ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা কর
ত্রিশবছরব্যাপী যুদ্ধ ১৬১৮-১৬৪৮ খ্রি: দীর্ঘমেয়াদি সংঘটিত একটি অনুক্রমিক যুদ্ধ। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ইউরোপে প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিকদের মধ্যে এই যুদ্ধ সংগঠিত হয়। ধর্মই এই যুদ্ধের একমাত্র কারণ ছিলো তা নয়, বরং ধর্ম এবং রাজনীতি উভয় কারণে এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে এটি একটি আন্তর্জাতিক যুদ্ধে পরিণত হয়। এই যুদ্ধে প্রোটেস্টান্ট এবং ক্যাথলিক উভয়েই তাদের নিজস্ব শক্তি বজায় রেখে এগিয়ে যেতে থাকে।
ত্রিশবছরব্যাপী যুদ্ধের কারণ
ত্রিশবছরব্যাপী যুদ্ধের কারণ হিসেবে প্রধানত ধর্মীয় অসন্তোষকেই চিহ্নিত করা হয়। এই যুদ্ধ প্রোটেস্টান্ট এবং ক্যাথলিকদের পারস্পরিক বিবাদের ফলে সংগটিত হয়। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমদিকে জার্মানি ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্টান্ট এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। উভয় সম্প্রদায়ই চরম অনমনীয় ও আপোষহীন মনোভাব পোষণ করে এবং তত্মঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ইউরোপ সপ্তদশ শতাব্দীতে ধর্মীয় যুদ্ধে বা দ্বন্দে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলো। ১৫৫৫ সালে সম্পাদিত আগর্সবার্গের চুক্তি রোমান সাম্রাজ্যের অমীমাংসিত ইস্যুসমূহের সম্মানজনক মীমাংসা করতে পারেনি।
প্রথমত, এই শান্তিচুক্তি কেবলমাত্র ক্যাথলিক এবং লুথারবাদীদের স্বীকৃতি দিলেও ক্যালভিনপন্থীদের স্বীকৃতি দেয়নি। অথচ ১৬ শতাব্দীর শেষার্ধে সমগ্র ইউরোপে ক্যালভিনপন্থীদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে।
দ্বিতীয়ত, "এক্লেসিয়াসটিক্যাল রিজারভেশন" নীতি গ্রহণের মাধ্যমে চার্চের সম্পত্তিকে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব করার যে নীতি প্রোটেস্টান্টরা সর্বত্র অগ্রাহ্য করে। দুপক্ষই এর ফলে ক্ষিপ্ত হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে উনন্মত্ত হয়ে উঠে।
তৃতীয়ত, এই শান্তি চুক্তিটি "রাজার ধর্মই প্রজার ধর্ম" নীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিলো। অর্থাৎ ইউরোপের রাজারা যে ধর্মাবলম্বী হবেন প্রজারাও হবে সেই ধর্মের অনুসারী। যে সব রাষ্ট্রে প্রোটেস্টান্ট রাজা শাসন করতো লুথারবাদ সেই এলাকার রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে, আবার ক্যাথলিক রাজ্য শাসিত অঞ্চলে ক্যাথলিক ধর্ম স্বীকৃতি পায়। এই নীতির সুবাদে রাজারা তাদের ভিন্নধর্মী প্রজাদের উপর অত্যাচার করার সুযোগ পায়। ক্যাথলিক রাজাগণের অধীনে প্রোটেস্টান্টগণ এবং প্রোটেস্টান্ট রাজাগণের অধীনে ক্যাথলিকগণ অত্যাচারিত হতে থাকে। এই নির্যাতন ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্টান্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে।
এভাবে জার্মানি আর্গসবার্গ চুক্তির পর থেকেই ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়। ধর্মীয় আন্দোলন জনজীবনে নতুন যুগের সম্ভাবনাকে খুলে দেবার পরিবর্তে জার্মানিতে বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রটপের অন্ত:কলহ মাত্মক রূপ ধারণ করে। জার্মানি এই সময় ক্যাথলিক, প্রোটেস্টান্ট এবং ক্যালভিনিস্ট তিনটি পরস্পর বিবাদমান ধর্মালম্বী এট্রপে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তবে শুধু ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্টান্টদের মধ্যেই ধর্মীয় দ্বন্দ্ব বিরাজমান ছিলো না, বরং প্রোটেস্টান্ট গ্রুপসমূহের মধ্যে অর্থ দ্বন্দ্ব এবং বিরোধও ছিলো তুঙ্গে।
