সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গুরুত্ব
ঐতিহ্য বলতে বোঝায়, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে যা অর্জন করি। যেমন ভারত একাধিক ভিন্ন সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের একটি দেশ। আমাদের দেশে অনেক জাতি, ধর্ম ও ধর্মের মানুষের বাস। আমাদের দেশের প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব জন্মের গল্প রয়েছে, সেইসাথে নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রয়েছে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হল একটি গোষ্ঠী বা সমাজের বাস্তব এবং অস্পষ্ট ঐতিহ্যগত সম্পদের ঐতিহ্য যা অতীত প্রজন্ম থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। আর এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিভিন্ন রূপে প্রকাশিত হয়। যেমন মূর্ত ও বিমূর্ত। তবে মূর্ত হোক বা বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য জাতি বা মানবগোষ্ঠীর এগিয়ে চলার পথে অনুপ্রেরণার কাজ করে, উৎসাহ যোগায়। তাই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
সৃষ্টি নৈপুণ্যতার উৎসের সন্ধান ঐতিহ্যের মধ্যে দিয়েই সাধিত হয়। পূর্বপুরুষদের সৃষ্টি, জীবনচর্যা ও জীবনধারণ, ভাবনা সব কিছুরই ধারক ও বাহক রূপে জীবন্ত হয়ে থাকা চলমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বা পরম্পরাগুলি মূলত ইতিহাসের আলোকময় দিকগুলিকে তুলে ধরে, বর্তমান জীবনে অতীতের ধারাবাহিক প্রবহমানতা ও সম্পর্ককে প্রকাশিত করে। তাই যে কোন সংস্কৃতি অতীত থেকে বর্তমানের বিবর্তনের ধারা উপলব্ধি করতে গেলে অতীত ঐতিহ্যের চর্চার মধ্য দিয়ে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে হয়।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গুরুত্ব যে কতটা, তা নিচের আলোচনা থেকেই জানা যাবে এ প্রসঙ্গে আমরা উল্লেখ করব ভারতের প্রথম নাগরিক সংস্কৃতির চিহ্ন বহনকারী হরপ্পা সভ্যতার কথা। হরপ্পা সভ্যতার নগর কেন্দ্র গুলির ধ্বংসাবশেষ গুজরাটের ধোলাভিরা প্রত্নস্থল বা রাজস্থানের কালিবঙ্গান এর প্রত্নস্থল। সেই কারণে এই স্থানের ঐতিহ্য রূপে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কারন তা হরপ্পা
সভ্যতার নগর সংস্কৃতিকে বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মের মানুষের কাছে উপস্থাপিত করে। এর পাশাপাশি মহাবলীপুরমের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য পল্লব যুগ সময়কালে দ্রাবিড় নির্মাণ শৈলীর প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যকে মূর্ত ভাবে বাঁচিয়ে রাখে, আগ্রার তাজমহল দিল্লির লাল কেল্লা বা ফতেপুর সিক্রি যেভাবে জীবিত রাখে মুঘল স্থাপত্য ও শিল্প রীতিকে। এগুলি তাদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে · রাখতে না পারলে কোনভাবেই অতীতের স্থপতি, ভাস্করদের সৃষ্টি পরবর্তী প্রজন্মের মানুষের কাছে অদেখা, অজানা ও অচেনা থেকে যেত।
অজন্তার গুহাচিত্র হাচিত্র গুলি গুলি প্রায় প্রায় ১৫০০ বছর • আগে আমাদের দেশের পূর্বপুরুষ শিল্পীগণ যে • অসাধারন দক্ষতা ও শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় দিয়ে চিত্র বা ভাস্কর্যগুলি নির্মাণ করেছেন সেগুলিকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য টিকিয়ে রাখা অত্যন্ত জরুরি। খাজুরাহোর মন্দিরের দেওয়ালের গায়ে সঙ্গমে লিপ্ত লিপ্ত নরনারীর নরনা ভাস্কর্য দশম-একাদশ শতকে চান্দেল শাসকদের শুধুমাত্র | স্থাপত্য রীতি ও শিল্পকলার ছবি তুলে ধরে না, সেইসাথে স্থপতি ও ভাস্করের চিন্তা ভাবনা, দক্ষতা ও মনের ভাবনাকেও দর্শকের কাছে তুলে ধরে। এই সমস্ত মূর্ত ঐতিহ্যের মধ্যে দিয়ে কেবল ইতিহাস ও সংস্কৃতি প্রকাশিত হয় না, অতীত হয়ে ওঠে জীবন্ত।
