অজন্তা গুহাচিত্র সম্পর্কে আলোচনা কর
প্রাচীন ভারতীয় শিল্প প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল গুপ্তযুগের চিত্রকলার মধ্যে দিয়ে। এই যুগের সাহিত্য এবং অল্প কিছু দেওয়াল চিত্র থেকে ও ব্যাপারে অবহিত হওয়া সম্ভব। সাহিত্যের মধ্যে কালিদাসের মেঘদূতম্ ও রঘুবংশম্ কাব্য দুটি উল্লেখের দাবি রাখে। এই দুটি কাজে রাজপ্রাসাদের গায়ে এবং ব্যক্তিগত বাসভবনের দেওয়ালে চিত্রাঙ্কনের উল্লেখ আছে। তবে সাহিত্যিক বর্ণনা গুপ্তযুগের চিত্রকলা শিল্পের ততটা পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপ তুলে ধরতে পারে না, যতটা পারে গুহার দেওয়াল চিত্রগুলি। আলোচ্য আমলে শিল্পীর সৃজনপ্রতিভার উপচার নিয়ে উপস্থিত দাক্ষিণাত্যে অজন্তার চিত্রাবলি। অজন্তার গৃহাভ্যান্তরে অঙ্কিত চিত্রগুলির নান্দনিক আবেদন সার্বজনীন। অজন্তার গুহার চিত্রাঙ্কন পদ্ধতিকে সাধারণভাবে 'ফ্রেসকো' বলে চিহ্নিত করা হয়। অজন্তার চিত্রগুলির প্রধান বিষয়বস্তু ছিল বুদ্ধদেব, বোধিসত্ত্ব এবং জাতকের কাহিনি।
প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলির অবতারণায় বিশেষত পত্র, পুষ্প, বৃক্ষরাজির সমাহারে, শিল্পীর দক্ষতা যেমন প্রশ্নাতীত, তেমনই সেই সৃজনদক্ষতা মূর্ত হয়েছে মানবদেহের উপস্থাপনায়, যাবতীয় কামনীয়তা ও ডোলসহ নারীর প্রতিকৃতি এখানে উপস্থাপিত। এছাড়াও রাজপ্রাসাদের দৃশ্য যেমন-রাজা, রাজকন্যা রাজপ্রাসাদ প্রভৃতি। আবার পশু, পাখি, ফুল, কৃষক, ভিক্ষুক, সন্ন্যাসীর চিত্র ও অজন্তার গুহার দেওয়ালগুলিতে অঙ্কিত হয়েছে। মোট ৬টি রং যথা-সাদা, কালো, নীল, সবুজ ও হলুদ অজন্তা চিত্রশিল্পের অঙ্কনে ব্যবহৃত হয়েছে। অজন্তার গুহাচিত্রের অসামান্য এক সৃষ্টি পদ্মপানি অবলোকিতেশ্বরের প্রতিকৃতিটি। এই মূর্তিটির ভঙ্গিমা ও চিত্রন প্রণালী লক্ষ করলে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়। এই মূর্তিটি একজন সুন্দর শান্ত তরুণের। এর ডান হাতে একটি শ্বেতপদ্ম এবং মাথায় মণিমুক্তাখচিত মুকুট। বেদনাময় মুখশ্রী এবং অবনত দৃষ্টি এই মূর্তিচিত্রটির প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই অজন্তা চিত্রকলার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন চিনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ।
অজন্তার মোট ৩০টি গুহার মধ্যে ৫টি গুহা গুপ্তযুগের চিত্রকলা শিল্প প্রসঙ্গে প্রযোজ্য। এগুলি হল যথাক্রমে ১ নম্বর, ২ নম্বর ১৬ নং, ১৭ নং এবং ১৯ নং। এগুলির মধ্যে আবার রং ও নির্মাণ কৌশলের দিক থেকে ১নং ও ২নং অতুলনীয় উজ্জ্বল ও গাঢ় ভেষজ রক্তের ব্যবহার অজন্তার গুহা চিত্রাবলিকে বিশিষ্ট মর্যাদা দিয়েছে। যে বিশেষ লক্ষণ এই চিত্রশৈলীকে চিহ্নিত করে দেয়, তা হল চিত্রায়িত মানব-মানবীরা সর্বদাই যেন পৃষ্ঠপট থেকে দর্শকের দিকে উদ্গত। এই বিশেষ প্রকার উপস্থাপনের যে উদ্দাত সম্মুখবর্তী গতিপ্রকৃতি, তাকে স্টেলা ক্রামরিশ অভিহিত করেছিলেন "The direction of forthcoming" বলে। বৌদ্ধধর্মের বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে গুপ্তযুগের শেষপর্বে ও গুপ্তোত্তর যুগে চিত্রশিল্পের আরো একটি কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল মধ্যপ্রদেশের বাঘ-এ। অজন্তার সঙ্গে এর ব্যবধান ১০০ মাইলের মতো। অজন্তার শিল্পশৈলীর প্রভাব পড়েছিল এখানকার চিত্রশিল্পের নির্মাণে। তবে অজন্তার চিত্রশিল্পে আপাতদৃষ্টিতে একটা ধর্মীয় ভাব থাকলেও এর মধ্যে পার্থিব ও ধর্মনিরপেক্ষ বিষয় নিশ্চিতভাবে প্রাধান্য পেয়েছিল।