চীনে বক্সার বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র আলোচনা করো। বা,বক্সার সম্প্রদায়ের উত্থান ও বক্সার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট আলোচনা কর । এর ফলাফল কি হয়েছিল?

চীনে বক্সার বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র আলোচনা করো। বা,বক্সার সম্প্রদায়ের উত্থান ও বক্সার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট আলোচনা কর । এর ফলাফল কি হয়েছিল?
চীনে বক্সার বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র আলোচনা করো।  বা,বক্সার সম্প্রদায়ের উত্থান ও বক্সার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট আলোচনা কর । এর ফলাফল কি হয়েছিল?

চিং রাজবংশের শেষপর্বের ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের বক্সার বিদ্রোহ। উনিশ শতকের নব্বই-এর দশকে চিনের আঠারোটি প্রদেশের প্রত্যেকটিতে ছিল নৈরাজ্য, দাঙ্গা, দস্যুবৃত্তি অথবা স্থানীয় অভ্যুত্থান। নানারকমের গুপ্ত সমিতি ছিল, 'সোসাইটি অব ব্রাদার্স অ্যান্ড এন্ডারস' ও 'বিগ সোর্ড সোসাইটি' হল এদের মধ্যে খুব প্রভাবশালী। দেশে দারিদ্র্য ও হতাশা ছিল, স্থানীয় অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোেধ ছিল। রাষ্ট্র নেতাদের উদ্যোগে প্রতিবাদী মনোভাব বিদেশি ও স্বদেশি খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। বিদেশিদের চিনের সব দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী করা হয়েছিল। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে শত দিবসের সংস্কার আন্দোলনের ব্যর্থতার পরে রাজদরবারে প্রগতিপন্থীরা পরাস্ত হন। ক্ষমতা লাভ করেন কাংয়ির মতো রক্ষণশীলরা। এরা বিধবা সম্রাজ্ঞী জু-সির ওপর প্রভাব বিস্তার করে বিদেশি ও স্বদেশি শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে চিনের কাছে ইতালির আঞ্চলিক দাবিকে নস্যাৎ করে নতুন শাসকগোষ্ঠী বিদেশিদের বিরোধিতা করার নীতি অনুসরণ করতে থাকে।

আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন

ফেয়ারব্যাঙ্ক জানিয়েছেন যে চিনের জাতীয় জীবনে যে সর্বাত্মক অবক্ষয় ও হতাশা দেখা দিয়েছিল তারই পরিণতি হল বক্সার বিদ্রোহ বক্সারদের বেশিরভাগ ছিল কৃষক কিন্তু তাদের নেতারা ছিল ভ্রাম্যমাণ হতাশ সন্ন্যাসী, ফেরিওয়ালা, গণক ও অন্যান্য ধরনের পরিব্রাজক। এরা চিনে স্থানীয় অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিত। বক্সার বা আই হো চুয়ান হল একটি গুপ্ত সমিতির নাম, এরা বিদ্রোহী এইট ট্রাইগ্রাম (Eight Trigrams) সমিতির শাখা ছিল । উনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে সরকারি নথিপত্রে বক্সারদের নাম উল্লেখিত হয়েছে।। এদের অধীনস্থ মিলিশিয়ার নাম হয় আই-হো-চুয়ান। এরা মনে করত দেহ ও মনের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য শারীরিক নানা রীতিনীতি, গুপ্তবিদ্যা ইত্যাদি অনুশীলনের প্রয়োজন হয়। এরা গুপ্ত সাধনার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে অস্ত্রমন্ত্রের সাহায্যে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতালাভ করা সম্ভব। বিদেশিদের উন্নত আগ্নেয়াস্ত তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না ৷ আই হো চুয়ান সমিতির শাখাগুলি শানটুং, চিহলি, শানসি ও মাঞ্চুরিয়ায় প্রভাব বিস্তার করেছিল। গোড়ার দিকে এরা মাঞ্চু-বিরোধী ছিল, মাঞ্চু রাজবংশকে চিনের সব দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী করে একে বিতাড়নের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। শানটুং প্রদেশের রক্ষণশীল গভর্নর লি-পেং হেং এবং পরে ইউ শিয়েন। বক্সারদের পক্ষ নেন। আই হো চুয়ান শব্দের অর্থ হল 'মুষ্টিযোদ্ধাদের ন্যায়পরায়ণ সমিতি' ৷

