রাজেন্দ্র চোলের কৃতিত্ব আলোচনা করো।
চোল রাজাদের ইতিহাসে প্রথম রাজরাজা 'মহান' বিশেষণে ভূষিত। ৯৮৫ খ্রীঃ হইতে তাহার ত্রিশ বৎসরের রাজত্বে চোল সাম্রাজ্যবাদের গৌরব তুঙ্গে উঠিয়াছিল।
সামান্য একটি ক্ষুদ্র রাজ্যকে তিনি বিরাট স্থায়ী দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী-নির্ভর বিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত করিয়াছিলেন। চের বা কেরল রাজ্য সদ্য উত্থিত আরবীয় মুসলমান বণিকদের সমর্থন দিয়া জলপথে পশ্চিম ও পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যে তাহাদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করিতেছিল। মহান রাজরাজা কেরল দখল করিয়া আরব বণিকদের সে স্বপ্ন ব্যর্থ করিয়া দেন। ঐ একই উদ্দেশ্যে তিনি পাণ্ড্য এবং সিংহল রাজ্যও জয় করেন। মালদ্বীপ জয় করিয়া তিনি সামুদ্রিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাহাতে সমুদ্র পথের বাণিজ্যে আরবীয়দের আধিপত্য হ্রাস পায়। তিনি পশ্চিম ও পূর্ব উভয় চালুক্যদের বিরুদ্ধে সফল অভিযান পরিচালিত করিয়াছিলেন। তাঁহার সাম্রাজ্য সমগ্র মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সী, কুর্গ সিংহলের কিছু অংশ, মহীশূর, মালদ্বীপ ও লাক্ষাদ্বীপের দ্বীপগুলি জুড়িয়া বিস্তৃত ছিল। তাঁহার আরব সাগরের মধ্যস্থিত মালদ্বীপপুঞ্জ এবং সিংহলের রাজধানী অনুরাধাপুর বিজয়ের উদ্দেশ্য ছিল ভারত মহাসাগর ও আরব সাগর হইতে আরব বণিকদের ঘাঁটিগুলির উচ্ছেদ সাধন।' কারণ, ঐ দুইটি ঘাঁটিকেই কেন্দ্র করিয়া আরব বণিকগণ ভারতীয় বণিকদের ব্যবসায়ে বাধা সৃষ্টি করিতেছিল। তাঞ্জোরের শিবমন্দির তাঁহারই, কীর্তি।
প্রথম রাজেন্দ্র চোলঃ উপযুক্ত পিতা মহান রাজরাজার উপযুক্ত পুত্র ছিলেন প্রথম রাজেন্দ্র চোল। তাঁহার রাজত্বকাল অসংখ্য দিগ্বিজয়ের কাহিনীতে সমৃদ্ধ। পাণ্ড্যচের রাজ্য জয়ের পর রাজেন্দ্র সিংহল জয় করেন। এই তিনটি রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল ভারত হইতে আরব বণিকদের উৎখাত করিয়া চীনের সহিত দক্ষিণ ভারতের বাণিজ্য পথ সুরক্ষিত করা। ইহা ব্যতীত তিনি পশ্চিম চালুক্যদের ভীষণভাবে পর্যুদস্ত করিয়া তুঙ্গভদ্রাকে চোল ও পশ্চিম চালুক্যদের সীমা চিহ্নিত করিয়া দেন। তাঁহার আর একটি দুঃসাহসী অভিযান ছিল ওড়িষ্যার ভিতর দিয়া বাংলাদেশের প্রথম মহীপালকে পরাজিত করা। তাঁহার সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত সেনবংশীয় সৈনিকগণই পরবর্তীকালে বাংলায় সেনবংশ প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল। সেই বিজয়ের স্মারক হিসাবে তিনি স্বয়ং "গঙ্গাইকোও” উপাধি গ্রহণ করেন এবং ত্রিচিনোপল্লী জেলায় "গঙ্গাইকোও চোলপুরম" নামে একটি রাজধানী-নগর প্রতিষ্ঠা করেন। নগরটি অপরূপ অট্টালিকা শ্রেণীতে শোভিত হয় এবং তথায় বিরাট মন্দির ও জলাশয় নির্মিত হইয়াছিল।
চীনের সহিত দক্ষিণী ব্যবসায়ীদের বাণিজ্য সম্পর্কে শৈলেন্দ্র রাজবংশের নির্দেশ ছিল ভারতের বাণিজ্য-পোত যেন মালয় উপদ্বীপের পরে আর না আসে। সেজন্য শৈলেন্দ্র
রাজ্যের ভারতীয় ব্যবসায়ীদের ভয় দেখানো হইত। শৈলেন্দ্র নৌ-অভিযান রাজ্যের এই অন্যায় হস্তক্ষেপ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে রাজেন্দ্র চোল সে দেশে বিরাট নৌ-অভিযান প্রেরণ করিয়া ঐ রাজ্য জয় করিয়াছিলেন। তাহার ফলে ভারতীয় বণিকদের বাণিজ্য পথ সুরক্ষিত হইয়াছিল। তাহাতে সমগ্র ভারত মহাসাগর বিজয়ী চোলদের দ্বারা তাঁহাদের অধিকৃত হ্রদে পরিণত হইলেও এত দূরদেশ হইতে স্বাদুর শৈলেন্দ্র-সাম্রাজ্য দখলে রাখা দীর্ঘকাল সম্ভব হয় নাই। শৈলেন্দ্র-সাম্রাজ্য দীর্ঘ সংগ্রামের পর চোল অধীনতা-পাশ ছিন্ন করিয়াছিল। তাঁহার রাজত্বকালেই চোল সাম্রাজ্য গৌরবের চরম শিখরে উঠিয়াছিল।