তুর্কী আক্রমণের প্রাক্কালে হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক অনৈক্য সম্পর্কে আলোচনা কর বা, মহম্মদ ঘোরীর ভারত আক্রমণকালে উত্তর ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
একাদশ ও দ্বাদশ শতকে হিন্দু নৃপতিরা আত্মকলহে ও গৃহযুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর কনৌজকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের পাল রাজবংশ, উত্তর ভারতের গুর্জর-প্রতিহার বংশ ও দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূটদের মধ্যে ত্রয়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়েছিল। অষ্টম শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে নবম শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় একশতকের অধিক কাল এই সংঘর্ষ চলতে থাকে। বাংলার পালবংশীয় সম্রাট ধর্মপাল (৭৭০-৮১০ খ্রীঃ) ও দেবপালের (৮১০-৮৫০ খ্রীঃ) প্রভাব উত্তর ভারতে বিস্তৃত হয়েছিল। কিন্তু নবম শতকে গুর্জর-প্রতিহার বংশীয় নৃপতি মিহিরভোজ (৮৩৬-৮৮৫ স্ত্রীঃ) প্রতিহার সাম্রাজ্যের গৌরব পুণরুদ্ধার করেন। সিন্ধু, কাশ্মীর ও পাল রাজত্ব ব্যতীত সমগ্র উত্তর ভারতে তাঁর প্রাধান্য স্বীকৃত হয়েছিল। তাঁর উত্তরসূরী মহেন্দ্রপাল (৮৮৫-৯১০ স্ত্রীঃ) উত্তরবঙ্গের একটি অংশে ও মগধে স্বীয় প্রভুত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। দশম শতকে মহেন্দ্রপালের সাম্রাজ্য হিমালয় থেকে বিন্ধ্যপর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
এই ত্রয়ী প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে দক্ষিণভারতের রাষ্ট্রকূট নৃপতিরাও পরাক্রমশালী ছিলেন। রাষ্ট্রকূট নৃপতি ধ্রুব। (৭৮০-৭৯৩ খ্রীঃ) উত্তর ভারতে সমরাভিযান করে ধর্মপাল ও প্রতিহার নৃপতিকে পরাজিত করেন। পরবর্তীকালে মহেন্দ্রপালের পুত্র মহীপাল রাষ্ট্রকূট তৃতীয় ইন্দ্র কর্তৃক পরাজিত হন এবং কনৌজ রাষ্ট্রকূটদের পদানত হয়। ইহার পর সামন্ত চন্দেল্লা বংশের সাহায্যে প্রতিহারগণ পুনরায় কনৌজ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের পূর্বগৌরব ফিরে আসেনি। চন্দেল্লা, চেদী, পরমার, চালুক্য, তোমর, গাহড়বাল, চৌহান, কলচুরী প্রভৃতি
www.pathagar.com
মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাসের পটভূমি ও তুর্কী বিজয়ের কাহিনী
সামস্ত নৃপতিরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। পূর্বাঞ্চলে পাল রাজারা ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়েন এবং দ্বাদশ শতাব্দীতে বঙ্গদেশে সেন রাজাদের প্রাধান্য স্থাপিত হয়। গুজরাট ও দাক্ষিণাত্যে চালুকা, সুদূর দক্ষিণে চোল নৃপতিদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে প্রতিহার নৃপতি রাজ্যপাল যখন কনৌজে রাজত্ব করছিলেন সেই সময় সুলতান মামুদ কনৌজ আক্রমণ করেন। রাজ্যপাল তাঁর নিকট পরাজিত হন এবং কনৌজ লুণ্ঠিত হয়।
রাষ্ট্রকূট, প্রতিহার ও পালদের মধ্যে শেষোক্ত রাজবংশ বঙ্গদেশ ও বিহারে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল এবং দশম শতকে উত্তর ভারতে প্রতিহারদের দুর্বলতার জন্য প্রাধান্য বিস্তারের সুযোগ লাভ করেছিলেন। পালরাজা মহীপাল পরাক্রমশালী চোল সম্রাট রাজেন্দ্রচোলের বঙ্গদেশে অভিযানের সময় আত্মরক্ষার জন্য স্বীয় উচ্চাকাংখাকে সংযত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কম্বোজ জাতির আক্রমণ ও কৈবর্ত বিদ্রোহের ফলে পাল সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। দ্বাদশ শতকে সেন রাজবংশ, বঙ্গদেশে প্রাধান্য স্থাপন করেছিলেন। বিহারে তুর্কী বিজয়ের প্রাক্কাল পর্যন্ত পাল রাজারা রাজত্ব করেছিলেন। সেনবংশীয় সামন্ত সেন বা তাঁর বংশধর হেমন্ত সেন একটি স্বাধীন রাজবংশ স্থাপন করেন। পরবর্তী সেনরাজা বিজয়সেন একাদশ শতকের শেষার্ধে বা দ্বাদশ
শতকের প্রথমার্ধে পরাক্রমশালী শূর নৃপতিদের সহায়তায় শক্তি বৃদ্ধি করেন। তাঁর পুত্র বল্লালসেন চালুক্য রাজ ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের কন্যা রমাদেবীকে বিবাহ করেন। কথিত আছে যে তিনিই বঙ্গদেশে কৌলীন্য প্রথার প্রবর্তন করেছিলেন। দানসাগর ও অদ্ভুদসাগর নামক দুইটি গ্রন্থ তিনি রচনা করেন। বল্লাল সেনের পুত্র লক্ষ্মণ সেন সম্ভবত ১১৭৮-১১৭৯ বা ১১৮৪-৮৫ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন। আবার কোন কোন পন্ডিতের মতে সেন অব্দের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে ১১১৯ সালে লক্ষণ সেন সিংহাসন লাভ করেছিলেন। তাঁর লিপি থেকে প্রমাণিত হয় যে গৌড়, বঙ্গ ও রাধার উপর তাঁর প্রাধান্য বিস্তৃত ছিল। লক্ষ্মণ সেনের সঙ্গে যুদ্ধে কলিঙ্গ ও কাশ্মীর অধিপতি পরাজিত হন। পাল রাজা মদন পালের ও গাহড়বাল নৃপতি জয়চাঁদের সঙ্গেও তাঁর সংঘর্ষ হয়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বিশৃংখলা ও বহিঃশত্রুর আক্রমণে সেন রাজাদের ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং তুর্কী আক্রমণকারী ইখতিয়ারউদ্দীন মহম্মদ বখতিয়ার খলজীর আক্রমণের সময় রাজধানী নদীয়া থেকে পলায়ন করে (১২০২ খ্রীঃ) পূর্ববঙ্গে (বর্তমান বাংলাদেশে) আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। মিনহাজ লিখিত তবকত-ই-নাসিরীতে বলা হয়েছে যে, মাত্র ১৮ জন অশ্বারোহী সহ বখতিয়ার নদীয়া দখলে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু এই বক্তব্য যে অতিরঞ্জিত তা মিনহাজের বক্তব্য পাঠ করলেই বোঝা যায়। বখতিয়ার ও তাঁর সঙ্গীরা যখন প্রাসাদ আক্রমণে ব্যাপৃত তখন শহরের মধ্যস্থল থেকে প্রচণ্ড চিৎকার ও গোলমাল শোনা যায় বলে মিনহাজ নিজেই স্বীকার করেছেন। এই শব্দ ও. হৈচৈ-র মূল কারণ স্বাভাবিকভাবেই মূলবাহিনীর শহর আক্রমণের ফলশ্রুতি, এ সম্পর্কে সন্দেহ নেই। লক্ষ্মণসেন ও তার বংশধররা ত্রয়োদশ শতকে পূর্ববঙ্গে তুর্কী আক্রমণকারীদের প্রতিহত করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছিলেন। গীতগোবিন্দের লেখক জয়দেব ও পবনদূতের লেখক ধোয়ী লক্ষ্মণসেনের রাজসভা অলঙ্কৃত করেছিলেন।