ঔরঙ্গজেবের সময় শিখ কৃষক বিদ্রোহ কি ভাবে সংঘটিত হয়েছিল?
সমগ্র মুঘল যুগ ধরেই কৃষকদের প্রতিরোধ আন্দোলন দেখা দিয়েছিল। সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের আত্মজীবনীতে কৃষক বিদ্রোহের উল্লেখ রয়েছে। আইন-ই-আকবরী, তুজক-ই- জাহাঙ্গিরীতে এই ধরনের বিদ্রোহ কথা রয়েছে। মানুচ্চির বিবরণ থেকেও এ কথা জানা যায়। তবে ঔরঙ্গজেবের আমলে এই বিদ্রোহ চরম রূপ ধারণ করে। দেখা দেয় জাঠ, সৎনামী, শিখ, বুন্দেলা প্রকৃতি বিদ্রোহ। যদুনাথ সরকার, গৌতম ভদ্র, প্রমুখ ঐতিহাসিক ঔরঙ্গজেবের ধর্মনীতির অনুদারতাকে এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
শিখ বিদ্রোহে কৃষক বিদ্রোহের নানা স্তরের অস্তিত্বের কথা গৌতম ভদ্র উল্লেখ করেছেন। শিখ আন্দোলন শুরু হয় একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠাকামী সম্প্রদায়ের নেতার মুঘল কেন্দ্রীয় শক্তির কাছ থেকে কিছু বাড়তি সুবিধা-সুযোগ আদায়ের জন্য। পরবর্তী পর্যায়ে এটি সশস্ত্র বিদ্রোহের রূপ নেয় এবং এতে যোগ দেয় কৃষকশ্রেণী। যেখান থেকে উঠে আসে সামন্ততান্ত্রিক সর্দারদের নেতৃত্বে পরিচালিত 'মিসল'ও দলতলি। শিখ ধর্মীয় সংগঠন এই বিদ্রোহে একটি সংহতি এনেছিল এবং একটি আদর্শবাদের সঞ্চার করেছিল।
নবম শিখগুরু তেগবাহাদুর ঔরঙ্গজেবের ধর্মনীতির প্রতিবাদ ও সমালোচনা করেন। তিনি বহু ইসলামিকে শিখধর্মে ধর্মান্তরিত করেন এবং ঔরঙ্গজেবের অনুদার ধর্মনীতির বিরুদ্ধে শিখদের সংগঠিত করেন। বহু হিন্দু কৃষক তেগবাহাদুরের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুঘলবিরোধী আন্দোলনে লিপ্ত হয়। ক্ষুব্ধ ঔরঙ্গজেব তেগবাহাদুরকে বন্দি করে এনে হয় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ অথবা মৃত্যুব করার আদেশ দেন। শিখগুরু সানন্দে প্রাণদেন, কিন্তু ধর্ম বা সার দিতে অস্বীকার করেন। তেগবাহাদুরকে হত্যা করলে শিখ কৃষক কূল ঔরঙ্গজেবের উপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়। পরবর্তী শিখগুরু গোবিন্দ সিংহ পিতৃহত্যার প্রতিশোধগ্রহণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। তিনি ঘোষণা করেন, "আমি চারি বর্ণের লোককে এর সিংহতুল্য করে গড়ে তুলব এবং মুঘল সাম্রাজ্যর ধ্বংস করব।' এই উদ্দেশ্যে তিনি 'খালসা পন্থ' নামে শিখবাহিনী গড়ে তোলেন যেখানে একাধিক কৃষক যোগদান করেন।
শিখ কৃষক বিদ্রোহে বান্দার সময় গোটা পাঞ্জাব জুড়ে কৃষি-ব্যবস্থার উপর চাপ পড়ে ও রাজস্বের হার বাড়ে এবং নিপীড়িত কৃষকরা দলে দলে শিখ ধর্মের আশ্রয় নিতে শুরু করে। বান্দার সময় থেকেই এই প্রক্রিয়ার শুরু, যা 'আহম্মদ শাহ আবদালির আক্রমণের সময় চরমে পৌঁছায় ।মুজাফফর আলম দেখিয়েছেন যে, ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালের শেষদিকে রাজস্বের দাবি অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়ে গেলে অন্যান্য অঞ্চলের মতো পাঞ্জাবের জমিদারগণও সশস্ত্র প্রতিরোধের পথ নেন। বান্দা নিজেকে 'সাচ্চা বাদশা' বলে প্রচার করেন, মুদ্রা চালু করেন এবং একটি নিজস্ব কর ব্যবস্থা গড়ে তোলারও চেষ্টা করেন। ফলে স্বভাবতই মুঘল রাজস্ব ব্যবস্থায় যারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল সেই কৃষক ও ছোট জমিদাররা কিছুটা স্বস্তির আশায় বান্দার দলে যোগ দেয়।
ঔরঙ্গজেবের শাসনকালে যে শিখ বিদ্রোহ হয়েছিল একাধিক গবেষক মনে করেন মূলত এটি ছিল কৃষক বিদ্রোহ। গুরু হর রায়ের আমল থেকে কৃষকরা বারবার কর দিতে অস্বীকার করছিল। তার উপর বিভিন্ন শিখ গুরুরা তাদেরকে সামরিক শিক্ষা দিয়ে মুঘল বিরোধী করে তোলে। তাই ধর্মী এবং রাজনৈতিক উভয় কারণেই ওরঙ্গজেব শিখদের উপর আক্রমণ চালায় ৷