মুঘল যুগে কৃষকদের শ্রেণীগত বিভিন্নতা আলোচনা করো? অথবা,কৃষি ও কৃষকদের শ্রেণীগত বিভিন্নতা উল্লেখসহ মুঘল যুগের অর্থনীতি

 মুঘল যুগে কৃষকদের শ্রেণীগত বিভিন্নতা আলোচনা করো? অথবা,কৃষি ও কৃষকদের শ্রেণীগত বিভিন্নতা উল্লেখসহ মুঘল যুগের অর্থনীতি


মুঘল যুগের ঐতিহাসিকরা দরবারে আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাত্রা, সম্রাটের যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রাজনৈতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। কিন্তু  সাধারণ কৃষক শ্রেণীর জীবনযাত্রা, তাদের সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তথ্যের কৃপণতা দেখিয়েছেন। বেশীর ভাগ মুসলিম ঐতিহাসিকের দৃষ্টি অভিজাত সমাজের ওপরেই নিরন্ধ ছিল। বাবর-নামা হুমায়ূন-নামা আইন-ই-আকবরী ও আকবর-নামা তুজুক-ই- জাহাঙ্গীরি, এবং কিছু ইওরোপীয় পর্যাটকদের বিবরণী ও ফ্যাক্টরী রেকর্ড হতে এবিষয়ে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। ফাঁসোয়া বার্ণিয়ের, ফ্রান্সিসকো পেলসার্ট, মানুচি, রালফ ফিচ প্রভৃতি লেখকরা সমাজ ও অর্থনৈতিক জীবনের ওপর আলোকপাত করেছেন।



মুঘল সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ভিত্তিভূমি ছিল কৃষক ও কৃষি। কৃষকের অধিকার আর কর্তব্যের সীমা নির্ধারণ করা নিয়ে মুঘল শাসকদের চিন্তার অন্ত ছিল না। জমির উপর কৃষকের ভোগদখল ও অধিকার স্বত্বকে মুঘলরা মেনে নিয়েছিলেন। এই স্বত্বকে হস্তক্ষেপ কররার অধিকার জমিদারদের ছিল না, অপরপক্ষে জমি ছেড়ে চলে যাবার বা জমি হাতবদল করবার অধিকার কৃষকের বিশেষ ছিল না। রাষ্ট্রের সমস্ত কর্ষণযোগ্য জমি যাতে উপযুক্তভাবে চাষ হয় সেদিকে মুঘল শাসকেরা বিশেষ সতর্ক ছিলেন। তাই অনাবাদী জমিকে চাষের আওতায় আনলে অথবা জমিতে সেচের ব্যবস্থা করলে রাষ্ট্রের তরফ থেকে রাজস্বের পরিমাণ কম করা হত। বীজধান, গোরু কেনার জন্য রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের কাছ থেকে ধার পাওয়া মুঘল কৃষকদের অন্যতম অধিকার ছিল। এছাড়া দুর্ভিক্ষের সময় কৃষকের দেয় রাজস্বের থেকে ছাড় দেওয়া হত। 



কৃষকদের প্রধান কর্তব্য ছিল-১) আপন আপন জমিতে চাষ করা। ২) সময়মতো ধার্য রাজস্ব পরিশোধ করা ৩) কোনো অঞ্চলে চুরি, ডাকাতি ইত্যাদির দ্বারা রাষ্ট্রের ক্ষতি হলে স্থানীয় কৃষকদের সেই স্ব ইচ্ছায় সেই ক্ষতিপূরণের দায় নিতে হতো। অগণিত কৃষক কুলের মধ্যে বিভিন্ন স্তরবিন্যাস ছিল।




