প্রথম পানিপথের যুদ্ধ ও খানুয়ার যুদ্ধের গুরুত্বের পার্থক্য করো?
পাঞ্জাবের শাসনকর্তা দৌলত খাঁ লোদি ইব্রাহিম লোদিকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য বাবরকে ভারত আক্রমণে আমন্ত্রণ জানান। পাঞ্জাব দখল করার পরে বাবর দিল্লির দিকে অগ্রসর হন। সুলতান ইব্রাহিম লোদী দিল্লির ৮০ কিলোমিটার দূরে পানিপথের প্রান্তরে বাবরকে বাধা দেন। এখানে উভয়ের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়, তা ইতিহাসে 'পানিপথের প্রথম যুদ্ধ' (১৫২৬ খ্রিঃ ২১শেএপ্রিল) নামে খ্যাত। এই যুদ্ধে বাবরের সৈন্য ছিল মাত্র ১২ হাজার, কিন্তু ইব্রাহিমের সৈন্যসংখ্যা ছিল ৪০ হাজার। এই অসম যুদ্ধেও শেষ পর্যন্ত বাবর জয়ী হন। যুদ্ধক্ষেত্রেই ইব্রাহিম নিহত হন। প্রধানত 'রুমী' যুদ্ধকৌশল, কামান ও বন্দুকের উপযুক্ত ব্যবহার, দ্রুতগামী ও দক্ষ অশ্বারোহী বাহিনী এবং সহজাত সমরদক্ষতা এবং বাবরের ব্যক্তিগত সমর-অভিজ্ঞতার সুষম সমন্বয়ের ফলেই ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়েও বাবর এই যুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধ ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে আফগান শক্তি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ড: ত্রিপাঠী পানিপথের যুদ্ধ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, “এই যুদ্ধ ছিল এক চূড়ান্ত ক্ষমতা নির্ণায়ক যুদ্ধ"। পানিপথের যুদ্ধে জয়লাভের ফলে মুঘল সাম্রাজ্যের পত্তন হয়। এই সাম্রাজ্য তার বিশালতা ও আড়ম্বরে ও সংস্কৃতির দিক থেকে মুসলিম জগতে শ্রেষ্ঠতম ছিল। পানিপথের জয়ের ফলে দিল্লী ও আগ্রার দরজা বাবরের কাছে খুলে যায়। ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ স্থাপিত হয়। বাবরের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়। বাবরের আগ্নেয়াস্ত্রের সম্মুখে ভারতীয় বাহিনী যুদ্ধ জয়ে অক্ষম একথা বোঝা যায়। অবশ্য পানিপথে যুদ্ধ জয়ের ফলে উত্তর ভারত বাবরের সম্পূর্ণভাবে পদানত হয় একথা বলা যায় না। তখনও আফগান শক্তি বিভিন্ন অঞ্চলে প্রত্যাঘাতের চেষ্টা চালায়। রাজপুত শক্তি তখনও অটুট ছিল। আফগান শক্তির পতনের ফলে যে শক্তি শূন্যতা দেখা দেয়, রাজপুত শক্তি তা পূরণের চেষ্টা চালায়। রাশব্রুক উইলিয়ামস বলেছেন যে, "পানিপথের জয় দ্বারা সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রথম পদক্ষেপ ঘটে; তখনও আফগান উপজাতি সমূহের বিরোধিতা ছিল প্রধান বড় বাধা।"
বাবর যখন বিভিন্ন অঞ্চলের আফগানদের অধিপত্য ধ্বংস করার প্রস্তুতি চালান তখন মেবারের রানা সঙ্গ তাঁর বিরুদ্ধে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হন। বাবরের ভারত আক্রমণের সময় রানা সঙ্গের সাহায্য করার কথা ছিল কিন্তু তা করেননি, তার উপর রানা সঙ্গ বিভিন্ন রাজপুর নেতাদের ঐক্যবদ্ধ করে মুঘল বিরোধী শক্তি সংঘ গড়ে তোলেন। ফলে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে । ১৫২৭ সালের ১৭ই মার্চ খানুয়ার প্রান্তরে রাজপুত ও মুঘল সেনাদের মধ্যে ঐতিহাসিক যুদ্ধ ঘটে, যা খানুয়ার যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধেও অল্প সংখ্যক সৈন্যবাহিনী নিয়ে কামান ও বন্দুকের ব্যবহার ও রুমী কৌশল দ্বারা বাবর জয় লাভ করেন।
খানুয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব ছিল সুদূরপ্রসারী। এই যুদ্ধের ফলে রাজপুত সংঘ যা রাণা সঙ্গ গড়েছিলেন তা ভেঙেযায়। রাজপুত শক্তি হীনবল হয়ে পড়ে। বাবর এক প্রবল শক্তির আক্রমণের সম্ভাবনা হতে রক্ষা পান। রাজপুতগণ রাণা সঙ্গের নেতৃত্বে দিল্লী দখলের যে পরিকল্পনা করে তা চূড়ান্ত ভাবে ব্যর্থ হয়। রাণা সঙ্গের সহকারী রূপে আফগানরাও খানয়ার যদ্ধে যোগ দেয়।সিকান্দার লোদীর পুত্র ইব্রাহিম খান ছিলেন তাঁদের অন্যতম। রাণা সঙ্গের পতনের ফলে তাঁর সাহায্যে আফগান শক্তি পুনঃ প্রতিষ্ঠার আশা দূর হয়। ভারতে মুঘল শক্তির ভিত্তি দৃঢ় হলে বাবর কাবুল হতে দিল্লীতে রাজধানী স্থানান্তর করেন। ভারতের ভাগ্যের সঙ্গে মুঘল শক্তি নিজেদের ভাগ্য চিরতরে যুক্ত করেন। ডঃ কে কে দত্তের মতে, "খানুয়ার যুদ্ধ ছিল ভারত ইতিহাসের নিশ্চিতভাবে এক চূড়ান্ত যুদ্ধ”। রাশব্রুক উইলিয়ামস বলেছেন যে, "খানুয়ার আগে, ভারত অধিকারের প্রশ্ন ছিল বাবরের দুঃসাহসিক জীবনের একটি উপাখ্যান মাত্র এখন থেকে তাঁর বাকি জীবনের জন্যে এই লক্ষ্য ছিল একান্ত বাস্তব ও প্রধান ঘটনা।
তাই সবশেষে এ কথা বলে যায় যে বাবর পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ভারতের মাটিতে মোগল সাম্রাজ্যের যে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলন, খানুয়ার যুদ্ধের মাধ্যমে সেই ভিত্তি প্রস্তরের উপর শক্ত দেওয়াল তুলেছিলেন ।