শিবাজীর অধীনে মারাঠা প্রশাসনের প্রকৃতি লেখ। অথবা,শিবাজীর অধীনে মারাঠা প্রশাসন সম্পর্কে আলোচনা কর
![]() |
শিবাজীর অধীনে মারাঠা প্রশাসন :-
মহারাষ্ট্রে মারাঠা শক্তির অভ্যুত্থান ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি বিশেষ গুরুত্বপর্ণ অধ্যায়। আর একাজে দক্ষতা দেখিয়ে ছিলেন শিবাজী। গ্রান্ড ডাফ্ মারাঠাদের উত্থানকে 'দাবানলের মতো আকস্মিক ও স্বল্পস্থায়ী' একটি ঘটনা বলে উল্লেখ করলেও অন্যান্য বহু ঐতিহাসিক মারাঠা শক্তির অভ্যুত্থানের মধ্যে একটি পারম্পর্য, ধারাবাহিকতা ও উদ্দেশ্য লক্ষ্য করেছেন। জি. এস সরদেশাই-এর মতে, ভারতব্যাপী হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপন করাই ছিল শিবাজীর চূড়ান্ত লক্ষ্য। তা ছাড়া শিবাজীর বহু পূর্বেই মারাঠাজাতির জাগরণ শুরু হয়েছিল। শিবাজী সেই জাগরণকে পূর্ণতা দিতে সচেষ্টা হয়েছিলেন।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
শিবাজীর অধীনে মারাঠা শাসনব্যবস্থার কয়েকটি মৌলিক দিকের কথা ঐতিহাসিক সরদেশাই উল্লেখ করেছেন। *তিনি মুঘল জাগীর প্রথার দুর্বলতা লক্ষ্য করেন। এজন্য তিনি কর্মচারীদের বেতনের পরিবর্তে জাগীর দান নিষিদ্ধ করেন। #pdpg07 *তিনি যে অষ্ট প্রধান বা ৮ জন মন্ত্রীর মধ্যে দপ্তর ভাগ করেন, তা ছিল তাঁর নিজস্ব উদ্ভাবন। *তিনি সেনাদলে যে আচরণ বিধি চালু করেন তাতেও তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ দেখা যায়। চৌথ আদায় ছিল তাঁর একটি বিশেষ উদ্ভাবন। এই প্রথার দ্বারা তিনি অর্থ সঙ্কট দূর করেন। *শিবাজী তাঁর দুর্গগুলিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত করেন। তাঁর দুর্গ গঠন ও তার পরিচালনা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছিল।
সরকারি কর্মচারী নিয়োগের দায়িত্ব ছিল শিবাজীর নিজের হাতে। এ বিষয়ে তিনি খুব সচেতন ছিলেন। সামন্ত-প্রভুদের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য তিনি বংশানুক্রমিক জায়গির-প্রথা তুলে দেন এবং জেলায় জেলায় সরকারি কর্মচারী নিযুক্ত করেন। ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করার জন্য এইসব নিয়োগ বদলিযোগ্য করা হয়। অষ্টপ্রধান ছাড়াও তিনি চিটনিস, মজুমদার, সুবনিস, পাটনিস, দেওয়ান প্রভৃতি বহুশ্রেণির কর্মচারী নিযুক্ত করেন।
মারাঠা শাসনব্যবস্থায় রাজা ছিলেন সার্বভৌম, ক্ষমতার অধিকারী। অষ্টপ্রধান নামক আটজন মন্ত্রীর এক পরিষদ বিভিন্ন বিষয়ে শিবাজীকে সহায়তা করতেন। এঁরা হলেন-(১) পেশোয়া- যিনি ছিলেন মন্ত্রিপরিষদের প্রধান এবং সামগ্রিকভাবে রাজ্যের সব বিভাগের তত্ত্বাবধান করতেন। (২) অমাত্য- ছিলেন অর্থমন্ত্রী, রাজ্যের আয়-ব্যয়ের হিসাব তিনি রাখতেন।(৩) ওয়াকিনবিস - রাজার প্রাত্যহিক কাজকর্ম ও দরবারের ঘটনাবলী নথিবদ্ধ করে রাখতেন। (৪) সচিব- সরকারি নথিপত্র লিপিবদ্ধ করতেন। (৫) সুমন্ত - এর কাজ ছিল রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা। (৬)পণ্ডিত রাও- ধর্ম বিষয়ে ও সরকারি দান- ক্ষয়রাতের বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। (৭) সেনাপতি- : ছিলেন সৈন্যবাহিনীর প্রধান এবং (৮) ন্যায়াধীশ বা . কাজি-উল-কাজাৎ- বিচারবিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন। ন্যায়াধীশ এবং পণ্ডিতরা ছাড়াও অন্যান্য মন্ত্রীদের সামরিক কর্তব্য পালন করতে হত।অষ্টপ্রধানদের 'রাজমণ্ডল' বলেও অভিহিত করা হত।
