাইপিং বিদ্রোহের প্রাক্কালে একজন কৃষকের অধীনে গড় চাষযোগ্য জমির পরিমাণ হল ১.৮৬ মৌ (এক মৌ সমান 1/6একর)¹।

দিনের বেশিরভাগ কুষক চিন দরিদ্র, মহাজনের শোবণের শিকার। জামির ৫০-৬০% মালিকানা ছিল দুঙ্গানী, পথিক, মহাজন ও জুয়ার মালিকদের। ১০% ছিল সৈন্যবাহিনী ও সরকারি কর্মচারীদের, বাকি ৩০% ছিল ৪০০ মিলিয়ন মানুষের। ৬০-১০% মানুষের জমি ছিল না, দরিদ্র কৃষকদের জীবন ছিল দুর্বিষহ, ঝণ করে জীবনযাপন করতে হত। দরিদ্র, প্রান্তিক কৃষক বন্দর-শহরে গিয়ে ঝুলি, মজুর বা নৌকামাঝি হিসেবে কাজ করত, অনেকে বিদেশে পাড়ি দিত, বাকিরা হত বেকার, ভবঘুরে ও দস্যু। চল্লিশের দশকে দক্ষিণের ক্যান্টন বন্দর থেকে বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র পূর্ব উপকূলের মধ্যস্থলে অবস্থিত সাংহাইতে স্থানান্তরিত হয়। এই অঞ্চল থেকে রপ্তানি পণ্য চা ও রেশম সংগ্রহ করার সুবিধা ছিল। ক্যান্টনের অধঃপতন শুরু হলে এই বন্দরের সঙ্গে যুক্ত কুলি, মজুর, দালাল, নৌকামাঝি, মালবাহক শ্রেণীর মানুষ কর্মচ্যূত হয়। এরা বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। চিনে আধুনিক শিল্পায়ন হয়নি, শিল্পে বর্ধিত জনগণের কর্মসংস্থানের কোনো সুযোগ ছিল না। বরং বিদেশ থেকে ভোগ্যপণ্য, বিশের করে সুতিবস্ত্রো, আমদানি হলে দেশের কারিগর ও শিল্পীরা দুর্দশার মধ্যে পড়েছিল, অনেকে জীবিকাচ্যুত হয় এরাই হল তাইপিং বিদ্রোহের উৎস।

দক্ষিণ চিন ছিল তাইপিং আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল। এই অঞ্চলে চিং শাসন অনেক দেরিতে স্থাপিত হয়, পিকিং থেকে অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ায় স্থানীয় শাসন ছিল খুবই দুর্বল, শিথিল। কর আদায় ও শান্তি রক্ষার কাজেও স্থানীয় শাসকেরা ব্যর্থ হয়েছিল। ধনী ও শান্তিপ্রিয় মানুষবাও শান্তি রক্ষার জন্য স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গড়ে তুলেছিল। প্রশাসনিক অযোগ্যতা, দুর্নীতি ও নৈতিক অধঃপতন শাসন ব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করেছিল। দক্ষিণ অঞ্চলের ওপর পশ্চিমি অভিঘাত ছিল বেশি। এই অঞ্চলের মানুষ খ্রিস্টান ধর্ম ও পশ্চিমি সভ্যতার সংস্পর্শে এসেছিল, তাদের চিন্তার জগৎ আলোড়িত হয়েছিল। সরকারি কর্মচারীর। শাসন করত না. শোষণের দিকে বেশি নজর ছিল, যাঁরা সৎ ছিলেন তাঁরা ধর্ম, দর্শন ও সাহিতা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। শাসনের কাজ উপেক্ষিত হত। ৩০০০ টারেল দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের পদ কেনা যেত। সরকারি পদ মর্যাদা ও সম্মান হারিয়েছিল, চিং সৈনাবাহিনীর অবক্ষয় ঘটেছিল, আফিম যুদ্ধে পরাজয় এই বাহিনীর দুর্বলতা প্রকাশ করে দিয়েছিল। সৈন্যবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ছিল না, নেতার আদেশ মানা হত না। গুপ্ত সমিতিগুলি দুর্বল অপদার্থ মাঞ্চুদের বিতাড়িত করে মিং-দের ফিরিয়ে। আনার কথা ভেবেছিল। দক্ষিণের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ছিল গুপ্ত সমিতি, দস্যু ও ধাপরাধ জগতের মানুষের প্রাধান্য। ব্রিটিশ নৌবহর উপকূল অঞ্চল থেকে দস্যুদের বিতাড়িত করলে এরা দেশের অভ্যন্তরে খাঁটি তৈরি করেছিল । এই অঞ্চলে হেডেন অ্যান্ড আর্থ সোসাইটির সদস্যরা (Triad) আত্মরক্ষার জন্য সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গড়ে তুলেছিল। সবল দুর্বলের ওপর অবাধে অত্যাচার চালাত, এই নৈরাজ্য থেকে তাইপিং বিদ্রোহের সূচনা হয় ৷

