চীনের লং মার্চ সম্পর্কে টীকা ( Long March)ও এর তাৎপর্য আলোচনা করো।
চীনের সাফল্যবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে 'লং মার্চ' (Long March) হল একটি অতি তৎপর্যপূর্ণ ঘটনা । ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে ড. সান ইয়াৎ-সেনের মৃত্যুর পর তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর ও চিয়াৎ-কাই শেক কুমোমিনটাং দল ও সরকারের প্রধান হন । তীব্র কমিউনিস্ট বিরোধী চিয়াও চীনে কমিউনিস্টদের মমতা বৃদ্ধিতে সহ্য করতে পারেননি, তাই ১৯২৭ খ্রিষ্ঠাব্দে চিয়াং সাম্যবাদী রাশিয়ার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন, কমিউনিস্টদের সব উচ্চপদ থেকে বিতাড়িত করা হয় এবং বহু কমিউনিস্টকে হত্যা করা হয় । এই অবস্থায় কমিউনিস্টরা শহর থেকে সরে গিয়ে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করে ৷ এখন তরুন নেতা মাও-সে-তুং এবং চুতে গ্রামের কৃষকদের নিয়ে কিয়াং-সিতে 'লালফৌজ' গঠন করেন ৷ ইতিমধ্যে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে মাও বিরোধী গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে মাও-এর সম্পর্ক তিক্ততর হয় । কমিউনিষ্ঠদের মধ্যে এই বিরোধীতার সুযোগ নিয়ে ১৯৩০-৩৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে চিয়াং 'সাম্যবাদীদের নিধনের জন্য পাঁচটি অভিযান চালান, যার মধ্যে প্রথম চারটি ব্যর্থ হয় । এরপর চিয়াং এর নেতৃত্বে পঞ্চম অভিযানের ফলে সাম্যবাদীরা কিয়াৎ-সিতে তাদের সাত বছরের অবস্থান থেকে উৎখাত হয়, এমতাবস্থায় মার্চ-এর নেতৃত্বে' লাল ফৌজ' ১৯৩৪-এর ১৫ ই অক্টোবর প্রায় এক লক্ষ কমিউনিস্ট সদস্য সরকারী বাহিনীর বেস্টনী ভেদ করে যে দীর্ঘ মাত্রায় অবতীর্ণ হয় তা 'লং মার্চ' নামে পরিচিত ।
এডগার স্নো তাঁর গ্রন্থে লং মার্চের আবেগখন বর্ণনা দিয়েছেন । ৮৫ হাজার সেনা, ১৫ হাজার সরকারী এবং দলীয় কর্মী, ৩৫ জন মহিলা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এই মাত্রা শুরু হয় ৷ মাও সে-তুং ও চু-তের নেতৃত্বে দীর্ঘ ও হাজার মাইল যাত্রাপথে সাম্যবাদীরা ও তাদের লাল বাহিনী কোয়াৎ টুং, সুনান, কোয়াংসা, সিকাং, জেঠুমান, কানসু, শেনসি প্রভৃতি ১১টি প্রদেশ, ১৮টি গিরিশ্রেনী এবং ২৫টি নদী অতিক্রম করে । রোমাঞ্চ, আবিস্কার অসিম সাহসিকতা, বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস, বিজয়, দুঃখ, কষ্ট, চূড়ান্ত ত্যাগ স্বীকার, অবিশ্বাসা বিপ্লবী আশাবাদ-কী ছিল না এই মহাকাব্যিক অভিযানে । এই অভিযানের ব্যক্তি পরিনামের দিক থেকে আমেরিকা মহাদেশের মোট প্রস্থের দ্বিগুনের সমান । এট ছিল গ্রীক মহাকাব্য ওডিসি-র মতো, আধুনিক যুগে যার নজীর মেলাভাব ।
চীন তথা বিশ্ব সামাবাদের বিকাশের ইতিহাসে লং মার্চ' বা দীর্ঘ পদযাতার গুরুত্ব অপরিসীম । লং মার্চকে 'Epie Victory' বা মহাকাব্যিক জয় 'হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয় । (কেননা এর মধ্যে রাখছে মহাকাব্যিক গাম্ভীর্য ও ব্যাপ্তি, আদর্শের জন্য অননা ত্যাগ ও তিথিঞ্জার নজীর, দুধরনের তুলনাহীন দৃষ্টান্তও এই দীর্ঘ যাত্রায় মাও ও তাঁর অনুগামীরা যে একনিষ্ঠতা, কষ্ট সহিষ্ণুতা ও সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন ইতিহাসে তার নজীয় বিরল । ভবিষ্যতে দেশ গঠনের ক্ষেতে এই অভিঞ্জতা যেমন তাদের দারুনভাবে সাহায্য করেছিলা তেমনি পরবর্তীকালে কুামামিংটাং বাহিনীর সাথে লড়ায়ে তাদের শক্তি-যুগিয়েছিল । চীনের মাটিতে লালাফৌজ সে অপ্রতিদ্বন্ধি এই দীর্ঘ পদযাত্রাতে তা প্রমানিত হয়েছিল এই লং মার্চের সামরিক গুরত্ব অপরিহার্য ৷
