মেইজি জাপানে কৃষি সংস্কারের প্রভাবগুলির মূল্যায়ন করো।
প্রাচীন কাল থেকেই জাপানের সমাজ নির্ভরশীল ছিল একদিকে কৃষক এবং অপরদিকে জলের উপর। মধ্যযুগেও জাপানের এই অবস্থার বিশেষ কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এই যুগে সে দেশের অর্থনীতিতে কৃষকদের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টকুগাওয়া সোগানদের আমলের শেষ দিকে জাপানের সমগ্র তিন-চতুর্থাংশ ছিল কৃষক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু কৃষকদের মাথা পিছু উৎপাদনের পরিমাণ ছিল খুব কম। তাছাড়া অষ্টাদশ শতকে মুদ্রার মাধ্যমে ভূমি রাজস্ব দেওয়ার প্রচলন হলে কৃষকদের অবস্থা আগেই খারাপ হয়ে পড়তে শুরু করে।
কারণ দেশের অর্থনীতি প্রধানত কৃষি ভিত্তিক হলেও টকুগাওয়া শাসকগোষ্ঠী কৃষকদের স্বার্থের প্রতি কোনদিনই দৃষ্টি দিতে প্রস্তুত ছিল না। কৃষির উন্নতির জন্যও তারা বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এরূপ জমির ফসল অল্পদামে বিক্রি করে কৃষকগণ ভূমি-রাজস্ব প্রকাশ করতে বাধ্য হত। ফলে অনটন ও দারিদ্র্য কৃষকদের নিত্যসঙ্গী রূপে দেখা দেয়। জাপানের কৃষকদের বিশ্বাস ছিল যে করভার বহন করার জন্যই তাদের জন্ম। সুতরাং নির্বিবাদে জমির মালিকের অনেক অন্যায় আবদার তারা সহ্য করতে বাধা হত। নীল, তলা, পাট, তঁত গাছ প্রভৃতি নগদ কৃষিপণ্য শিল্পের স্বার্থে জমিতে চাষ করতে কৃষকদের বাধ্য করা হলে তাদের দুর্দশা আরও বৃদ্ধি পায়ণ।
ঐতিহাসিকদের মতে টকুগাওয়া সোগুনদের সামন্ততান্ত্রিক জাপানে কৃষকদের অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। সামন্ত প্রভুদের কর্মচারীরা এবং খাজনা কমকাদের কৃষকদের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করত। করভারে পীড়িত কৃষকগণ করপ্রদানের জন্য গেনিন নামে পরিচিত মহাজনদের কাছ থেকে ছড়া সুদে অর্থ ঋণ করতে এবং কোনো কোনো সময় জমি বন্ধক রাখতেও বাধ্য হত। এভাবে দারিদ্রা পীড়িত অনেক স্বাধীন কৃষকও গেনিন শ্রেণীতে পরিণত হত। টকুগাওয়া শাসকগোষ্ঠী কৃষকদের এরূপ দুর্দশার কথা সমাকরূপে অবহিত থাকলেও তার প্রতিকারের কোনো বাবস্থা করেনি। এর ফলে মেইজি পুনর্বাসনের সময় জাপানের কৃষক সম্প্রদায় একদিক যেমন ছিল দুর্দশাগ্রস্ত অপর দিকে তেমনই ছিল সমাজে অবহেলিত।
কৃষি সংস্কার ও প্রভাবঃ মেইজি যুগ প্রবর্তনের পর কৃষকরা জমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানা লাভ করে। প্রকৃতপক্ষে শাসন পদ্ধতি যাতে কেন্দ্রীভূত হয় সেই উদ্দেশ্যে উকুগাওয়া সোগানদের পর জাপানের নবগঠিত 'সাত-চো-হি-তো' সরকার সামন্তপ্রথা উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সর্বপ্রথম চোকু নেতা কিগে এবং সাতসুমা নেতা সাইগো ডাইমো হিসাবে পদত্যাগ করে জমি ও প্রজা সংক্রান্ত যাবতীয় দলিল সম্রাটের হাতে সমর্পণ করেন। অন্যান্য ডাইমোগণ তখন তাদের পথ অনুসরণ করে জমিদারি সংক্রান্ত দলিল পত্রাদি সম্রাটের হাতে সমর্পন করে। এভাবে জাপানের কার্যকালে সামন্তপ্রথার অবসান ঘটে।
১৮৭২ খ্রিঃ মেইজি সরকার জমিদারদের সমস্ত জমি অধিগ্রহণ করে কৃষকদের মধ্যে এই জমি বণ্টন করার নীতি গ্রহণ করেন। কিন্তু জমিদারী প্রথার অবলুপ্তি এবং কৃষকদের জমির মালিক হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে কৃষকদের উন্নতির পরিবর্তে অবনতি দেখা দেয়। ১৮৭১ খ্রিঃ জাপানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০% ছিল কৃষির উপর নির্ভরশীল। এর ফলে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হলেও জমির উপর কৃষকদের চাপ বিন্দুমাত্র হ্রাস পায় নি। কিন্তু জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির নির্দেশনামার সাথে সাথেই ঘোষণা করা হয় যে কৃষকগণ ঘোষণা করা হয় যে কৃষকগণ তখন থেকে চালের পরিবর্তে নগদ অর্থে ভূমিরাজস্ব রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে বাধ্য থাকবে।