জার্মানির উত্তরাংশ ছিলো সম্পূর্ণভাবে প্রোটেস্টান্ট ধর্মাবলম্বী। ১৫৫৫ সালের চুক্তি লুথারপন্থীদের স্বীকৃতি দেয়া হলেও ক্যালভিনপন্থীদের তা দেয়া হয়নি। তবে সমগ্র ইউরোপে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে ক্যালভিনবাদ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। ক্যালভিনবাদীরা নব্য জার্মানির বোহেমিয়ায়, রাইনল্যান্ড দক্ষিণ ও পশ্চিম জার্মানি এমনকি ফ্রান্সেও (হিউগিনেট) ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। এই দুই দলের পরস্পর দ্বন্দ্বের সুযোগে ক্যাথলিকপন্থীরা নিজেদের রক্ষা এবং শক্তি সঞ্চয়ের পথ বেছে নিয়েছিলো।
প্রতিসংস্কার আন্দোলন শুরু হলে ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীগণ বিশেষত জেসুইটরা ক্যাথলিকবাদ প্রচার করতে থাকে। দক্ষিণ জার্মানি, ব্যাভারিয়া, অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ এবং রাইনে ক্যাথলিক ধর্ম পুন প্রতিষ্ঠা পায়।
"এক্লেসিয়াসটিক্যাল রিজারভেশন" নামে যে নীতি গ্রহণ করা হয় তাও ধর্ম ভিত্তিক বিদ্বেষের কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এর শর্তানুযায়ী বিশপসহ যারা স্বেচ্ছায় প্রোটেস্টান্ট ধর্মগ্রহণ করেছিলেন তাদের পদবিসহ ক্যাথলিক চার্চের সকল সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং উক্ত সম্পত্তি চার্চের অধীনে থাকবে বলে নিয়ম করা হয়। তবে এই নীতি লুথারপন্থীরা অগ্রাহ্য করে। কিন্তু পঞ্চম চার্লস চার্চের জমিকে নিরপেক্ষ করার বিরুদ্ধে ডিক্রি দেন। এর ফলে উভয় দলেই প্রচন্ড বিদ্বেষ এবং অস্থিরতা দেখা দেয়।
ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধ একটি ধর্মীয় যুদ্ধ হলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যে এটি জটিল রাজনৈতিক সংঘর্ষে পরিণত হয়। উল্লেখ্য ধর্মীয় কারণে এই যুদ্ধের সূত্রপাত হলেও এর পিছনে রাজনৈতিক কারণও ছিল বলা যায়। ধর্ম বিষয়ে দুইটি পরস্পর বিরোধী বিভক্তি পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ঐক্য বিনষ্ট করে। পবিত্র রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ফার্ডিনান্দ এই দ্বন্দ্বের সুযোগে জার্মানিতে স্বীয় প্রাধান্য স্থাপনের চেষ্টা করেন। আবার সুইডেনের রাজা গাস্টাভাস নিরাপত্তা বিধানের উদ্দেশ্যে এবং বাল্টিকে সুইডেনের প্রভাব বিস্তার ও ইউরোপে প্রোটেস্টান্টদের রক্ষা করার নামে যুদ্ধে যোগদান করেন। অপরদিকে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী রিশল্যু স্পেন ও অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গের প্রাধান্য খর্ব করার উদ্দেশ্য এই যুদ্ধে যোগদান করেন।
পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য রাজন্যবর্গের নেতৃত্বে দুটি পরস্পর বিরোধী জোটে বিভক্ত হয়ে পড়লে যে কোনো মুহূর্তে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়। ১৬০৮ সালে প্রোটেস্ট্যান্টরা একটি ইভানজেলিক ইউনিয়ন বা প্রোটেস্টান্ট ইউনিয়ন গঠন করে। এটি হয়েছিলো প্যালাটিনেট এবং ক্যালভিনিস্ট রাজকুমার ফ্রেডারিখের নেতৃত্বে। এর বিরুদ্ধে ১৬০৯ সালে ক্যাথলিকরাও পবিত্র সংঘ বা হোলি লীগ নামে অনুরূপ একটি সংঘ স্থাপন করে। ব্যাভারিয়ার ম্যাক্সিমিলানের নেতৃত্বে যুদ্ধংদেহী জোট গঠনের পরিপ্রেক্ষিতে জার্মানিতে দ্বন্দ্ব অবশ্যাম্ভাবী হয়ে উঠে।