শিবাজী তাঁর রাজ্যকে সুশাসনের জন্যে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেন। যে অঞ্চলে শিবাজীর প্রত্যক্ষ শাসন ছিল তার নাম ছিল স্বরাজ্য। এই স্বরাজ্যকে কয়েকটি 'প্রান্ত' বা জেলায় বিভক্ত করা হয়। এই জেলার প্রান্তগুলিকে নিয়ে ৩টি প্রদেশ গড়া হয়। প্রতি প্রদেশের দায়িত্ব একজন দায়িত্বপূর্ণ শাসনকর্তার হাতে দেওয়া হয়। উত্তর প্রদেশে মোবোম্বিক পিংলে দক্ষিণে আন্নাজি দাত্তো, দক্ষিণ-পূর্ব প্রদেশে দত্তাজি পন্থকে শাসনকর্তা নিয়োগ করা হয়। স্বরাজ্যের বাইরে : কিছু অংশ শিবাজীর সাম্রাজ্যভুক্ত হলেও সেখানে প্রত্যক্ষ শাসন ছিল না। প্রান্ত বা জেলাগুলিকে পরগনায় ভাগ করা হয়। কিছু সংখ্যক গ্রাম নিয়ে তরফ গড়া হত। প্রান্তের শাসনকর্তাকে বলা হত মামলতদার। তরফের শাসনকর্তার নাম ছিল হাবিলদার বা কারকুন। গ্রামগুলিতে দেশপাণ্ডে বা দেশমুখিয়া বা প্যাটেলরা শাসন করত। গ্রামসভা সাধারণতঃ গ্রামের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিত। সেই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করা ছিল দেশপাণ্ডের দায়িত্ব।
রাজ্যের সমস্ত জমি জরিপ করে উৎপন্ন ফসলের ৩০% রাজস্ব ধার্য হয়। পরে এই পরিমাণ বাড়িয়ে ৪০% করা হয়। শস্যে অথবা নগদ অর্থ রাজস্ব দেওয়া যেত। ফ্রায়ার শিবাজীর রাজস্বব্যবস্থাকে 'শোষণের নামান্তর' বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এ কথা ঠিক নয়। কারণ রাজস্বের এই হার পূর্বেও প্রচলিত ছিল। তা ছাড়া রাজস্ব আদায়ের জন্য শিবাজী অত্যাচার করতেন, -এ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং কৃষির উন্নতির জন্য তিনি সরকারি কোষাগার থেকে ঋণদানের (তকাবি) ব্যবস্থা করেছিলেন।
শিবাজী প্রতিবেশী অঞ্চল, মুঘল-অধিকৃত রাজ্য বিজাপুরের কোনো কোনো অঞ্চল থেকে 'চৌথ' ও 'সরদেশমুখী' নামে দু-প্রকার কর আদায় করতেন। চৌথ ছিল রাজস্বের এক-চতুর্থাংশ এবং সরদেশমুখী ছিল এক- দশমাংশ। এই করকে কোনো কোনো ঐতিহাসিক 'রক্ষা-কর' বলে অভিহিত করেছেন। কারণ মারাঠা বর্গী-আক্রমণের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার শর্তে প্রতিবেশী রাজ্য এই কর প্রদান করত। পণ্ডিতেরা এই কর আদায়ের নিন্দা করেছেন। কারণ প্রতিবেশী রাজ্যে এই ধরনের কর আদায় নীতিগতভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। এ ছাড়া বণিকদের কাছ থেকে আদায়ীকৃত 'মহাতরফা এবং বিভিন্ন বাজারে ক্রয়- বিক্রয়ের উপর নির্ধারিত 'জাকাৎ' নামক শুল্ক থেকেও শিবাজী কিছু অর্থ সংগ্রহ করতেন। ভিনসেন্ট স্মিথের মতে, চৌথ ছিল প্রকার দস্যুকর। অপর দিকে এই করের সমর্থনে বলা হয় যে, মহারাষ্ট্র ছিল অনুর্বরা অঞ্চল। এর চারদিকে ছিল শত্রু। সুতরাং আত্মরক্ষার জন্যে সেনা ও দুর্গ রাখতে প্রচুর অর্থ লাগত। ঔরঙ্গজেব নিরন্তর মহারাষ্ট্রে আক্রমণ চালালে আত্মরক্ষার জন্যে সৈন্য রাখতে হয়। যেহেতু মহারাষ্ট্রের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয় সেহেতু মহারাষ্ট্র শত্রু দেশ হতে চৌথ আদায় করতে বাধ্য হয়। চৌথ আদায় করতে বাধ্য।