সমগ্র চিনে সরকারি ও বেসরকারি স্তরে বিদেশি-বিরোধী মনোভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। বুদ্ধিজীবী, সরকারি কর্মচারী, জেস্ট্রি এবং সাধারণ মানুষ সকলে বিদেশিদের চিনের দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী করেছিল। পঞ্চাশ বছর ধরে যুদ্ধ ও শান্তির সময়ে চিন অবমাননার শিকার হয়েছিল। চিনা জাতির আত্মবোধ, সম্মান ও আত্মগরিমা ভয়ংকরভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। চিনে বিদেশিদের মধ্যে ছিল কনসাল, মিশনারি ও বণিকরা, এদের আচরণে চিনারা সকলে অল্প-বিস্তর ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। চিনারা মনে করেছিল তাদের দেশ হল অন্যায় ও উৎপীড়নের শিকার, গড়ে উঠেছিল ব্যাপক বিদেশি ও খ্রিস্টান-বিরোধী মনোভাব। এগুলিকে রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও আর্থ-সামাজিক কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

বক্সার বিদ্রোহের সবচেয়ে বড়ো কারণ হল খ্রিস্টান-বিরোধী মনোভাব। বিদেশিরা জাতরী ও বাইবেল হাতে নিয়ে চিনে এসেছিল, দেশের কনফুসীয়, বৌদ্ধ ও তাও ধর্ম বিপন্ন বোধ করেছিল। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত তিয়েনসিনের সন্ধিতে চিনের অভ্যন্তরে চার্চ স্থাপন করে ধর্মপ্রচারের অধিকার বিদেশিদের দেওয়া হয়। পিকিং কনভেনশনের পর (১৮৬০) বিদেশিরা চিনে জমি কেনার অধিকার লাভ করেছিল। আধুনিক রণতরী ও. অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্য নিয়ে বিদেশি যাজকরা চিনের অভ্যন্তরে ঘুরে বেড়াত, চিনাদের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার জন্য নানাভাবে প্রলোভন দেখাত। চিনারা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলে মিশনারিরা তাদের পক্ষ নিয়ে স্থানীয় বিরোধে হস্তক্ষেপ করত। চিনের গ্রামীণ সমাজের নেতা জেন্ট্রি এদের বিপজ্জনক সামাজিক শক্তি হিসেবে গণ্য করেছিল । ধর্মান্তরিত চিনারা দেবদেবীকে সম্মান করত না, কনফুসিয়াস ও পূর্বপুরুষদের সমাধির সামনে নতজানু হত না, স্থানীয় উৎসব-অনুষ্ঠানে যোগ দিত না। গুপ্ত সমিতির সদস্যরা এদের ওপর আক্রমণ চালাত; হুনান, হপে, কিয়াংসু, সেচুয়ান ও শানটুং অঞ্চলে অনেকগুলি চার্চ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কয়েকজন মিশনারিও নিহত হন | ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মকালে উই ডং চেন নামক একব্যক্তি সেচুয়ান অঞ্চলে এক বিদেশি-বিরোধী অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন। শুধু দক্ষিণের প্রদেশগুলিতে নয়, খ্রিস্টান-বিরোধী মনোভাব উত্তরের প্রদেশগুলিতেও ছড়িয়ে পড়েছিল ৷

চিনের বিভিন্নস্থানে খ্রিস্টান-বিরোধী প্রচার চলেছিল। প্রচারের বিষয় ছিল তিনটি-বিদেশিরা চিনের দেব-দেবীদের অসম্মান করেছে, সম্রাট ও শাসকদের প্রতারণা করেছে আর দেশের সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে ৷ এধরনের বিদ্রোহে গুজব একটি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে থাকে। গুজব রটেছিল চিনে দশটি বিপর্যয় আসছে, এদের একটি হল বিদেশি ও তাদের সহযোগী ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানরা। খ্রিস্টান-বিরোধীরা প্রচার করত যে চার্চের মধ্যে নানা ধরনের গুপ্ত অনৈতিক সাধন-ভজনের কাজ চলে । ইমানুয়েল সু জানাচ্ছেন যে প্রথাগত ধর্ম বিরোধী খ্রিস্টান ধর্ম চিনে বিদেশি বিরোধিতায় পর্যবসিত হয় ৷