প্রোটেস্টান্টরা অভিযোগ করে যে চার্চ তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করেছিল। যেহেতু ক্যালভিনিস্টদের কোনো ধর্মীয় মর্যাদা ছিলো না তাই তারা সোচ্চার হয়ে উঠে। ফলে জার্মানিতে ধর্মীয় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
ইউরোপ সপ্তদশ শতাব্দিতে ধর্মযুদ্ধ বা ধর্মীয় দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলো। ১৫৪০ সাল থেকেই পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের প্রোটেস্টান্ট এবং ক্যাথলিকদের মধ্যে সংঘাত চলে আসছিলো। ধর্মের নামে যুদ্ধ ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, হল্যান্ডসহ সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ফ্রান্সে প্রোটেস্টান্টবাদী ক্যালভিনরা হিউগিনট নামে পরিচিত ছিল। ১৫৭২ সালে বার্থলোমিউর দিনে (২৪শে আগস্ট) সকল হিউগিনেট নেতা এবং হাজার হাজার প্রোটেস্টান্টকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। সমগ্র ইউরোপে হিউগিনদের বিরুদ্ধে হত্যাকান্ড ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবেশী নেদারল্যান্ড। প্রোটেস্টান্ট এবং ক্যাথলিকদের মধ্যে তীব্র সংঘাত শুরু হয়।
এ ছাড়াও প্রোটেস্টান্ট হল্যান্ড এবং স্পেনের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চলতে থাকে। ১৫৮৮ সালে স্পেনিশ আর্মাডার পতনের পর ইউরোপে প্রোটেস্টান্ট ধর্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রক্ষাকারীদেশ হিসেবে ইংল্যান্ড আবির্ভূত হয়। জার্মানিতে দ্বিতীয় রুডলফের পর প্রোটেস্ট্যান্টদের অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। ক্যাথলিকরা আগ্রাসী ভূমিকা গ্রহণ করে এবং জার্মান ডায়েট বা বিধায়ক সভায় প্রোটেস্টান্ট বিরোধী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দ্বিতীয় রুডলফের পর ফার্ডিনান্ড বোহেমিয়া আক্রমণ করলে ত্রিশবছর ব্যাপী যুদ্ধ শুরু হয়।
মূলত অনৈতিকতা সেই যুগটিকে গ্রাস করেছিলো। সাংস্কৃতিক রীতি, নীতি, নৈতিক দৃঢ়তা, আচার আচরণ, নীতিশাস্ত্র ক্রমশ নিম্নমুখী হতে শুরু করে। রাস্তাঘাটে ডাকাতি, নরহত্যা, খুন জখম ইত্যাদি ছিলো নিত্য নৈমত্তিক ঘটনা। রেনেসাঁস বা ধর্ম সংস্কার আন্দোলন নৈতিক অধপতন, নিষ্ঠুরতা ও অসহিষ্ণুতাকে মুছে ফেলতে পারে নি। ধর্মসংস্কার আন্দোলনের নেতারাও ধর্ম গ্রন্থের বাইরে কোনো কিছু চিন্তা করতে পারতো না। জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা ততোটা অগ্রসর ছিল না। ধর্মীয় আলোচনাগুলো ছিল বিদ্বেষপূর্ণ। এভাবে ধর্মীয় বিদ্বেষ, অনৈতিকতা এই যুগটিকে ক্রমশ অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং অসহিষ্ণু করে তোলে। যুদ্ধের অন্যতম কারণ হিসেবে এ সবকেই চিহ্নিত করা হয়।
ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধের ফলাফল
ইউরোপের ইতিহাসে সবচাইতে ধ্বংসাত্রাক যুদ্ধ হিসাবে ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই যুদ্ধ মানব সভ্যতার ইতিহাসে সামাজিক, নৈতিক, অনৈতিক ক্ষেত্রে ধ্বংস্তক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যে এই যুদ্ধের পর একটি ছায়ামূর্তি নিয়ে বেঁচে থাকে এবং ঐক্যবদ্ধ করার বদলে ওয়েস্টফেলিয়া শান্তি চুক্তি জার্মানিকে তিনশত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রত্যেক শাসক তাদের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি এবং আলাদা প্রতিরক্ষা ও শুদ্ধ নীতি গ্রহণ করে। এই সব রাষ্ট্রের উপর সম্রাটের প্রভাব কমে যাওয়ায় সাম্রাজ্য দুর্বল, ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে থাকে। এর ফলস্বরূপ ভবিষ্যতে উত্তর-জার্মানিতে ব্রানডেনবার্গ প্রাশিয়ার উত্থান ঘটে এবং অস্ট্রিয়ার আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্বকে চ্যালেঞ্জ করে। জার্মানি উনিশ শতকে বিসমার্কের নেতৃত্বে একত্রীকরণ ও শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ জার্মানির উত্থানের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রত্যেক যুদ্ধের ফলেই কতক দুঃখ দুর্দশার সৃষ্টি হয়। কিন্তু আধুনিক যুগের ইতিহাসে ত্রিশবছরব্যাপী যুদ্ধের দুঃখ দুর্দশার কোনো তুলনা চলে না। জার্মানির খুব কম অঞ্চলই ছিলই যেখানে এই যুদ্ধ স্পর্শ করে নাই। এই যুদ্ধে এটিই প্রমাণিত হয় যে, যুদ্ধের নিষ্ঠুরতাই নির্মমতার কাছে মানুষের জীবন মূল্যহীন। সৈনিকদের অত্যাচার ধর্মযুদ্ধের উন্মত্ততা ও অবাধ হত্যাকান্ডে জার্মানি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। গ্রামের গ্রাম মানুষ জনমানবহীন শ্মশানে পরিণত হয়। জার্মানির বহু অংশের জনসংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসে। জার্মানির দুই তৃতীয়াংশ লোক নিহত হয়, বহু গ্রাম জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। ১৬০২ সালে জনসংখ্যা যেখানে ছিলো একুশ হাজার ১৬৪৮ সালে তা দশ হাজারে নেমে আসে। কৃষকের জমি বন্ধ্যা জমিতে পরিণত হয়। সৈন্যবাহিনী প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিষ্ঠুরভাবে হত্যাযজ্ঞ চালায়।
দৈহিক উৎপীড়নের সঙ্গে নৈতিকাতর সম্পূর্ণ পতন ঘটবার ফলে ত্রিশবছরব্যাপী যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকটি দেশই এক একটি পশু শক্তিতে পরিণত হয়। যুদ্ধের শেষপর্যায়ে একমাত্র ফ্রান্স ভিন্ন অপরাপর সকল দেশেই গভীর হতাশা ও অবসন্নতা দেখা দিয়েছিলো। অনেক লোকই যুদ্ধেরপর নি:শোষিত হয় এবং তারা খুন-খারাপী ও ডাকাতিতে অংশ নেয়। দয়া-মায়া ও সহমর্মিতার বদলে মানুষ নির্মম পশুতে পরিণত হয়। মানুষের অভ্যাস, রীতি-নীতি নৈতিকতার বিরোধী হতে থাকে। স্কুল-কলেজ- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশ কুসংস্কারে ছেয়ে যায়।
অর্থনৈতিক দিক দিয়েও এই যুদ্ধের চরম দুর্দশা পরিলক্ষিত হয়। জার্মান শহরগুলি মধ্যে যেগুলো ছিলো খুবই সমৃদ্ধশালী সেগুলো এই ধ্বংশযজ্ঞে সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে পড়ে। বিশেষ করে উত্তর জার্মানির দেশগুলির অর্থনৈতিক ভিত্তি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ব্যাপক খাদ্যভাবে জার্মানির বহু স্থানের লোক মৃত্যুমুখে পতিত হয়। খাদ্য ভাবে মানুষকে তৃণভোজী হতে বাধ্য করেছিলো। অতিরিক্ত খাজনার চাপে তারা দাসে পরিণত হয়। এছাড়াও যুদ্ধের পর ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায় এবং নিয়ন্ত্রণ ফরাসি এবং ডাচদের হাতে চলে আসে। শিল্পক্ষেত্রে জার্মানির অধপতন যুদ্ধের পর আরো বেড়ে যায়। জার্মানির ব্যস্ততম বাণিজ্যকেন্দ্র হ্যানসান শহর, লিপজিগে, ম্যাগডেবার্গ, হামবুর্গ এবং অন্যান্য শহর ঘুমন্ত শহরে পরিণত হয়। ষোড়শ শতাব্দীতে তুর্কিরা ভেনিসের বাণিজ্য দখল করে এবং পরবর্তী কালে ইংল্যান্ড হল্যান্ড তাদের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বিশ্ববাণিজ্য ক্রমশ অধিকার করে নেয়। সুতরাং বাণিজ্য ক্ষেত্রে জার্মানির পতন ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধে চূড়ান্তরূপ ধারণ করে।