দক্ষিণ চিনের আর্থ-সামাজিক জীবনে আরও সংকট ছিল। চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে অনেকগুলি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছিল। ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে হোনান প্রদেশে প্রচণ্ড খরা দেখা দিয়েছিল, ইরাংসির বন্যায় ভার প্রদেশ হুপে, আনহুই, কিয়াংসু ও চেকিয়াং ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে কিয়াংসি প্রদেশে দুর্ভিক হয়, আর পীত নদী গতি পরিবর্তন করার ফলে বিশাল অঞ্চল জলমগ্ন হবে পড়েছিল। চিনের লক্ষ লক্ষ মানুষ এইসব প্রাকৃতিক বিপর্যায়ের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হ্যা। সরকার যে সাহায্য দিয়েছিল তা প্রয়োজনের তুলনায় ছিল অপ্রতুল। সরফারি কর্মচারীরা তাণ অর্থের বেশিরভাগ আত্মসাৎ করেছিল। বিষাদ ও হতাশা দরিদ্র মানুষদের-কৃষক, কারিগর, খনি শ্রমিক, কুলি, মজুর, বেকার, গুপ্ত সমিতির সদস্য, কর্মচাত সৈনিক-বিদ্রোহের পথে নিয়ে যায় ৷

দক্ষিণ চিন অঞ্চলে বহুকাল ধরে একটি সামাজিক দ্বন্দ্ব চলেছিল। এখানকার দুটি সামাজিক গোষ্ঠী হল হাকা (কো-চিয়া বহিরাগত) এবং পুষ্টি (পেন-তি-স্থানীয়। হাকাদের সঙ্গে পুন্টিদের জাতিগত ও ভাষাগত মিল ছিল না। হাক। সম্প্রদায়ের মানুষ খ্রিস্টান ধর্মগ্রহণ করলে সংঘাত তীব্রতর আকার ধারণ করেছিল। তাইপিং বিদ্রোহের নেতা হুং শিউ চুয়ান খ্রিস্টান ধর্মগ্রহণ করেছিলেন ৷ দক্ষিণ চিন অঞ্চলে হাক্কারা ছিল আগন্তুক, বিদেশি, এরা ছিল স্বাধীন, সাহসী। কর্মতৎপর। এরা সামান্য কৃষিকাজ, খনির কাজ, কাঠ-কয়লা বিক্রি ইত্যাদি কাজ করে জীবিকানির্বাহ করত। এদের মধ্য থেকে বিদ্রোহীদের বেশিরভাগ এসেছিল, হং-এর মহতী শান্তির স্বর্গরাজোর আন্দোলনের সংঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। কোয়াট্টং অঞ্চলে অগ্নিগর্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। বিদ্রোহী তাইপিং আন্দোলনের জন্য দামী ছিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসন্তোষ, সামরিক শক্তির অধঃপতন, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও দুর্নীতি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং দক্ষিণের সামাজিক পরিস্থিতি। এসবের সম্মিলিত পরিণতি হল তাইপিং বিদ্রোহ।

আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ তাইপিং বিদ্রোহের পটভূমি ব্যাখ্যা কর। এই নোটটি পড়ার জন্য

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