উনিশ শতকের চিন ছিল পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদের শিকার। পশ্চিমি দেশগুলি চিনের বিভিন্ন অঞ্চল অধিকার করে প্রভাবাধীন অঞ্চল গঠন করেছিল। অতিরাষ্ট্রিক অধিকার, সর্বাপেক্ষা অনুগ্রহীত দেশের মর্যাদা বা শুল্ক সংক্রান্ত সুযোগসুবিধা আদায় করে নিয়েছিল। এই প্রক্রিয়া সারা উনিশ শতক ধরে চলেছিল, শতকের শেষ বছরগুলিতে চিনের জনমানসে এর গভীর প্রভাব পড়েছিল। চিনের মাঞ্চু শাসকগোষ্ঠীও ধরে নিয়েছিল চিনের স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়েছে । ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১৭ এপ্রিল ন্যাশনাল প্রটেকশন সমিতির সভায় প্রিন্স কাং এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন যে ব্রহ্মদেশ, আন্নাম, ভারত ও পোল্যান্ডের মতো চিনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে চলেছে। প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা সংস্কারের মাধ্যমে চিনকে শক্তিশালী করার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু রক্ষণশীলরা বেশিরভাগ ছিলেন অজ্ঞ। আন্তর্জাতিক রাজনীতি তারা বুঝত না, তারা মনে করেছিল বিদেশিদের ধ্বংস করে চিনকে বৈদেশিক আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা থেকে রক্ষা করা যাবে। বিদেশিদের সবকিছু চিনারা অপছন্দ করেছিল। তাদের স্থাপিত রেলপথ, ডাক ও তার ব্যবস্থা, ধর্ম, চার্চ, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান সবকিছু বক্সার আক্রমণের শিকার হয়েছিল। গণসার্বভৌমত্বের এক অস্পষ্ট রূপ চিনা ঐতিহ্যে লক্ষ করা যায়। কনফুসীয় মতবাদের মধ্যে এর বীজ নিহিত আছে ৷ চিনের শাসকগোষ্ঠী এই পশ্চিমি খ্রিস্টান-বিরোধী জনমতকে মাঞ্চু রাজবংশ ও চিনকে রক্ষার উপায় হিসেবে গ্রহণ করেছিল। বিদেশি-বিরোধী মাঞ্জু শাসক ও বক্সারদের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য স্থাপিত হয়। প্রাদেশিক শাসকরা যেমন উশিয়েন (শানটুং) বক্সারদের বিদেশি-বিরোধিতায় উৎসাহ দেন, বক্সারদের মধ্য থেকে স্থানীয় বাহিনী গঠন করেন ৷

বক্সার বিদ্রোহের আসল কারণ হল পশ্চিমি আগ্রাসনের ফলে চিনের আর্থ-সামাজিক দুর্দশা, দারিদ্র্য ও হতাশা। আফিম যুদ্ধের পর চিনের বাজারে বিদেশি সস্তা পণ্য অবাধে প্রবেশ করেছিল। চিন সংরক্ষণ শুল্ক চাপিয়ে নিজের দেশের হস্ত ও কুটির শিল্পকে রক্ষা করতে পারেনি। বিদেশি সুতিবস্ত্র চিনে উৎপন্ন সুতিবস্ত্রের এক-তৃতীয়াশ মূল্যে বাজারে বিক্রি হত। দেশের তাঁতি ও কারিগররা দুর্দশার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়, বহু তাঁতি, কারিগর ও হস্তশিল্পের মালিক জীবিকাচ্যুত হয়েছিল। তাইপিং বিদ্রোহের সময় শিল্পী ও কারিগরদের দুর্দশা বেড়েছিল, খাদ্যাভাব, অনশন ও দুর্বিষহ জীবন বহু মানুষকে অপরাধ জগতের দিকে নিয়ে যায়। অনেকে দস্যুবৃত্তি গ্রহণ করেছিল, ভবঘুরে ও ভিখারির সংখ্যা বেড়েছিল। ভাগ্যহত চিনারা তাইপিং বিদ্রোহীদের মদতদাত্য খ্রিস্টান বিদেশিদের তাদের দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী করেছিল। তাইপিং বিদ্রোহের পর চিনের বাজারে আরও বেশি বিদেশি পণ্য এসেছিল, আত্মশক্তি বৃদ্ধির যুগে (১৮৬১-১৮৯৫) চিনে বিদেশি পুঁজিপতিরা আধুনিক শির স্থাপনে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। শিল্প-বাণিজ্য থেকে রাষ্ট্রীয় আয় কমে যায়, আম ছিল ৮৯ মিলিয়ন টায়েল, ব্যয় ১০১ মিলিয়ন, ১২ মিলিয়ন ঘাটতি। চিনের প্রধান রপ্তানি পণ্য চায়ের রপ্তানি কমেছিল, ভারত, সিংহল ও জাভার চা ছিল আন্তর্জাতিক বাজারে চিনের প্রতিদ্বন্দ্বী। এই ঘাটতি পূরণ করার জন্য সরকার জনগণের ওপর বাড়তি কর বসাতে বাধ্য হয়েছিল। এই আর্থ-সামাজিক পটভূমিকায় চিনে গুপ্ত সমিতির সংখ্যা ও দস্যুবৃত্তি ক্রমশ বাড়তে থাকে।

