কীভাবে নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে? এই ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি কী ছিল। অথবা, এক মেরুকরণ কী?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে উদ্ভুত ঠান্ডা লড়াইয়ের ফলে বিশ্বে যে ডিমেরুকরণের রাজনীতি শুরু হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তির সাথে সাথে তার অবসান ঘটে। এরফলে বিশ্ব জুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য শুরু হয়েছে। লঙ্ঘিত হয়েছে বিশ্বের ভারসাম্য। প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ (সিনিয়র) ঠান্ডা লড়াই-পরবর্তী বিশ্বের এই অবস্থাকে নয়া বিশ্ব-ব্যবস্থা বলে অভিহিত করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই একাধিপতাই একমেরুকরণ নামে পরিচিত।
ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসানের পর যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সেখানে বিশ্ব-রাজনীতি কোন পথে চালিত হবে সে সম্বন্ধে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভায় একটি ধারণা দেন। তাঁর মতে নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থার মূলমন্ত্র হল- গণতন্ত্র, দলব্যবস্থা, জাতীয়তাবাদ প্রভৃতির প্রসার ঘটংনা। অর্থনীতির ক্ষেত্রে অবাধ প্রতিযোগিতা, প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা প্রভৃতি পশ্চিমি রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যগুলিকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া -এই নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থার অন্যতম লক্ষা।
বিভিন্ন রাষ্ট্রের মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির দ্বারা বিশ্ব থেকে দারিদ্রা, অশিক্ষা, ক্ষুধা ও রোগকে দূর করাও এই ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু এই আপাত সুন্দর ব্যবস্থার আড়ালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীর প্রকৃত লক্ষ্য ছিল বাজার অর্থনীতির সম্প্রসারণ ও উদারনৈতিক গণতন্ত্রের প্রসার। এক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্র পাশ্চাত্য শক্তির বিরোধিতা করলে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র জাতিপুঞ্জের সকল নিয়ম-নীতিরও তোয়াক্কা না করার ক্ষমতা দেখিয়েছে।
নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাঃ
নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থা বিশ্ব শান্তি ও প্রগতির লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা বা ত্রুটি রয়েছে যেগুলি যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে।-
ক) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী একাধিপত্য সার্বিক বিশ্ব -উন্নয়নের পক্ষে মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। খ) এই বাবস্থায় দারিদ্র্যের অবসানের কথা বলা হলেও বর্তমান বিশ্বে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। গ) বিশ্বায়নের ফলশ্রুতিতে যেমন মানুষের মধ্যে ক্ষোত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি উন্নত রাষ্ট্রগুলি তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে আগামী দিনে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। ঘ) বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে নিয়ত সংযাত ও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের বৃদ্ধি নয়া বিশ্ব-ব্যবস্থাকে পরিহাস করছে।
নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যঃ
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবলুপ্তি বিশ্ব-ব্যবস্থায় এক আমূল পরিবর্তন সাধন করে। দ্বিমেরুকৃত বিশ্ব একমেরুকেন্দ্রিকে পরিণত হওয়ায় বিশ্বে মার্কিন একাধিপভা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। পরাক্রম মার্কিন শক্তির কাছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সহ জাতিপুঞ্জও অসহায়ভাবে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়েছে।
নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থার অন্যতম একটি প্রধান বৈশিষ্টা হল বিশ্বায়ন। বিভিন্ন দেশে তাদের সীমানা ছাড়িয়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরস্পরকে জুড়তে শুরু করেছে। এভাবে উদ্ভব ঘটেছে বিশ্বায়নের, যেখানে বিশ্ব পরিণত হয়েছে একটি বিশ্ব-গ্রামে। বিশ্বায়নের ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা ঘটেছে। বিশ্বায়নের ফলশ্রুতিতে পৃথিবীতে পুজিবাদ তথা ধনতন্ত্রের প্রসার ঘটেছে। নয়। বিশ্ব-ব্যবস্থার এই উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য বিশ্ব অর্থনীতির কাঠামোকে পরিবর্তিত করে দিয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে এরফলে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ইউরোপীয় দেশগুলি ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের মাধ্যমে নিজেদের সংহতিকে আরো বৃদ্ধি করেছে। অভিন্ন মুদ্রা ব্যবস্থা ইউরো'র প্রচলন এর অন্যতম একটি অঙ্গ। এর ফলে সমগ্র ইউরোপে এক নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পথ সুগম হয়ে ওঠে। নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থার অপর একটি উল্লেখযোগ বৈশিষ্টা হল উদারনৈতিক বাজার অর্থনীতি। এর ফলে একটি দেশের পণ্যসামগ্রী অনায়াসে অন্য দেশে বাজারজাত করা যাচ্ছে।
নয়া বিশ্ব-ব্যবস্থায় এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশ নতুনভাবে জেগে উঠেছে। এর ফলে এই দেশগুলি শিল্প ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি সাধন করেছে। নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থার সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ হল সন্ত্রাসবাদ রোধ। বিশ্বে নিজেদের নিরাপত্তাকে আরও সুনিশ্চিত করার জন্য অনুন্নত দেশগুলি আজও নিরাপত্তার খোঁজে প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জঙ্গি সংগঠনগুলি যেভাবে উদ্দেশ্যহীনভাবে নাশকতামূলক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থার নতুন সভাতাই বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
আজ একবিংশ শতকের নয়া জমানায় যে হাওয়া বিশ্বজুড়ে বইতে শুরু করেছে তাতে আগামী দিনে মার্কিন আধিপত্য বিনাশের অশনিসংকেত রয়েছে। তাই নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থা এমন এক যুগসন্ধিক্ষণের মধ্যে অবস্থান করছে, যখন বেশ কিছু পরস্পরবিরোধী উপাদান আলোছায়ার মতোই বিশ্বরাজনীতি তথা অর্থনীতিকে কখনও আলোকিত করছে, আবার কখনো অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলছে।