ভারতীয় সামন্ততন্ত্র সম্পর্কিত ঐতিহাসিক বিতর্কের উপর একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ লেখো
ভারতের আদি মধ্যযুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সামন্ততন্ত্র ৷ ভারতীয় লেখকদের মধ্যে প্রথম ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের কথা উল্লেখ করেছেন ৷ এছাড়াও বহু ঐতিহাসিক সামন্ততন্ত্র সম্পর্কে নিজ নিজ মত উপস্থাপন করেছেন ৷ তাই সামন্ততন্ত্র একটি বিতর্কিত বিষয়,যা আজও সমান ভাবে বর্তমান ৷
এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের ধারণাটি ইউরোপে সামন্ততন্ত্র থেকে এসেছে ৷ পঞ্চম শতক থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত ইউরোপের সম্মততন্ত্রে প্রচলন হয়েছিল ৷ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের গঠন ছিল পিরামিডের মতো ৷ সবার উপরে ছিল রাজা এবং সবার নিচে ছিল ভূমিদাস ৷ কাল মার্কস বলেছেন সামন্ততন্ত্র ছিল একটি উৎপাদন ব্যবস্থা যা ইউরোপীয় অর্থনীতিকে গতিশীল করেছিল ৷ অপরদিকে ভারতীয় সামন্ততন্ত্র উৎপাদন ব্যবস্থা কে ব্যাহত করে ভারতীয় অর্থনীতিকে গতিহীন করে তুলেছিল ৷
পরবর্তীকালে ভারতীয় ঐতিহাসিকগণ মার্কসীয় তথ্যের উপর ভিত্তি করে উপরিউক্ত মতের বিরোধিতা করেন ছেন ৷ ডি.ডি.কোশাম্বী ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের মতো ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের কথা উল্লেখ করেছেন ৷ যথা-(১).উপর থেকে সামন্ততন্ত্র (২).নিচ থেকে সামন্ততন্ত্র ৷
প্রথমটিতে সরাসরি রাজ্য বা রাষ্ট্র ও জমি প্রদান করত ৷ কিন্তু দ্বিতীয়তে নিচু স্তরের মানুষ শত প্রণোদিত হয়ে একজনকে সামন্ত প্রভু হিসাবে মেনে নিতেন ৷ ঐতিহাসিক রামচরণ শর্মা দ্বিতীয় ধরনের সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেও পরে অস্বীকার করেছেন ৷ তিনি উল্লেখ করেছেন যে সামন্ত ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে রাজা ও কৃষক মধ্যবর্তী ভূস্বামীদের উদ্ভব ঘটে ৷ ফলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিকেনদ্রীভূত হয়ে যায় ৷ অর্থাৎ গতিহীন তার কোন প্রশ্নই নেই ৷ রামচরন শর্মা তার"The indian Feudalism" গ্রন্থে সামন্ততন্ত্রকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন , যথা-(ক). সামন্ততন্ত্রের সূচনা হয়েছিল ৩০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে (খ). মধ্যবর্তী স্তর ৫০০ থেকে হাজার খ্রিস্টাব্দের মধ্যে (গ). শেষ হয়েছিল হাজার থেকে বারোশো খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ৷
সামন্ততান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে তিনটি এলাকায় ভাগ করা যায় যথা (1). প্রতিহার শাসনকালে উত্তর-পশ্চিম ভারত (2).পালদের বাংলা ও বিহার (3). রাষ্ট্রকূট অধিকারভুক্ত দক্ষিণ ভারত ৷
এই ব্যবস্থার মধ্যেই সামন্ততন্ত্রের বীজ নিহিত আছে । অগ্রাহর ব্যবস্থার মধ্যে দিয়েই ব্রাহ্মণরা নিস্কর জমি লাভ করত পরে তা মন্দিরও ধর্মীয় সংগঠনের আওতায় চলে গিয়েছিল ৷ তিনি আরো দেখিয়েছেন ভারতের সামন্ত প্রথার উদ্ভবের অন্যতম কারণ ছিল মধ্যসত্ত্ব ভোগী ও ভূস্বামীদের উদ্ভব ৷ যারা একদিকে রাজকীয় রাজস্বের উপর ভাগ বসাতো অন্যদিকে কৃষকদের কাছ থেকে নানা অজুহাতে কর ও উপকার আদায় করতো ৷
কৃষির ওপর অধিক গুরুত দেয়ার ফলে সেই সময় শিল্প,ব্যবসা-বাণিজ্যের অবক্ষয় দেখা গিয়েছিল ৷ তবে সেসময় রোম ভারত বাণিজ্য সমৃদ্ধি পেলেও সামগ্রিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল ৷ যা ভারতে আবদ্ধ অর্থনীতির সৃষ্টি করেছিল ৷
ভারতের বহু ঐতিহাসিক রামচরণ শরমার এই তথ্যের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন ৷ ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সরকার,ডিডি চ্যাটার্জী প্রমুখ মনে করেন সামন্ততন্ত্র ব্যবস্থার ফলে রাজার ক্ষমতা হাস পেলেও ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিনষ্ট হয়নি ৷ হরবানস মুখিয়া মনে করেন সামন্ততান্ত্রিক যুগে ভারতের উৎপাদন ব্যবস্থার কৃষকদের কর্তৃত্ব বজায় ছিল সেই সময় কিছু চুক্তির ভিত্তিতে রাজা সামন্ত প্রভু ও কৃষকদের মধ্যে উৎপাদন সম্পদ নির্ধারিত হতো ৷ অন্যদিকে ডঃ রণবীর চক্রবর্তী মনে করেন,"রাজারা সেই সময় অনাবাদি জমিকে নিষ্কর জমি হিসাবে প্রদান করতেন তাই কৃষি কেন্দ্রিক অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছিল ৷
পরিশেষে বলা যায় ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের উত্থান ঘটলেও তার কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ছিল যা ভারতীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও অর্থনীতিকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল ৷