চিনে আরও আর্থ-সামাজিক সংকট ছিল। উনিশ শতকের শেষদিকে চিনে। যেহারে জনসংখ্যা বেড়ে চলেছিল সেহারে কৃষিজমি বাড়েনি। জনসংখ্যা বেড়েছিল দুই দশকে (১৮৭৩-৯৩) ৮ শতাংশ, চাষজমি বেড়েছিল মাত্র ১ শতাংশ। কৃষির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়, জমির চাহিদা অত্যধিক বেড়েছিল। কৃষিতে পুঁজির সরবরাহ ছিল খুবই কম, এক্ষেত্রে কোনো সরকারি উদ্যোগ ছিল না। উন্নত বীজ, সার ও সেচের সাহায্যে কৃষিজ উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা হয়নি। ভাগচাষি বা বর্গাদারদের অবস্থা ছিল খুব শোচনীয়। উৎপাদনের ৮০ শতাংশ পর্যন্ত জমির মালিককে খাজনা হিসেবে দিতে হত। কৃষকরা ছিল ঋণগ্রস্ত, অল্পদিনের মধ্যে ভূমি হারিয়ে ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হত। এর পাশাপাশি ছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয়। পীত নদী গতি পরিবর্তন করে মাঝে মাঝে বন্যা নিয়ে আসত। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে শানটুং অঞ্চলে বন্যার ফলে কমপক্ষে দশ লক্ষ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেচুয়ান, কিয়াংসি, কিয়াংসু ও আনহুই প্রদেশে বন্যা হত। বন্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল উত্তর চিনের ভয়ংকর খরা। এইসব প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে পশ্চিমিদের কার্যকলাপের অভিশাপ হিসেবে গণ্য করা হত। প্রচার করা হত বিদেশি খ্রিস্টানদের কার্যকলাপের জন্য চিনের দেবদেবীরা ক্রুদ্ধ হয়েছেন, ড্রাগন শিরায় আঘাত লেগেছে। রেলপথ স্থাপনের সময় ডিনামাইট দিয়ে পাথর ফাটিয়ে পথ নির্মাণ করা হয়, এভাবে খনি থেকে ধাতব দ্রব্য উত্তোলনের ব্যবস্থা হয়েছিল। এসব কারণে মনে করা হয় চিনের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে হলে পশ্চিমি খ্রিস্টানদের বিতাড়ন করা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।

বিদেশিদের বিরুদ্ধে চিনের মানুষের আরও অনেক ক্ষোভ ছিল। চিন-জাপান যুদ্ধের পর (১৮৯৫) জাপান চিনে প্রবেশ করে উত্তরাঞ্চলে তাণ্ডব চালিয়েছিল, বিশাল অঙ্কের অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে আদায় করেছিল। ক্ষতিপূরণের অর্থ সংগ্রহ করতে কর বাড়াতে হয়েছিল, শানটুং প্রদেশকে ৯০,০০০ টায়েল অধিক কর দিতে বলা হয়। শানটুং ছিল কনফুসিয়াসের জন্মস্থান, এখানে বিদেশিদের কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেয়েছিল। বক্সাররা শানটুংকে তাদের প্রধান খাঁটি হিসেবে গড়ে তুলেছিল। এখানে খ্রিস্টান মিশনারি ও তাদের চিনা অনুগামীদের ওপর আক্রমণের অভিঘাত ছিল সবচেয়ে বেশি। বিদেশিরা চিনে রেলপথ স্থাপন করলে নৌ ও স্থল পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত বহু নৌকামাঝি, গাড়োয়ান, বণিক, হোটেল মালিক ও মালবাহক জীবিকাচ্যুত হয়। দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে প্রসারিত ছিল চিনের মহাখাল এবং হ্যাংকাও থেকে পিকিং পর্যন্ত স্থলপথ। এই দুই জাতীয় পথের সঙ্গে যুক্ত সকলে কর্মহীন হয়ে দুর্দশার মধ্যে পড়েছিল ৷ চিনে পুরনো সভ্যতায় কুসংস্কার ছিল, ছিল অর্থনৈতিক মন্দা ও বিপর্যয়, জনগণ দুর্দশার মধ্যে পড়েছিল। জনগণ পশ্চিমিদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও মিশনারিদের কার্যকলাপ একেবারেই পছন্দ করেনি। এই পটভূমিকায় ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মকালে ঘটে গেল এক ধরনের জাতীয় উন্মত্ততা, ব্যাপক হানাহানি ও রক্তপাতের ঘটনা।

আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন

চীনে বক্সার বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র আলোচনা করো।  বা,বক্সার সম্প্রদায়ের উত্থান ও বক্সার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট আলোচনা কর । এর ফলাফল কি হয়েছিল?

চীনে বক্সার বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র আলোচনা করো।  বা,বক্সার সম্প্রদায়ের উত্থান ও বক্সার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট আলোচনা কর । এর ফলাফল কি হয়েছিল?

মাঞ্জু রাজবংশের শেষ পর্বের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল 1899 -1901 খ্রীস্টাব্দের বক্সারের বিদ্রোহ । 1895 খ্রীঃ ক্ষুদ্র রাষ্ট্র জাপানের হাতে চীনের পরাজয় 1837- ১৪ খ্রীঃ নাগাদ পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ দ্বারা চীনের বিভাজন, খ্রীষ্টান মিশনারীদের কার্যকলাপের সাখে দেশের আর্থ- সামাজিক ব্যাকলার অবনতি বক্সার বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে জনগনের খোভের প্রকাশ ঘটে। ঐতিহাসিক জ্যাক প্লে বক্সার বিদ্রোহের মধ্যে বিদেতিপ বিরোধীতার সুর খুঁজে পেয়েছেন। আবার হ্যাঁ সেনো 'বলেছেন বক্কার অভ্যুত্থান ছিল চীনের একটি জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়া এবং খ্রীস্টান মিশনারি ও ধর্মান্তরিত চীনা খ্রিস্টানদের বিষ্ণুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্কে চীনাদের যে হাত। শোনো বক্কার বিদ্রোহকে গুপ্ত সমিতির নেতৃত্বাধীন একটি কৃষক বিদ্রোহ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। স্পেয়ার ব্যাঙ্ক আবার মনে করেন. বক্সার বিদ্রোহ ছিল চীনের অভ্যন্তরীণ সংকটের প্রতিক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট একটি প্রত্যয় সংগ্রাম ৷

আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন

বক্সার বিদ্রোহে অংশগ্রহনকারীদের অধিকাংশই ছিলেন (70%) কৃষক পরিবার ভুক্ত। এরা অধিকাংশই ছিলেন ক্ষেতমজুর এবং এদের বয়স ছিল 12-18 বছরের মধ্যে। চীনা মাঝি, ফেরিওয়ালা, কুরি, বেকার হস্তশিল্পী, ছোটো দোকানদার, স্কুল শিক্ষক প্রমুখরা এই বিদ্রোহে অংশ গ্রহন করেন, যাদের অধিকাংশই ছিল দরিদ্র শ্রেণীভুক্ত। পিকিং রাজসভায় বিদ্রোহীদের সমর্থনের পর ছেন্টিরাও বক্সারদের মদত দিয়েছিলেন। এছাড়াও বক্কার বিদ্রোহে নারীদের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, বক্সার বিচোছে ৷

অংশগ্রহনকারী নারীরা কয়েকটি সংগঠনে বিভক্ত ছিলো ৷

  1. লাল লন্টন বাহিনী (12-18 বছর বয়সী নারীদের সংগঠন)।
  2. নীল লণ্ঠন বাহিনী (মধ্য নয়সী গৃহবন্ধুদের সংগঠন)
  3. কালো লন্ঠন বাহিনী (বয়স্ক গৃহবধূদের সংগঠন)
  4. সবুজ লণ্ঠন বাহিনী (বিধবা নারীদের সংগঠন)। জদের মধ্যে আালে লন্ঠন বাহিনী ছিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ।

