মাও-সে-তুঙ-এর নেতৃত্বে কিভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের উত্থান ঘটেছিল?

মাও-সে-তুঙ-এর নেতৃত্বে কিভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের উত্থান ঘটেছিল?

 মাও-সে-তুঙ-এর নেতৃত্বে কিভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের উত্থান ঘটেছিল?

মাও-সে-তুঙ-এর নেতৃত্বে কিভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের উত্থান ঘটেছিল?

চিনের কমিউনিস্ট নেতা মাও-সে-তুঙ-এর নেতৃত্বে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১ অক্টোবর গণ প্রজাতন্ত্রী চিন-এর প্রতিষ্ঠা আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এটি শুধুমাত্র চিনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়, আন্তর্জাতিক ও রাজনীতির ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। একদিকে সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অপশাসন অন্য দিকে বৈদেশিক শক্তিগুলির ব শোষণ-এই দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে চিনে দফায় দফায় তাইপিং বিদ্রোহ (১৮৫০-৬০ খ্রিস্টাব্দ), বক্সার আন্দোলন (১৯০০ খ্রিস্টাব্দ) সংঘটিত হয়। অবশেষে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে সান-ইয়াৎ-সেনের নেতৃত্বে মাঞ্চু শাসনের অবসান ও ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে মাও-সে-তুং-এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা দখল করে সমস্ত রকম শোষণ ও অত্যাচারের অবসান ঘটায়।

আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের সাফল্য চিনের বুদ্ধিজীবীদের মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। ইতিমধ্যে চিনের অভ্যন্তরে কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গড়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে গোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। শেষে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ১ জুলাই সাংহাই অঞ্চলে ফরাসি। অধিকৃত একটি গার্লস স্কুলে চিনের বিভিন্ন কমিউনিস্ট গোষ্ঠীগুলির এক কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। রুশ কমিউনিস্ট পার্টির পরামর্শ এবং পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই মার্কসবাদী অধ্যাপক লি-তা-চাও এবং চেন-তু-শিউ-এর উদ্যোগে এই সম্মেলনে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা হয়।

কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার পূর্বে চিনে কুয়োমিন-তাং দলের যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল। ড. সান-ইয়াৎ-সেন ছিলেন এই দলের প্রধান এবং চিন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি। তিনি চিনা কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়াও রাশিয়ার সঙ্গেও সুসম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী ছিলেন। তার সময়ে বহু কমিউনিস্ট কুয়োমিন তাং দলের সদস্যপদও লাভ করেছিলেন। শুধু তাই নয় কুয়োমিন তাং দলের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে কমিউনিস্টরা নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করেছিল।

১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে সান-ইয়াৎ সেনের মৃত্যুর পর চিয়াং-কাই-শেক কুয়ো-মিন-তাং দলের এবং সরকারের প্রধান হন। রাশিয়া ও চিনা কমিউনিস্টদের সহযোগিতায় তিনি উত্তর চিনের সমর নায়কদের পরাজিত করে উত্তর চিনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করেন। এরপর ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে উত্তর চিনের পিকিং দখল করলে সমগ্র চিনা ঐক্যবদ্ধ হয়। ঐক্যবদ্ধ চিনের রাজধানী হয় নানকিং।

কিন্তু ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দ খ্রিস্টাব্দ থেকে নানা কারণে দুই দলের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে চিয়াং সাম্যবাদী রাশিয়ার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেন। চিনের সমস্ত উচ্চপদ থেকে কমিউনিস্টদের বিতাড়িত করেন এবং চিয়াং-এর নির্দেশে ক্যান্টন, নানকিং প্রভৃতি অঞ্চলে নির্বিচারে গণহত্যা চালানো হয়। ১৯২৭-২৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রায় ৪ লক্ষ ৫০ হাজারের মতো কমিউনিস্ট সমর্থক প্রাণ হারায়।

