চিয়াং-কাইসেকের নেতৃত্বে নাংকিং সরকারের কার্যাবলী আলোচনা কর।
আধুনিক চীনের ইতিহাস যেসব নায়কদের দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁদের মধ্যে অবশ্যই স্মরণীয় হলেন চিয়াং-কাই-শেক সাংখ্যাই-এর কমিউনিস্ট সংগঠনগুলি এবং উ হানের কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন বামপন্থী সরকারকে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে দমন করার পর কুয়োমিনটাং নেতা চিয়াং কাই-শেক নানকিং-এ একটি কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করেন। এইসময় চীনের ইতিহাসে সমরনায়কতন্ত্রের যুগের অবসান ঘটেছিল। চিয়াং-কাই-শেকের নেতৃত্বে নানকিং সরকার দশ বছর কায়েম ছিল।
সমকালীন সময়ে অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত সমস্যা চীনকে জর্জরিত রেখেছিল। এই সময় চিয়াং কাই-শেক-এর নেতৃত্বাধীন নানকিং-এর জাতীয়তাবাদী সরকার তার যাত্রা শুরু করেছিল। সরকারের ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় পুনর্গঠনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে সান ইয়াৎ-সেন-এর উত্তরাধিকার বহন করে অগ্রসর হওয়া। অর্থ যোগাযোগ, শিল্পের উন্নতি, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অন্তত কিছুটা হলেও ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল নানকিং সরকার। অন্যদিকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কতকগুলি আর্থ-সামাজিক সংস্কারের প্রতি সরকার চরম উদাসীনতা দেখিয়েছিল। ভ্রান্ত রাজস্বনীতির পরিপ্রেক্ষিতে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে বিরাট ফারাক স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। বর্ধিত ব্যয়ের ঘাটতি মেটাতে সরকার কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। এর সুদূরপ্রসারী কুফল চীনের অর্থনীতিকে মারাত্মক রকম ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।
জাতীয়তাবাদী আদর্শের অনুপ্রেরণায় ১৯২৮ সালের ৭ জুলাই নানকিং সরকার ঘোষণা করে যে আফিম যুদ্ধের পর সম্পাদিত চুক্তিগুলির মেয়াদ শেষ হয়েছে এবং এরপর শুল্ক সমতাকে মান্য করে বিদেশি রাষ্ট্রগুলি চীনের সঙ্গে নতুন চুক্তি করবে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ চীনের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করে এবং শুল্ক নিয়ন্ত্রণে চীনের স্বাধীনতা (tariff autonomy) মেনে নেয়। তাছাড়া পরিবেষ্টিত অর্থনীতির যুগে বিদেশিরা চীনে যে সমস্ত সুবিধা বা কনসেশন' আদায় করেছিল, সেগুলিও তারা অনেকটাই পরিত্যাগ করে।
চিয়াং কাই-শেক-এর নেতৃত্বাধীন নানকিং সরকারের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৭ সালের মধ্যে চীনের অভ্যন্তরে রেলপথের বিস্তৃতি ৮০০০ কিমি থেকে বেড়ে ১৩০০০ কিমি হয়েছিল। বড়ো রাস্তার বিস্তার ছিল আরও লক্ষণীয়। ১৯২১ সালে চীনে মাত্র ১০০০ কিমি বড় রাস্তা ছিল। ১৯৩৬ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১১৫,৭০৩ কিমি। একই সঙ্গে ডাকব্যবস্থা ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯২১ সাল নাগাদ চীনে ডাকঘরের সংখ্যা ছিল ১০,০০০-এরও কম, ১৯৩৫-৩৬ সাল নাগাদ এই সংখ্যা বেড়ে হয় ১৪,০০০-এরও বেশি। সমরনায়কতন্ত্রের যুগে চীনে টেলিগ্রাফ লাইন তথা টেলি- যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৯৩৭ সাল নাগাদ ৯৫,৩০০ কিমি জুড়ে টেলিগ্রাফ লাইনের বিস্তার ঘটেছিল।