শিবাজীর অধীনে এক সুবিশাল, সুসংগঠিত ও সুশিক্ষিত সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে। তাঁর সেনাবাহিনীতে একটি পদাতিকবাহিনী থাকলেও, আসল শক্তি ছিল তাঁর অশ্বারোহী বাহিনী । পার্বত্য অঞ্চলে এবং গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধের কারণ এই দ্রুতগামী অশ্বারোহী বাহিনী ছিল অপরিহার্য । মারাঠা অশ্বারোহীবাহিনী 'পাগা বা বর্গী' এবং 'শিলাদার'-এই দু'ভাগে বিভক্ত ছিল। বর্গীরা ছিল সরকারি স্থায়ী সৈন্য। এদের অশ্ব, অস্ত্র, পোশাক বিভক্ত ছিল। এদের অশ্ব, পোশাক ও নিয়মিত বেতন সরকার থেকে দেওয়া হত। কিন্তু শিলাদাররা ছিল ভাড়াটে সৈন্য। এরা নিজেরাই অশ্ব ও মুক্ত করত। মুক্তের প্রয়োজনে এরা নগদ অর্থের বিনিময়ে সরকারকে সাহায্য করত।
শিবাজীর ২৪০-২৮০টি দুর্গ ছিল। আত্মরক্ষার জন্যে তিনি দুর্গগুলিকে বিশেষভাবে ব্যবহার করেন। দুর্গে হাবিলদার, সবনীশ ও সর-ই-নৌবত এই তিন প্রধান কর্মচারী ছিল। সরনীশ ছিল ব্রাহ্মণ বংশীয়, অপর দুই জন মারাঠা। হাবিলদার দুর্গের দরওয়াজা রক্ষা, দুর্গ রক্ষীদের নিয়ন্ত্রণ, দুর্গের নিরাপত্তার দিকটি দেখত। সর-ই- নৌবত রাত্রিকালে দুর্গের পাহারার তদারকি করত । সবনীশ দুর্গে শান্তিরক্ষা, খাদ্য সরবরাহ, নিকটস্থ গ্রাম থেকে খাজনা আদায়ের কাজ দেখত।
শিবাজীর বিচারব্যবস্থা তেমন উন্নত ছিল না। শিবাজী কোন বিচার বিভাগ বা স্থায়ী আদালত স্থাপন করেননি। গ্রামের বিচার, পঞ্চায়েত সভাগুলি নিষ্পত্তি করত। ফৌজদারী মামলার বিচার গ্রাম প্রধান বা প্যাটেল করত। ন্যায়াধীশ আপীলের বিচার করতেন। হাজির মজলিশে আপীলের বিচার হত।
শিবাজীর অধীনে মারাঠা শাসনব্যবস্থার কয়েকটি সহজাত ত্রুটি ধরা পড়ে। এই শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিপরিষদ প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্যে যুক্ত না থেকে মূলত পরামর্শদাতার কাজ করত। এর ফলে শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি রাজার ব্যক্তিগত দক্ষতার উপর নির্ভরশীল ছিল। তাই শিবাজীর পরে তাঁর দুর্বল বংশধরদের সময়ে এই ব্যবস্থা কার্যকরী হয়নি। তিনি ব্রাহ্মণদের অতিরিক্ত প্রাধান্য দিয়ে মহাভুল করেন। তাঁর মন্ত্রিসভার ৮ জন মন্ত্রীই ছিলেন ব্রাহ্মণ। এদের হাতে " প্রচুর ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে রাজ্যের সংহতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৬জন মন্ত্রীকেই বেসামরিক ও সামরিক উভয় দায়িত্ব পালন করতে হত। ফলে এঁরা ক্ষমতা লোভী হয়ে পড়েন। পরবর্তীকালে পেশোয়াই মারাঠা রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রধান হয়ে পড়েন। তাঁর রাজস্বব্যবস্থা শোষণের নামান্তর ছিল বলে অনেকের ধারণা। তাঁর রাজস্ব-কর্মচারীরা ছিল স্বার্থপর । তা ছাড়া চৌথ ও সুরদেশমুখী জবরদস্তি কর আদায়কে অধিকাংশ ঐতিহাসিক সমর্থন করেননি। তিনি জায়গির প্রথা তুলে দিতে চাইলেও, তার কুফল থেকে মুক্তি পাননি। জাতীয় সংহতি সুদৃঢ় করার কোনো সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা শিবাজী নিতে পারেন নি।