কেবল মূর্ত ঐতিহ্য গুলিই যে অতীতের সংস্কৃতিকে জীবন্ত করে তোলে তা নয়, বিমূর্ত : সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বা পরম্পরাও অতীতকে প্রকাশিত করে, পূর্বপুরুষদের কাজ ও চিন্তাভাবনাকে বুঝতে সাহায্য করে। আধুনিক যুগে গুজরাটের ক্যাম্বে বা খাম্বাত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পুঁতি নির্মাণের কেন্দ্র। এই শিল্পটি ওই অঞ্চলে সুদূর অতীত কাল থেকেই অস্তিত্বমান। পুরাতত্ত্বের তিন গবেষক মার্ক কেনোয়ার, মাসসিমো ভিডালে ও কুলদীপ্ত ভান এ বিষয়ে নতুন তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আসলে যে কোন প্রথা বা শৈলী বংশ পরম্পরায় বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সংশ্লিষ্ট মানবগোষ্ঠী প্রয়োজনের ভিত্তিতে বাঁচিয়ে রাখে নিজেদের জীবনযাত্রা ও জীবনচর্যার স্বার্থে। যুগ যুগ ধরে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন পরিমার্জন বিবর্তনকে সঙ্গী করে বেঁচে থাকা প্রথা তাই অতীতের উত্তরাধিকারকে সূচিত করে। এই দিক থেকে বিচার করলে বিমুর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ৷
মেলা বা উৎসব সাংস্কৃতিক বৈচিত্র তথা প্রাণবন্ততা
প্রদর্শন করে। ভারতীয় জনজীবনে জনমানসে ও
জনচেতনায় মেলা ও উৎসবের প্রভাব অপরিসীম, জীবনযাত্রার অপরিহার্য অঙ্গ। এ প্রসঙ্গে কুম্ভ মেলার কথাই ধরা যাক। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের মধ্যভাগ থেকে কনৌজের সম্রাট হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে শুরু হওয়া এই মেলা চলে আসছে। বিশ্বে ধর্মীয় সংস্কার বা বিশ্বাসের বৃহত্তম বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই মেলার মধ্যে দিয়ে। পুষ্করের পশু মেলা রাজস্থানের সংস্কৃতি, দর্শক ও পর্যটকদের কাছে উপস্থাপন করে। মাত্র ৯দিনের এই মেলার মধ্যে দিয়ে রাজস্থানের অধিবাসীগণ তাদের পরস্পরাগত ঐতিহ্যের বিশেষ বিশেষ দিকগুলোকে তুলে ধরার সুযোগ পান।
ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলি পর্যটকদের আকর্ষণের মূল কেন্দ্র -এই কারণে সকল প্রকার ঐতিহ্যের এক বিশেষ অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। ইউনেস্কো স্পষ্টভাবেই বলেছে ঐতিহ্যর সঠিক বিজ্ঞাপন ও বিপণনের মাধ্যমে স্থায়ী অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। কোন অঞ্চলের প্রাকৃতিক বা সাংস্কৃতিক মূর্ত ঐতিহ্য ও সেইসাথে সাংস্কৃতিক বিমূর্ত ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্ত মানবগোষ্ঠীর জীবিকা ও অর্থনৈতিক সংস্থান ঐতিহ্যের যথাযথ বিজ্ঞাপন, বিপণন ও ব্যবস্থাপনার উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে, ব্লকবাস্টার রূপে চিহ্নিত দুর্গাপূজা সমগ্র ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতার একটা অন্যতম অর্থনৈতিক লেনদেনের উৎসব। আরে একটি ঐতিহ্য কুম্ভ মেলা। এই ঐতিহ্যের আয়োজন বা ব্যবস্থাপনা তার অর্থনৈতিক তাৎপর্য প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। যদি ভোজনের বিষয়ে যাওয়া যায় তাহলে হায়দ্রাবাদ বা কলকাতার ঐতিহ্যবাহী বিরিয়ানি যথেষ্ট মুনাফা দায়ক।
আঞ্চলিক ঐতিহ্যগত হস্তশিল্প গুলিও অর্থনৈতিক ভাবে যথেষ্ট কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাশ্মীরের বিখ্যাত পশমিনা শাল ও কার্পেট এর বাণিজ্যিক লাভের কথা। ছোট বড়, আন্তর্জাতিক, জাতীয় বা স্থানীয়, মূর্ত বা বিমূর্ত চলমান, প্রাকৃতিক বা সাংস্কৃতিক-সকল প্রকার ঐতিহ্যই অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভীষণভাবে গুরত্বপূর্ন কারণ তা অসংখ্য মানুষের অন্নের সংস্থায় সাহায্য করে। এই কারনে সর্ব প্রকার ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখা আবশ্যিক।
বিভিন্ন মূর্ত এবং বিমূর্ত ঐতিহ্য গুলি আমাদের দেশের সংস্কৃতির অমূল্য চিহ্ন। এগুলি নষ্ট হয়ে গেলে বা ধ্বংস হয়ে গেলে আমাদেরই ক্ষতি, জাতি তথা দেশের ইতিহাসচর্চার ক্ষতি এবং এই ক্ষতি অপূরণীয়। ইতিহাস যদি মানবসভ্যতার অ্যালবাম হয় তাহলে ঐতিহ্য হলো ওই অ্যালবাম এর পাতা থেকে নেওয়া স্মৃতিমধুর ও দৃষ্টিনন্দন কিছু ছবি । অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা ঐতিহ্যবাহী সকল সৌধই ঐতিহাসিক সত্ত্বা নিয়েই জীবন্ত; সে কেবল নিথর, নিষ্প্রাণ, নীরব কিছু পাথরের সমষ্টি নয়; অতীতের প্রতিনিধি হয়ে সে বর্তমানের সাথে কথোপকথনে যুক্ত থাকে, গল্প বলে, এমন গল্প যা পৌরাণিক কিন্তু সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। এবং যা চলমান এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্ম তাই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গুরুত্ব অপরিসীম।