সাধারণত শস্য সংগ্রহ করার মরশুমে শস্যের দাম কম থাকে এবং এর ফলে কৃষকরা অল্পদামে শস্য বিক্রি করে ভূমি-রাজস্ব পরিশোধ করতে বাধ্য হওয়ায় তাদের যথেষ্ট আর্থিক ক্ষতি সাধিত হতে থাকে। তাছাড়া এই সময় ভূমি রাজস্বের পরিমাণও পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি করা হয়। ১৮-৭২ সালের নির্দেশ অনুযায়ী মোট উৎপন্ন শস্যের এক-তৃতীয়াংশের নগদ মূল্য কর রূপে ধার্য করা হয়। কৃষকদের পক্ষে এই পরিমাণ কর দেওয়ার ফলে তাদের সংসার নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য ঘরে সঞ্চয় করে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
অপরদিকে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে এবং নতুন শিল্পোদ্যোগকে সার্থক করে তোলার জন্য খাদ্যশস্যের পরিবর্তে বাণিজ্যিক কৃষিপণ্য উৎপন্ন করতে কৃষকদের বাধা করা হয়। এর ফলে উৎকৃষ্ট শ্রেণীর বহু জমিই বাণিজ্যিক কৃষিপণ্য উৎপন্ন করার জন্য সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। সরকারের এই নীতিও কৃষকদের খাদ্যশস্যের ঘাটতির অন্যতম কারণরূপে দেখা দেয়। সুতরাং পূর্বে কৃষিক্ষেত্রে ফসল উৎপাদনের সাথে কৃষকদের যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল সে ক্ষেত্রেও পরিবর্তন দেখা দিতে থাকে। তাছাড়া এই সময় বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন কলকারখানা গড়ে ওঠার ফলে অনেক কৃষকই অলাভজনক ও অনিশ্চিত কৃষিকার্যে আত্মনিয়োগ করা অপেক্ষা শ্রমিক হিসাবে কল-কারখানায় নিযুক্ত হতে শুরু করে। এর ফলে জাপানের সমাজজীবনে এক বিরাট পরিবর্তনের সূচনা দেখা দিতে থাকে।
কিন্তু জাপানের নতুন সমাজব্যবস্থায় অন্যান্য সম্প্রদায়গুলো মর্যাদাপূর্ণ স্থান লাভ করলেও কৃষকদের অবস্থার কোনো উন্নতি হবার পরিবর্তে অবনতি হতে শুরু করে। নতুন ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থার প্রচলনের সাথে সাথে সাধারণভাবে কৃষক পরিবারগুলোর প্রবল বিপর্যয় দেখা দেয়। খাজনার হার বৃদ্ধি, খাদ্যশস্যের পরিবর্তে শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট কৃষিপণ্য উৎপাদন, নগদ অর্থে ভূমি-রাজস্ব প্রদানের রীতি প্রবর্তন, সামন্তদের কাছে কর প্রদানের পরিবর্তে সরকারী কোষাগারে কর জমা দেওয়ার প্রথা প্রভৃতি প্রচলিত হলে কৃষকগণ বহু নতুন সমস্যার সম্মুখীন হয়।
পূর্বে প্রাকৃতিক কোনো কারণে জমির ফসল বিনষ্ট হলে ভূস্বামীগণ অনেক সময় দেয় কর মুকুব করে কৃষকদের অর্থনৈতিক ভার লাঘব করার চেষ্টা করত। কিন্তু জমিদারি প্রথার অবসানের সাথে সাথে কৃষকগণ এই সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়। অপরদিকে যে সমস্ত কৃষক পরিবার তুলার চাষ করে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করত, তাদের জীবিকা অর্জন করাও দুরূহ হয়ে ওঠে। কারণ জাপানে উৎপাদিত তুলার মূল্য অপেক্ষা বিদেশ থেকে আমদানি করা তুলার মূল্য অধিক হওয়ায় দেশীয় তুলা বাজারে অবিক্রীত থেকে যায়। এর ফলে কিছু কৃষক পরিবার দারুণ আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। এইসব কৃষকদের অনেকেই চাষবাস পরিত্যাগ করে শহরাঞ্চলে নতুনভাবে জীবিকা অর্জনের চেষ্টা করে।
মেইজি যুগের আবির্ভাবের সাথে সাথে জাপানে সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধনের প্রয়াস শুরু হলেও চিরাচরিত কয়েকটি বিষয়ের অতি দ্রুত পরিবর্তন করা সম্ভব ছিল না। শিল্পের সম্প্রসারণ এবং নগদ অর্থের প্রচলন ব্যাপকভাবে শুরু হলেও কৃষি ও চাষের গুরুত্ব অস্বীকার করা উনবিংশ শতকের সাতের দশকের জাপানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাছাড়া মেইজি সরকার অর্থনৈতিক সংস্কারের দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করলেও শিল্প ও কৃষির মধ্যে সমন্বয় সাধনের কোন সুষ্ঠু উপায় উদ্ভাবন করতে অসমর্থ হওয়ায় তাদের নীতি কৃষি ও কৃষকের উপর প্রবল অর্থনৈতিক চাপের সৃষ্টি করে। তাছাড়া ডাইমো, সামুরাই প্রভৃতি শ্রেণীর লোকেরা নতুন পরিস্থিতির সাথে যত দ্রুত এবং যত সহজে সামঞ্জস্য সাধন করতে সমর্থ হয়েছিল, ঐতিহ্যবাহী কৃষক সমাজের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। এরপ পরিস্থিতিতে মেইলি মুরকায়েলে নেয়ান কৃষি নীতি কৃষক সমাজকে বহু অভূতপূর অর্থনৈতিক সংকটের