কৃষকদের মধ্যে প্রথম উল্লেখযোগ্য স্তর ছিলো খুদ-কশথ-রায়ত বা খোদকশতা। দক্ষিণে এদের নাম ছিল মিরাজদার। এরা- ১) নিজেদের জমি নিজেরা চাষ করত ২) উৎপাদনের উপাদানের [গরু, লাঙ্গল, যন্ত্রপাতি] মালিকানাও তার নিজের ছিল ৩) নিজেদের গ্রামে তারা স্থায়ীভাবে বসবাস করত ৪) নিজের জমি বিক্রি ও হস্তান্তর করবার অধিকার এদের ছিল, যদিও সে অধিকারের প্রয়োেগ দুর্লভ। ৫) ঠিকমত রাজস্ব পরিশোধ করলে তাকে জমি থেকে বিচ্যুত করা যেত না। ৬) অনেক সময় অন্য লোক বা ভাগচাষী দিয়ে জমি চাষ করাতে পারতো। একথায় খুব সহজেই অনুমান করা যায় যে এই রায়তদের অবস্থা অন্যান্য কৃষকশ্রেণীর চেয়ে ভালো ছিল।


কষকদের মধ্যে দ্বিতীয় স্তর ছিল পাহি-কশথ বা ১) এরা নিজেদের গ্রাম ছাড়াও অন্য জমিদারের আওতায় অন্য গ্রামে কৃষিকার্যের জন্য নিয়োজিত হত। ২) এদের মধ্যে একদলের উৎপাদনের উপকরণ ছিল না। ৩) এদের উপর রাজস্ব ধার্য করা হত উৎপন্ন ফসলের ভাগ হিসাবে। ৪) এই কৃষকেরা সীমিতভাবে হলেও এক স্থান থেকে স্থানান্তরে গিয়ে চাষ করতে পারত। ৫) কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজের শ্রমশক্তি ব্যবহারের বিনিময়ে জমির উপর একজাতীয় বিনিময়ে জমির উ একজাতীয় অধিকার লাভ করত। ৬) এই কৃষকেরা সম্পূর্ণভাবে জমির সঙ্গে বাঁধা ছিল না। কিন্তু কৃষি থেকে বাণিজ্য বা অন্য কোনো বৃত্তিতে যাবার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। এছাড়াও ৭) অনাবাদী জমিকে আবাদী করবার সময় এদের সাহায্য নেওয়া হত। প্রচুর জমি থাকলে পাহি-কশথ "সহজেই নিজেদের খুদ-কশথে" রূপান্তরিত করতে পারত। অপরদিকে জমির উপর চাপ বাড়লে পাহিকশথদের অসুবিধাজনক অবস্থায় পড়তে হত। 



তৃতীয় শ্রেণীর কৃষকদের "মুজারিয়ান" বলে উল্লেখ করা হত। জমির উপর ছিল এদের সাময়িক অধিকার। অস্থায়ীভাবে কয়েক বছরের জন্য উচ্চতর কৃষকগোষ্ঠীর কাছ থেকে জমি পেত এবং জমির উপর এদের কোনোরূপ "স্বত্ব” জন্মাত না। যদিও কোনো কোনো দলিলে বংশানুক্রমিক ভাবে "মুজারিয়ানদের" উল্লেখ আছে । কিন্তু তারা ইচ্ছেমত নিজের কর্ষিত জমিতে কাউকে বসাতে পারত না বা জমিচাষের ভার অন্য কাউকে দিতে পারত না ৷



চতুর্থ শ্রেণীর কৃষক ছিল ভূমিহীন চাষী। নিম্নবর্ণের যেমন চামার, ধানুকী নিজেদের জীবিকা থেকে সারা বছরের খাদ্য সংগ্রহ করতে পারত না। মরসুমের সময়ে বিকল্প হিসাবে কৃষির কাজ করত এবং দৈনিক ভিত্তিতে কিছু পেত, এদের জমির উপর কোনো স্বত্বই ছিল না, এরাই একমাত্র শ্রেণী-যারা কৃষি ছাড়াও অন্যান্য বৃত্তি থেকে জীবিকা অর্জন করতে পারত। 