বক্সার বিদ্রোহের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল খ্রিস্ট ধর্ম ও বিদেশি বিরোধীতা। প্রথম দিকে এই বিদ্রোহ ছিল মাঞ্জু রাজবংশ ও বিদেশি বিরোধী এই পর্বে বিদ্রোহীদের শ্লৈাগান ছিল- 'চিং বংশকে উৎখাত করো এবং বিদেশীদের হত্যা করো। চীনের রাজশা ও বিধবা রানী বিদ্রোহিদের সমর্থন করলে বক্সাররা স্লোগান পরিবর্তন করে। 'টিং বংশকে সমর্থন করো এবং বিদেশিদের ধ্বংশ করো' তাদের স্লোগান হয়ে ওঠে। বিদ্রোহের গোড়ার দিক থেকেই টেলিগ্রাম, রেল ব্যাবসা প্রভৃতির দ্বারা উৎস করতে শুরু করে। খ্রীস্টান গির্জা এক বিদেশিদের বাম বাসস্থানে তারা আগুন লাগিয়ে দেয় ফিপনারি ও ধর্মান্তরিতদের তারা হত্যা করে। বিদেশি বিরোধিতা আপা-গোড়া বক্কার বিদ্রোহের মূল চালিকা শক্তি ছিল। ছি. তন স্টাইগারের মতে পাক্ষ পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদীদের বিরোধে পোভী খ্রিস্টান বিরোধিতার রূপ গ্রহন করে। এই বক্তব্য আংশিক সত্য। রক্ষণশীল চীনা বুদ্ধিজীবীরা প্রচার করেছিলেন খ্রিস্টধর্মের অশুভ প্রভাবই চীনের সংকটেজের জন্য প্রধানত দায়ী। খ্রিস্টান মিশনারীদে চীনাদের প্রতি দুর্ব্যাবহার চীনাদের স্বাভাবিকভাবে খ্রিক্ষাগার বিরোধী করে তুলেছিল,

ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের একাটি অঙ্কন বক্সার বিদ্রোহকে একটি প্রতিক্রিয়াশীল অভ্যুত্থার বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু গনপ্রজাতন্ত্রীদের চীনের ঐতিহাসিকরা বক্সার বিদ্রোহকে দেশপ্রেমিক চীনাদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম হিসাবে চিহ্নিত করেছে। এপস্টাইন মত প্রকাশ করেছেন বক্লশর অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে চীনের সাধারণ মানুষ একদলন্ত তিল সংস্কৃতি বোধসদ্বীপ বোধসম্পন্ন দম্য? যারা তাদের ত দেশকে বিভাজিত করে গ্রাস করতে চেয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে দেশ প্রেমের ভিত্তিতে লড়াই পরিচালনা করেছিলেন। মার্কিন ঐতিহাসিক মার্ক টোয়েন 'সভ্যতার তথাকথিত রক্ষক' সাম্রাজ্যবাদী সত্যিপুলির বিরুদ্ধে বক্সারদের সংগ্রাম -কে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।

ঐতিহাসিক এরিক হবসম বক্সার বিদ্রোহকে একটি সামাজিক আন্দোলন বলেছেন। বক্সার বিদোহিরা অলৌকিক ধর্মীয় বিশ্বাস, জাদুবিদ্যা, মুষ্টি যুদ্ধের অনুশীলন প্রভৃতির দ্বারা সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে। বিদ্রোহীদের অধিষ্কাঞ্চনই কৃষক বিদ্রোহ থেকে আমলেও এবং চীনের কৃষি সংকট বিদ্রোহকে তরান্বিত করলেও বক্সারদের ভূমি সংস্কারের বিষয় কোনো সুষ্পষ্ট কর্মসূচী গ্রহন করতে দেখা যায়নি। জদিক থেকে বক্সার বিদ্রোহকে পুরোপুরি কৃষক বিদ্রোহের পর্যায়ভুক্ত করা যায়না। আবার চীনের কমিউনিস্ট পার্টি অবশ্য বরুণর বিদ্রোহের মূল্যায়ন করতে গিয়ে এটিকে একটি স্বতঃ পূর্ত কৃষক বিদ্রোহ বলেছেন। বক্সার বিদ্রোহীদের মতাদর্শগত জুটি ছিল ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর তারা অধিক গুরুত্ব দিয়েছিল। লেনিন সহ সমসাময়িক বিশ্বের বহু উদার ও গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন মানুষ বক্কার বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের থেকে বক্কার বিজয়ী বিদ্রোহীরা গৌরবময় ভূমিকা পালন করেছিলেন।

আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