লং মার্চকে সফল করে তুলে মাও ও তার সাথীরা অসম্ভবকে সম্পূর্ণ পরিণত করেছিলেন । লং মার্চ শেষ করার পর লাল ফৌজের যে সকল সদ্যন্য জীবিত ছিলেন-তাদের নিয়ে মাও-সে-তুং ইয়েনান সম্পূর্ণভাবে রুশ প্রভাবমুক্ত একটি দুর্ধর্ষ পার্টিও সেনাবাহিনী গড়ে তুললেন । এইভাবে মস্কো ও কমিন্টার্নের চূড়ান্ত বিরোধীতাকে অগ্রাহ্য করে মাও সে তুং ঐতিহাসিক লং মার্চের মধ্য দিয়ে নিজেকে চীনা কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা হিসাবে প্রশ্নাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন । ইমান্যুসেল সু লং মার্চের গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন- It was a landmakn in his history of the party and in Mao's rise to the pinnacl power. তিনি চীনের সাধারন মানুষের হৃদয়কে জয় করেছিলেন । লং মার্চ চলাকালীন জু সুন্যি (Tsunyi) শহরে পলিটব্যুরো সম্মেলন সাম্যবাদীদের দুর্দশার জন্য লি-তে এবং পোকু কে দায়ী করা হয় । তারা ক্ষমতাচ্যুত হন এবং মাও স্ট্যান্ডিং কমিটির সদসা নিযুক্ত হন । চীনা কমিউনস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে মাও- সব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসে কমিনটাংপন্থী বলশেভিকদের তথা কথিথ বাম লাইনের অবসান ঘটে ৷
একদিক থেকে বিচার করলে এই গন-অভিপ্রায়ন ছিল মানব সভ্যতার ইতিহাসের বৃহত্তম সশস্ত্র প্রচারাভিযান । লাল লালফৌজ সে বিশাল এলাকার মধ্যে দিয়ে লং মার্চ করেছিল তার মোট জনসংখ্যা ২০ কোটি। প্রতিটি শহর দখল করে তারা জনসভা করেছে ,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছে, ধনীদের উপর কর চাপিয়েছে, বহু ক্রীতদাসদের দাসদের বন্ধনক থেকে মুক্ত করেছে 'স্বাধীনতা, সাম্য ও গণতন্ত্রের' বাণী প্রচার করেছে, বড় ভূ-স্বামী ও অফিসারদের জমি বাজেয়াপ্ত করেছে এবং তাদের সম্পত্তি গরীবদের মধ্যে বিলি করেছে । প্রতিটি জনসভায় তারা কৃষি বিপ্লবের কর্মসূচী ও জাপ-বিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তার কথা প্রচার করেছে । সুদীর্ঘ পদযাত্রার পরে তারা উত্তর শেনসিতে পৌঁছান এবং সেই এলাকাকে কেন্দ্র করে জাপ-বিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু হয় ।
জ্যাক গ্রে মনে করেন, লং মার্চ আসলে প্রচারের জয়। কারণ ইতিমধ্যে চীনের উপর জাপান নানা কারনে চাপ সৃষ্টি করেছিল এবং রাজনৈতিক ঐক্য না হওয়া পর্যন্ত চিয়াং কাই-শেক প্রতিরোধ গড়ে তোলার ব্যাপারে গড়িমসি করেছিলেন । জাপানী আগ্রাসনের মুখে সাম্যবাদীদের নির্ধন ও নির্মূলকরণ প্রচেষ্টা স্বদেশপ্রেমী চীনারা ভালো চোখে দেখে নি । চিয়াৎ-এর কাছে সাম্যবাদীরা শত্রু হলে ও দেশবাসীর কাছে প্রধান সমস্যা ছিল জাপানী আগ্রাসন । তাই লং মার্চের মাধ্যসে একটি বিষয় তুলে ধরা গিয়েছিল যে, চীনাবাসীর বিরুদ্ধে চীনাবাসীর যুদ্ধ আদৌ ন্যায়সঙ্গত নয় । তাই অবশেষে চিয়াৎ 'সাম্যবাদীদের নিয়ে জাপান বিরোধী ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠন করতে বাধ্য হয়েছিলেন ।