কৃষি ছিল অধিকাংশ মানুষের প্রথম জীবিকা সরকারি রাজস্বের প্রধান উৎস। ধান, গম ছাড়াও রেশম, তুলা, তামাক, তৈলবীজ, আখ প্রভৃতির ব্যাপক চাষ আবাদ হত। উত্তরপ্রদেশ, বাংলা ও বিহার সর্বাধিক আখের চাষ হত। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের কিছু অংশে নীলচাষ হত। কৃষিপদ্ধতি ছিল পূর্বের মতোই। কৃষি সরঞ্জাম সমূহও ছিল চিরাচরিত। কৃত্রিম সেচের ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে। ফলে চাষের জলের জন্য মূলত বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভর করতে হত। পুকুর বা খাল-বিল থেকেও কিছু জলের যোগান পাওয়া যেত। 'হুমায়ুননামা' গ্রন্থ থেকে জানা যায়, আকবর থেকে ঔরঙ্গজেব-এর শাসনকাল পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন খাদ্যশস্য, দুগ্ধজাত দ্রব্য, মাছ-মাংস ও পোশাক পরিচ্ছদের দাম ছিল খুবই সস্তা। একমাত্র যুদ্ধ বা অজন্মার সময় জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বগতি হত। জিনিসপত্রের স্বল্প-মূল্য থাকার ফলে সাধারণ মানুষ সুখে জীবন কাটাতে পারত। স্মিথের মতে, বর্তমান কালের তুলনায় তখনকার সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নত ছিল। কিন্তু করভার ও উৎপাদন  বণ্টন বৈষম্য এর জন্য মুঘলযুগে সাধারণ কৃষিজীবী মানুষের অবস্থা সচ্ছল ছিল না বলেই আধুনিক গবেষকদের সিদ্ধান্ত। কৃষকদের জাবতি, নাসক্, গাল্লাবক্স প্রভৃতি প্রথানুযায়ী সরকারি রাজস্ব প্রদান করতে হত। রাজস্বের পরিমাণ উৎপন্ন ফসলের ১/৩ অংশ থেকে ১/২ অংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফলে কৃষকদের দুঃখ দুর্দশা বাড়তে থাকে।



 মুঘল অর্থনীতির অন্যতম অঙ্গ ছিল শিল্পকর্ম। ঐ যুগে শিল্প সরকারি ও বেসরকারি উভয় উদ্যোগেই পরিচালিত হত। ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ের বিবরণ ও 'আইন-ই- আকবরী' থেকে জানা যায়, সরকারি উদ্যোগে  পরিচালিত কারখানা গুলিতে সূচের কাজ, মসলিন বা রেশমের কাজ, কাঠের কাজ প্রভৃতি হত। লাহোর আমেদাবাদ, ফতেপুর আগ্রা প্রভৃতি স্থানে সরকারি কারখানা ছিল। সুদক্ষ কারিগরেরা সরকারি কারখানায় চাকরি পেত। সে যুগে কুটিরশিল্প ছিল বহুল প্রচলিত। কুটিরশিল্প জাত দ্রব্যের মধ্যে ধ্যে রেশম রেশম ও ও তুলোজাত পণ্যসামগ্রী ছিল বিখ্যাত। প্রায় সারা দেশ জুড়ে সুতিশিল্প সম্প্রসারিত ছিল। বারাণসী, আগ্রা, গুজরাট, খান্দেশ, পাটনা, জৌনপুর, লক্ষ্ণৌ ও বাংলা ছিল সুতিশিল্পে বিখ্যাত। ঢাকার মসলিন তো ছিল জগদ্বিখ্যাত । সুতিশিল্পের সাথে সাথে রঞ্জনশিল্পও মুঘলযুগে উন্নতি লাভ করেছিল। এওয়ার্ড টেরি সে-যুগের রঞ্জনশিল্পে নৈপুণ্যের প্রশংসা করেছেন। অকবর লাহোরে কার্পেট শিল্প প্রবর্তন করেন। জাহাঙ্গীর অমৃতসরে পশম গালিচা ও শালশিল্প স্থাপন করেছিলেন। চিনিশিল্পের প্রধান কেন্দ্র ছিল পাঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশ। মুঘল আমলে সে-যুগের প্রয়োজনীয় জাহাজ তৈরির কারখানা ছিল। মুঘলযুগে শিল্পকারখানা থাকলেও শিল্পী-কারিগরদের অবস্থা সচ্ছল ছিল বলা যায় না। বণিক বা দালাল, সরকারি অভিজাত বা আমলা কেউই শিল্পীদের নির্যাতন করতে দ্বিধা করত না। অনেক সময় তাদের ন্যায্য মজুরি দেওয়া হত না। অনেক সময় তাদের উৎপাদিত সামগ্রী কম দামে বিক্রয় করতে বাধ্য করা হত।