যুদ্ধে জার্মানির শিল্প, সাহিত্য অর্থনীতি, কৃষি এবং বাণিজ্যের মত ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে থাকে। পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতাব্দীতে জার্মান সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি ইতালি এবং ফ্রান্সের সমপর্যায়ভুক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু শতধাবিভক্ত জার্মানির সৃজনীশক্তি, সৃষ্টিশীলতা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। জার্মান ব্যবসা-বাণিজ্য যেমন ক্রমশ নিম্নমুখী হতে শুরু করে, তেমনী জার্মানির বুদ্ধিজীবী জানবিদগ্ধ জনও ক্রম হ্রাস পেতে শুরু করে। ফ্রান্স ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধির পর শিল্প ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতি করলেও জার্মানির এই অধঃপতন হতে পুনরুদ্ধার করতে সময় লাগে।
পরিশেষে বলা যায় যে, এই যুদ্ধের ফলাফল ছিল নিঃসন্দেহে ধ্বংসাত্মক। অনিশ্চিয়তা অস্থিরতা জার্মানিকে ক্রমশ তন্দ্রাচ্ছন্ন এবং জড়াগ্রস্ত করে তোলে। তাদের জাতীয় নীতি, ঐতিহ্য, কৌশল ভীতিজনিত অবস্থার মধ্যে পড়ে। সব হারিয়ে জার্মানি হতোদ্যম হয়ে পড়েছিল। তবে এর মধ্যে জার্মানি আবার ক্রমশ চেতন হতে শুরু করে। তাদের দুঃখ দুর্দশা অভাব গ্রস্ততা পরবর্তী কালে জাতীয় চেতনা বৃদ্ধি করে এবং জার্মানি ক্রমশ একটি শক্তিশালী দেশে পরিণত হয়। সুতরাং প্রাণের ঘটনার মধ্য দিয়ে যে ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল পরবর্তীকালে সেই ধ্বংসস্তুপকে সরিয়ে দিয়ে আধুনিক জার্মানির উত্থানের পথ প্রশস্ত করে।
ত্রিশবছরব্যাপী অবিরামভাবে যুদ্ধ করার পর ঘটে ক্লান্ত বিপর্যন্ত ইউরোপ ১৬৪৮ সালে ওয়েস্টাফেলিয়া চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে এই যুদ্ধের অবসান ঘটায়। এই চুক্তি ইউরোপে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভব ঘটায় এবং আন্তর্জাতিক রীতিনীতির গোড়াপত্তন ঘটায়। পূর্বে ইউরোপীয় রাজন্যবর্গ পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে মিলিত হবার আর্দশে বিশ্বাসী ছিল তবে এই যুদ্ধের ফলে সেই কাঠামো ভেঙ্গে যায় এবং শক্তিশালী রাজতন্ত্রের উদ্ভব ঘটিযে দ্রুত ইউরোপে রাজরা তাদের প্রভাব প্রতিষ্ঠার জন্য এক নতুন দ্বন্দ্ব শুরু করেন। জার্মানি তথা ইউরোপে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধের প্রভাব ছিলো ভয়াবহ। সমগ্র জার্মানি ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। রোমান সাম্রাজ্যের ছায়ামূর্তিতে পুরাতন রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠে। তবে ওয়েস্টফেলিয়া চুক্তির পর সর্বপ্রথম নতুন ইউরোপীয় ব্যবস্থার লক্ষ্যে স্থায়ী কূটনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠে। এই চুক্তির ফলস্বরূপ রাষ্ট্রসমূহের আন্তর্জাতিক প্রথা বা রীতি-এক দেশ থেকে অন্য দেশে দ্রুত প্রেরণ করে যুদ্ধে নিরাপরাধ বা নিরপেক্ষ মানুষের নিরাপত্তার ব্যাপারে যথার্থ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ক্রমশ স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে উঠে। বর্তমান বিশ্বের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহের আদান-প্রদান এবং কূটনীতির রীতি-নীতি এই চুক্তির উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠে।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা কর এই নোটটি পড়ার জন্য