নানকিং সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল চীনকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য অত্যাবশ্যক পূর্বশর্ত ছিল শিল্পের উন্নতি। জাপান কর্তৃক মাঞ্চুরিয়া অধিকার ও জাপানের সাংহাই আক্রমণের ফলে চীনের বহির্বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু চীন ভারী যন্ত্রপাতি আমদানি কখনোই বন্ধ করেনি। ১৯২৭ থেকে ১৯৩৭. এই ১০ বছর চীন ৫০০ মিলিয়ন চীনা ডলার মূল্যের শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানি করেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও শিল্পের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এসময়ে লক্ষ করা যায়নি। বরং বস্ত্র বুনন, ময়দা, দেশলাই, সিমেন্ট ও রসায়ন দ্রব্য উৎপাদন সংক্রান্ত হাল্কা শিল্পে চীন কিছুটা উন্নতি করেছিল।
শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল নানকিং সরকার। ১৩টি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ৯টি প্রাদেশিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ৬টি প্রযুক্তিবিদ্যা অর্জনের কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। উচ্চশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সরকারের তরফ থেকে আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়েছিল। মাধ্যমিক স্তরেও শিক্ষার সম্প্রসারণের জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছিল।
কুয়োমিনটাং জাতীয়তাবাদী সরকারের শাসনকালে চীনের সাহিত্যক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি লক্ষ করা গিয়েছিল। বেশকিছু চীনা সাহিত্যিক তাঁদের প্রতিভার অত্যুজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তবে এক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার কোনো ভূমিকা ছিল না। বরং এসময়ের প্রায় সমস্ত প্রতিভাবান সাহিত্যিকই ছিলেন উদারপন্থী ও বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী ও চিয়াং- এর নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী কুয়োমিনটাং সরকারের বিরোধী। সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে তাঁরা বেশ কিছু সৃষ্টিশীল সাহিত্য রচনা করেছিলেন।
চিয়াং-কাই-শেকের নেতৃত্বে গঠিত নানকিং সরকার কোনো আয়কর গ্রহণ করত না। ফলে শহরাঞ্চলের সম্পত্তিশালী ব্যক্তির খুব সুবিধা হয়েছিল। অভ্যন্তরীণ শুল্ক (লিজিন) তুলে দেওয়া হয়েছিল। এই সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী নিঃসন্দেহে লাভবান হয়েছিল। চীনের আর্থিক বাজার (Financial market) থেকে নেওয়া ঋণের মাধ্যমে সরকারের রাজস্বের এক-চতুর্থাংশ আসত, ফলে এক শ্রেণীর ফাটকাবাজের জন্ম হয়েছিল এবং সরকারের আর্থিক নীতির আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে এরা যথেষ্ট ধনী হয়ে উঠেছিল। স্বাভাবিক ভাবেই এই ফাটকাবাজ ও শেয়ার দালালেরা চিয়াং সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিল।