 মুঘলযুগের অর্থনীতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সে যুগে অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য উভয় প্রকার বাণিজ্য চলত। অন্তর্বাণিজ্যের জন্য স্থলপথ ও জলপথ ব্যবহৃত হত। দিল্লি, আগ্রা, লাহোর প্রভৃতি শহরের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যোগাযোগের জন্য প্রায় চব্বিশটি সুদীর্ঘ সড়কপথ ছিল। তা ছাড়া, নদী ও খালপথে নৌকাযোগে বাণিজ্যিক লেনদেন হত। জল-পরিবহণ অপেক্ষাকৃত সস্তা ছিল বলে খাদ্যশস্য, লবণ প্রভৃতি জলপথে আনা-নেওয়া হত। উত্তর ভারতে সবচেয়ে বেশি মালপরিবহণ হত গঙ্গানদী দিয়ে। ইউরোপীয় বণিকদের আগমনের পর ভারত সামুদ্রিক বাণিজ্যে যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছিল। বার্ণিয়ে বলেছেন, বিদেশি বণিকদের আকৃষ্ট করার মতো বহু সামগ্রী ভারতে ছিল। বাংলার সাতগাঁ, সোনারপুর, চট্টগ্রাম, পূর্ব-উপকূলে বন্দরসমূহ মসুলিপট্রম এবং পশ্চিম-উপকূলে মালাবার, বোঞ্চ, বেসিন সুরাট, ক্যাম্বে প্রভৃতি বন্দর থেকে সামুদ্রিক বাণিজ্য চলত। সিংহল, ব্রহ্মদেশ, চিন, জাপান, নেপাল ও বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশের সাথে ভারতের বহির্বাণিজ্য চলত।


ভারত থেকে ইউরোপে সাধারণত সুতিবস্ত্র, মসলিন, নীল, অহিফেন, চিনি, সোরা ও নানারকমের মশলা রপ্তানি হত। বিদেশ থেকে আমদানি-সামগ্রীর মধ্যে ছিল মণিমুক্তা, রূপা, ভেলভেট, চিনামাটির বাসন, অশ্ব, হাতির দাঁত প্রভৃতি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপের বাজারে ভারতের সুতিবস্ত্রের বিপুল চাহিদা ছিল।


মুঘল-ভারত অর্থনৈতিক অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে বার্নিয়ে লিখেছেন, "দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল উন্নত, ধনসম্পদের প্রাচুর্য ছিল এবং মুঘল দরবারের ঐশ্বয ও আড়ম্বর ছিল অতুলনীয়।" হকিন্স লিখেছেন, "মুঘল-সম্রাটের আয় সমসাময়িক কালের তুরস্ক বা পারস্য সম্রাটের থেকে বহুগুণ অধিক ছিল।' মুঘল- ভারতের ধনসম্পদ সম্পর্কে উপরিলিখিত বক্তব্য ছিল পয়সার একটিমাত্র দিকের বিশ্লেষণ। এডওয়ার্ড ও গ্যারেট-এর ভাষায় "ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে জাতীয় দেউলিয়ার কালো মেঘ সর্বত্র · ছড়িয়ে পড়েছিল"। এই অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও ভারসাম্যহীনতা রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও বিপর্যয় ও অনিবার্য ধ্বংস ডেকে এনেছিল।


About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