আদি-মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস রচনায় স্থাপত্যের গুরুত্ব নিরূপণ করো।
আদি-মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে স্থাপত্য নিদর্শনগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাচীন যুগ থেকেই ভারতে শিল্পচর্চার ধারা অব্যাহত ছিল। আদি-মধ্যযুগের স্থাপত্য নিদর্শনগুলি শিল্প তথা সংস্কৃতির ধারা বহন করে। সভ্যতার ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তৎকালীন বা পরবর্তী সাহিত্য, লেখ, মুদ্রা যেমন নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক উপাদান তেমনি শিল্প নিদর্শনগুলির সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাস জড়িত থাকে।
আদি-মধ্যযুগের স্থাপত্য শিল্পকলার অন্যতম নিদর্শন হল স্তূপ। আদি-মধ্যযুগের স্তূপগুলি থেকে অনুমান করা যায় যে, বৌদ্ধ ও জৈনগণ বৈদিকযুগ থেকেই স্তূপের ধারণা লাভ করেছিল। পালযুগে বাংলার স্তূপগুলিকে স্তূপ স্থাপত্যের শেষদিকের নিদর্শন বলে
মনে করা হয়। সপ্তম শতকে চিনা পর্যটকদের বিবরণে মুগস্থাপন স্তূপের উল্লেখ পাথর যায়। পাহাড়পুর ও বগুড়ায় প্রাপ্ত স্তুপগুলির ধ্বংসাবশেষ থেকে অনুমান করা যায়। এগটি দশম থেকে দ্বাদশ শতকে নির্মিত হয়েছিল। বাংলায় বৌদ্ধবিহার ও হিন্দু মন্দিরে পাশাপাশি সহাবস্থান লক্ষ করেছিলেন। এর থেকে পালযুগে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মে সমন্বয় সাধনের প্রয়াস অনুমান করা যায়।
স্তূপের মতই বিহারগগুলি ছিল স্থাপত্যের নিদর্শন। বিহারগুলির ফাংসাবশেষ থোর জানা যায় যে, প্রথমে এগলি ভিক্ষুদের বাসস্থান হিসেবে পরিকল্পনা ও নির্মাণ করা হত পরবর্তী ক্ষেত্রে এগুলি বিদ্যাচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়। রাজশাহীর অন্তর্গত পাহাড়পুত্র একটি বিশালাকার বিয়ারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। ধর্মপালের রাজত্বকালে নির্মিত হয়েছিল। সমগ্র বিহারটি পরিকল্পনা একই সময় করা হয়েছিল। ধর্মপাল বিদ্যানুরধ ও বিদ্যানদের পৃষ্ঠপোষণা করতেন। কুমিল্লার নিকটবর্তী ময়নামতীতে পাহাড়পুরের চেয়ে বড়ো আয়তনের বিহারের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর থেকে জানা যায় যে, সোমপুর বিহঙ্গ নির্মাণ কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। সম্ভবত বাংলাদেশে এরূপ আরও বিহার তৈ। হয়েছিল।
আদি-মধ্যযুগে ভারতে স্থাপত্য শিল্পের কেন্দ্র ছিল মন্দির। গুপ্তযুগের পর এ যা যে শিল্পের বিবর্তন শুরু হয় তা শিল্পের ক্ষেত্রে এক স্বতন্ত্র ধারার বিকাশ ঘটায়। আমি মধ্যযুগের মন্দিরগুলিতে মূলত তিনটি ধারার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। যথা (1) নয় রীতি, (ঘ) দ্রাবিড় রীতি ও (ii) বেসর রীতি। প্রকৃতপক্ষে এই তিন ধরনের মন্দির আমি মধ্যযুগের স্থাপত্য শিল্পকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। বেসর শিল্পরীতি স্থাপত্য শির গড়ে উঠেছিল নাগর ও দ্রাবিড় রীতির সংমিশ্রণে। হোয়সল রাজাদের স্থাপত্যকর্মে ঐ রীতির প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। এই কারণে এটিকে চালুক্যশৈলীও বলা হয়ে থাকে।
উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে বিজাপুর, পশ্চিমে পাঞ্জাব থেকে পূর্বে বাংলা পর্যন্ত এই রীতির স্থাপত্যশৈলী গড়ে উঠেছিল। দক্ষিণ ভারতে গড়ে উঠেছে দ্রাবিড় রীতি স্থাপত্যশৈলী।
পল্লবযুগের মন্দির শিল্প থেকেই দক্ষিণ ভারতে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের জয়যাত্রা শুর পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণের রীতি প্রথম মহেন্দ্রবর্মন প্রবর্তন করেন। নরসিংহবর্মনে আমলের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য নিদর্শন হল মহাবলীপুরমের সপ্তপ্যাগোডা বা রথমন্দির। এছাট নন্দীবর্মন গোষ্ঠীর মন্দিরগুলিতে পল্লব শিল্পধারার অবনতির চিহ্ন স্পষ্ট। এই পর্ব্যে মন্দিরগুলি হল কাঞ্চিপুরমের মুক্তেশ্বর মন্দির। পল্লবযুগের স্বতন্ত্র মন্দির স্বাগত চোলযুগের মন্দিরে পূর্ণতা পায়। অধ্যাপক সতীশচন্দ্রের মতে, কালক্রমে মন্দির উচ্চ যেনে উচ্চতর হয় এবং মন্দির প্রাঙ্গণের আধিক্য বৃদ্ধি পায় এবং গোপুরম্ সুবিন্যস্ত হয় এইভাবে মন্দির ছোটো ছোটো নগর বা রাজপ্রাসাদে পরিণত হয়। রাজেন্দ্রচোলের পরবর্তী মদিরগুলি ছিল নিম্নমানের। চালুক্য রাজাদের সময় উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য হল এলিফ্যান্ট দ্বীপ ও বাতাপির মন্দির। চালুক্য রাজারা ব্রহ্মা, বিষু ও শিবের উদ্দেশ্যে বড়ো বড়ো মন্দির প্রমাণ করেন। সলামেশ্বর ও বিরূপাক্ষ মন্দির এর অন্যতম নিদর্শন। চালুক্য মন্দিরগুলিতে লেকেরি মূর্তি ছাড়াও জীবনে নানাদিক নিয়ে সুন্দর মূর্তি রাখা হত। চালুক্য শিল্পরীতি থেকে এমবিশ্বাস ও সাধারণ জীবনের মেলবন্ধনের আভাস পাওয়া যায়।
রাষ্ট্রকুট আমলের কৈলাসনাথ মন্দির একমাত্র নিদর্শন। এর থেকে অনুমিত হয় রাষ্ট্রকুট এমলে শিল্পের বিশেষ অগ্রগতি ঘটেনি। বঙ্গাদেশের অধিকাংশ মন্দিরগুলি ছিল ছোটো আকৃতির। মনে করা হয় কৃষিনির্ভর জীবন ও অর্থনীতিতে স্থাপত্যরীতির কোনো পরিবর্তন গত্বর ছিল না। তাই স্থাপত্য শিল্প এখানে বিড়ম্বিত হয়েছিল।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মন্দিরগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আদি-মধ্যযুগে মন্দিরগুলি সম্পদ জমার কেন্দ্র। বড়ো বড়ো মন্দিরগলি ছিল এক-একটি ধনাগার। আহার ব্যবস্থার প্রবর্তনের ফলে ব্রাহ্মণরা খাজনাবিহীন জমির অধিকারী হয়েছিল। এছাড়া মদিরগুলি বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হওয়ায় প্রামীণ সমাজে সামাজিক একটি স্তরবিন্যাস লক্ষ করা যায়। ড. শর্মা ও ডি. ডি. কৌশাম্বি এইক্ষেত্রেই সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার উৎসের সন্ধান করেছেন। যা সামাজিক পরিবর্তনকে সুচিত করে।
পরিশেষে বলা যায় যে, আদি-মধ্যযুগের স্থাপত্যগুলির গঠন বিবর্তন সে যুগের রাজকীয় আড়ম্বর, রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি ও আঞ্চলিক শক্তির বিকাশকে নির্দেশ করে।