চিয়াং কাই-শেক "গ্রামীণ পুনর্গঠন-এর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন এবং এই উদ্দেশ্যে তিনি "নবজীবন আন্দোলন (New Life Movement)-এর প্রচলন করেন। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে কিয়াংসি প্রদেশের রাজধানী নানচাং-এ তিনি 'নবজীবন আন্দোলন সংক্রান্ত ইস্তাহার প্রকাশ করেন। প্রকাশের স্থান হিসাবে কিয়াংসি প্রদেশকে বেছে নেওয়ার কারণ ছিল যে, ঐ অঞ্চলেই কমিউনিস্টরা ছিল সব থেকে শক্তিশালী। এই ইস্তাহারে কুয়োমিনটাং মতাদর্শ প্রচার করা হয়। নয়া কনফুসিয়ান তন্ত্রের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। প্রাচীন কিছু গুণাবলী, যথা-লি (সম্পত্তি), ই (ন্যায়), লিয়ান (সত্য), চি (আত্মমর্যাদা) প্রভৃতির উপর চিয়াং জোরারোপ করেন।
চিয়াং-এর নবজীবন আন্দোলনের ওপর একদিকে খ্রিস্টধর্মের, বিশেষত, প্রোটেস্ট্যান্ট পিউরিটানতন্ত্রের অন্যদিকে ফ্যাসিবাদের প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট। নারীদের ছোটো পোশাক পরিধান করা ও ছোটো চুল রাখার বিরুদ্ধে প্রচারের মধ্যে পিউরিটান তন্ত্রের পরিষ্কার প্রভাব চোখে পড়ে। ফ্যাসিবাদের প্রভাব ছিল আরও স্পষ্ট। হিটলারের ন্যুরেমবার্গ র্যালির কায়দায় কুয়োমিনটাং নেতা ও নবজীবন আন্দোলনের প্রবক্তা চিয়াং কাই-শেক জনসভা সংগঠিত করতেন। সরকারি মদতে নীলকুর্তা বাহিনী গঠিত হয়েছিল এবং তাদের মধ্যে থেকেই নবজীবন আন্দোলনের কর্মীবাহিনী নেওয়া হত।
চিয়াং-কাই-শেকের নেতৃত্বে নানকিং সরকারের মূল্যায়ন নিয়ে স্বাভাবিকভাবে বিতর্কের অবতারণা হয়েছে। ঐতিহাসিক ফেয়ারব্যাঙ্ক নানকিং সরকারের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন যে নানকিং সরকার ছিল চীনের সব থেকে আধুনিক সরকার" (The most modern government China had ever known.)। লুসিয়েন বিয়াকো (Lucien Bianco) বলেছেন, "এই সরকার যত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল, সেই আন্দাজে সরকারের ত্রুটিগুলি ছিল কম মারাত্মক। যেখানে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করত সেখানে এই সরকার শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করেছিল। আধুনিক চীনের বিবর্তনের ক্ষেত্রে এই সরকার একটি সময় ধরে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল"।
অন্যদিকে বেশ কিছু ঐতিহাসিক যেমন- ইমানুয়েল সু, জ্যা শেনো প্রমুখ যুক্তি ও তথ্য সহকারে এটা প্রমাণ করেছিল যে নানকিং সরকার চীনের কোনো উন্নতি ঘটাতে পারেনি। তাদের মতে, জাতীয় অর্থনীতিতে এই সরকার আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সমতা আনতে পারেনি। সরকারি বাজেট সবসময়ই ঘাটতি ছিল। সরকার কোনো আয়কর গ্রহণ করত না। ফলে সম্পদশালী ব্যক্তিদের সুবিধা হয়েছিল। অভ্যন্তরীণ শুল্ক তুলে দেওয়া হয়েছিল। ফলে বণিকদের লাভ হয়েছিল। চীনে কালোবাজারি ও ফাটকাবাজদের স্বপ্নের রাজত্ব শুরু হয়েছিল। ভোগ্যপণ্যের ওপর পরোক্ষ কর চাপানো হয়েছিল ফলে সাধারণ মানুষ বিপদে পড়েছিল।
চিয়াং শাসিত নানকিং সরকারের মূল্যায়ন নিয়ে বিতর্কের মীমাংসায় উপনীত হওয়া অবশ্যই কঠিনতম কাজ। তবে নিরপেক্ষভাবে যদি বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করা যায় তাহলে দেখা যাবে এই সরকারকে বহু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সেইসব সমস্যার মাঝেও তারা প্রশাসনিক যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেগুলোর ফল ইতিবাচক ছিল। বিদেশি শক্তিগুলো এতদিন চীনের ওপর যেসব অসম চুক্তি চাপিয়ে দিয়েছিল সেগুলোকে দূর করার চেষ্টা করেছিল। এ ব্যাপারে তিনি কিছুটা সফল হয়েছিলেন। এর ফলে তাঁর জনপ্রিয়তা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল তা বলাই বাহুল্য।