এই পরিস্থিতিতে মাও-সে-তুং-এর নেতৃত্বে কমিউনিস্টরা গ্রামে গিয়ে গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের সংগঠিত করার কাজে মনোনিবেশ করে। মাও-এর নেতৃত্বে কমিউনিস্টর কিয়াংসি প্রদেশে তাদের প্রধান ঘাঁটি স্থাপন করে। মাও-সে-তুং ও চু-তে কৃষকদের নিয়ে কিয়াংসিতে লালফৌজ গঠন করেন ব্রিটিশ, আমেরিকান, জাপানি সৈন্যের সাহায্য নিয়ে চিয়াং কাইশেক কমিউনিস্টদের দমনের চেষ্টা করলে চিনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।

চিনে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের সুযোগে জাপান চিনের সমৃদ্ধ অঞ্চল মাঞ্চুরিয়া দখল করে জেহোল পর্যন্ত অগ্রসর হয় এই সময় জাপানি আগ্রাসন প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা না-করে চিয়াং কমিউনিস্ট নিধনযজ্ঞে মেতে ওঠেন। কুয়োমিন-তাং দল কমিউনিস্টদের প্রধান ঘাঁটি কিয়াংসি অবরোধ করে। এই অবস্থায় ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর মাও-সে-তুং তাঁর আত্মীয়স্বজনস প্রায় এক লক্ষ কমিউনিস্ট নেতাদের নিয়ে সরকারি অবরোধ অগ্রাহ্য করে ৬০০০ মাইল পথ অতিক্রম করে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২০ অক্টোবর দক্ষিণ চিন থেকে উত্তর-পশ্চিম চিনের পর্বতসংকুল শেনসি প্রদেশে উপস্থিত হন। ৩৭০ দিন পায়ে হেঁটে মাও বাহিনী ১৮টি পর্বতশৃঙ্গ, ২৪টি নদী, ১২টি প্রদেশ, ৬২টি শহর অতিক্রম করে এবং মাত্র ৮০০০ যাত্রী তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছোয়। চিনের ইতিহাসে এটি বিখ্যাত লং মার্চ বা দীর্ঘ পদযাত্রা নামে পরিচিত। এই ঐতিহাসিক পদযাত্রার মধ্য দিয়ে মাও-সে-তুং কমিউনিস্টদের কাছে সুযোগ্য নেতার মর্যাদা পান।

মাও-সে-তুং শেনসিতে একটি অর্ধ স্বাধীন কমিউনিস্ট রাষ্ট্র গঠন করেন এবং এর রাজধানী হয় সিয়াং-ফু চিয়াং কমিউনিস্টদের পশ্চাদ্ধাবন করে শেনসি প্রদেশে সৈন্য পাঠায় এমনকি ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে চিয়াং-কাই-শেক নিজেই সিয়াং-ফুতে এলে কমিউনিস্ট নেতা চ্যাং-শিউ-লিয়াং তাঁকে অপহরণ করেন অবশ্যই রুশ হস্তক্ষেপে তিনি ১৩ দিন পর ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর মুক্তি পান। এরপর চিয়াং কমিউনিস্টদের সঙ্গে একযোগে জাপানি আক্রমণের মোকাবিলায় সম্মত হন। এই ঘটনা সিয়াং-ফু ঘটনা নামে পরিচিত।

১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে জাপান পুনরায় চিনের ওপর আক্রমণ করে চিনের বহু স্থান দখল করে নেয়। কুয়োমিন-তাং দল ও মাও-সে-তুং-এর কমিউনিস্ট দলের সেনারা মিলিতভাবে জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধ করে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে মিত্রশক্তির নিকট জাপান আত্মসমর্পণ করার পর থেকে চিনে প্রাধান্য লাভের প্রশ্নে দুই দলের মধ্যে আবার সংঘাত বাঁধে। মাওবাহিনী একে একে বহু চিনা ভূখণ্ড দখল করতে থাকলে কুয়োমিন-তাং দলের সঙ্গে তাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়। শেষপর্যন্ত চিয়াং ও তার অনুগামীরা পরাজিত হয়ে ফরমোজা বা তাইওয়ান দ্বীপে আশ্রয় নেন। এখানে তারা জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করে। আর মাও-সে-তুং বিজিত অঞ্চলগুলি নিয়ে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ১ অক্টোবর পিকিং-এ চিনের গণ প্রজাতান্ত্রিক আত্মসমর্পণ করার পর থেকে চিনে প্রাধান্য লাভের প্রশ্নে দুই দলের মধ্যে আবার সংঘাত বাঁধে। মাওবাহিনী একে একে বহু চিনা ভূখণ্ড দখল করতে থাকলে কুয়োমিন-তাং দলের সঙ্গে তাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়। শেষপর্যন্ত চিয়াং ও তার অনুগামীরা পরাজিত হয়ে ফরমোজা বা তাইওয়ান দ্বীপে আশ্রয় নেন। এখানে তারা জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করে। আর মাও-সে-তুং বিজিত অঞ্চলগুলি নিয়ে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ১ অক্টোবর পিকিং-এ চিনের গণ প্রজাতান্ত্রিক সরকার গঠন করেন । এই সরকারে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন চৌ-এন-লাই এবং রাষ্ট্রপতি হন মাও-সে-তুং।

চিনে' কমিউনিস্টরা সফল হয়েছিল বেশ কিছু কারণে-

  1. মাও-সে-তুঙের অসামান্য নেতৃত্বে চিনে কমিউনিস্ট দলের প্রতিষ্ঠা ও প্রসার ঘটেছিল। নেতারূপে তাঁর দক্ষতা, সংগঠকরূপে তাঁর সাংগঠনিক বুদ্ধি ও শক্তি, সেনাপতিরূপে তাঁর রণকৌশল কমিউনিস্ট দলকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছিল।
  2. মাও-এর ডাকে সাড়া দিয়ে চিনবাসী যে কোনো আত্মত্যাগে তৈরি ছিল। কৃষক, শ্রমিক-সহ সাধারণ মানুষের অকুন্ঠ সমর্থন পেয়েছিল মাও-এর কমিউনিস্ট দল। স্বাভাবিকভাবে তাই চিনে কমিউনিস্ট আন্দোলন সফল হয়েছিল ও গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার গড়ে উঠেছিল।
  3. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে চিনের জনবিরোধী ও দুর্নীতিপ্রবণ কুয়োমিনটাং দলকে সমর্থন করেছিল, এতে চিনবাসী আরও বেশি কমিউনিস্ট সমর্থক হয়ে পড়ে।
  4. সাম্যবাদের আঁতুড়ঘর রাশিয়া প্রথম থেকেই চাইত যে বিশ্বে সাম্যবাদী ভাবধারার প্রসার ঘটুক। সোভিয়েত নেতাদের ধারণা ছিল পুঁজিবাদের প্রসার রোধ করতে সাম্যবাদের বিস্তার প্রয়োজন। তাই চিনের সাংহাই নগরীতে যখন মাও-সে-তুঙের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হল (১৯২১ খ্রি.) তখন সবার আগে রাশিয়া এই দলকে সমর্থন করেছিল। রাশিয়ার পরামর্শ মেনে চিনের কমিউনিস্ট দল শ্রমিক শ্রেণিকে তাদের আন্দোলনে শামিল করেছিল। তাই চিনের কমিউনিস্ট দলের প্রতিষ্ঠা থেকে উত্থান পর্যন্ত রাশিয়ার সক্রিয় সহযোগিতা ছিল বলা চলে।

মাও-সে-তুঙের নেতৃত্বে গড়ে-ওঠা কমিউনিস্ট দল চিনে যে গণপ্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল তা চিনকে বিশ্বের এক নয়া শক্তিরূপে পরিচিতি দিয়েছিল। দীর্ঘ ৩০ বছরের সংগ্রামের ফসলকে কাজে লাগিয়ে কমিউনিস্ট দল চিনে আধুনিকীকরণের পটভূমি গড়ে তুলেছিল। কমিউনিস্ট চিনের প্রতিষ্ঠা দিবসে (১৯৪৯ খ্রি.. ১ অক্টোবর) মাও-সে-তুঙ এক ভাষণে বলেন, "চিনবাসী আর কখনও দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হবে না বা তারা কোনো বিদেশি হস্তক্ষেপও মেনে নেবে না।" 'A Concise History of China' গ্রন্থে বলা হয়েছে- "এটি চিনের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল, যে যুগের ইতিহাস ছিল চিনা জনগণতন্ত্রের অধীনে সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রগতির ইতিহাস"।

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