লেনিনের ভূমিকার বিশেষ উল্লেখ সহ ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবে বলশেভিকদের সাফল্য বিচার কর।
রুশ বিপ্লবে লেনিনের ভূমিকা
রুশ বিপ্লবের প্রধান কারিগর ছিলেন লেনিন। লেনিন তাঁর। আসল নাম নয়, 1902 খ্রিস্টাব্দে পলাতক অবস্থায় যুদ্ধের সময় এই মহান বিপ্লবী ছদ্মনাম গ্রহণ করেছিলেন লেনিন। তাঁর আসল নাম ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ। 1870 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার ভোলগা নদীর তীরে কাজান প্রদেশের সিমব্রিতে তাঁর জন্ম এক মধ্যবিত্ত রুশ পরিবারে। পিতা-মাতা উভয়েই বিদ্যালয় শিক্ষক। বাড়ির আবহাওয়া ছিল প্রগতিশীল। 1887 খ্রিস্টাব্দে তার বড়দাদা আলেকজান্ডার জার তৃতীয় আলেকজান্ডারকে হত্যার ষড়যন্ত্রের জন্য ধরা পড়ে ফাঁসিমঞ্চে প্রাণ দেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যু তরুণ লেনিনের উপর গভীর প্রভাব ফেলে এবং তিনি জারতন্ত্রের পতন ঘটাবার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন।' মেধাবী ছাত্র লেনিনের উপর অগ্রজের বিশেষ প্রভাব ছিল। কাজন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র লেনিনের অপর এক ভ্রাতা ও ভগিনীও পুলিশের নজরবন্দী ছিলেন। ছাত্রাবস্থাতেই এক বিক্ষোভে অংশ গ্রহণ করার জন্য তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। অবশ্য পরে অধ্যয়নের অনুমতি পান। ছাত্র জীবনেই তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে,। সন্ত্রাসবাদী পদ্ধতিতে নয়, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমেই জারতন্ত্রের উচ্ছেদ করতে হবে। তিনি বিপ্লবী দলে যোগ দেন, বিপ্লবী কাজের জন্য পুলিশের নজরে পড়েন এবং রাশিয়া থেকে সাইবেরিয়ার নির্বাসিত হন। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি সুইটজারল্যান্ডের জেনেভায় চলে যান।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
বস্তুত 1898 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি প্রতিষ্ঠিত হলে লেনিন তার সভ্য হন এবং জার-বিরোধী কাজ-কর্মে যুক্ত থাকার অজুহাতেই তাকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল। ঐ নির্বাসনে থাকাকালীন তিনি ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গিনী ক্রুপস্কায়ার সঙ্গে মিলিত হন। 1900 খ্রিঃ রাশিয়ায় ফিরে এলেও পুলিশ তাঁর জীবন অতিষ্ট করে তোলে এবং তিনি সুইটজারল্যাণ্ড চলে যান। সেখানে অবস্থান কালে তার সহযোগী প্লেখানভ এর সঙ্গে মিলিত ভাবে ইস্ক্রা (স্ফুলিঙ্গ) নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এরপর ক্রমেই লেনিন একাধারে তাত্ত্বিক, সংগঠক এবং দেশনেতা হিসেবে খ্যাত হন। 1900 খ্রিস্টাব্দের পর থেকে লেনিন মার্ক্সবাদী দর্শন ও বিপ্লব তত্ত্ব সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় এবং নানা পুস্তকে রচনা প্রকাশ করেন। এগুলির মাধ্যমে রুশ বুদ্ধিজীবী এবং শিক্ষিত মানুষেরা বিপ্লবী ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়।
1903 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির দ্বিতীয় সম্মেলনে নীতিগত প্রশ্নে পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হয়। একদিকে বলশেভিক (বলশেভিক কথাটির অর্থ সংখ্যাগরিষ্ঠ) এবং অন্যদিকে মেনশেভিক (মেনশেভিক অর্থ সংখ্যালঘিষ্ঠ) পার্টি। লেনিন ছিলেন প্রথম দলের অন্যতম নেতা। তাঁর নির্দেশে বলশেভিক দল রাশিয়ার অভ্যন্তরে জারতন্ত্রে উচ্ছেদ, সামন্ত প্রথার অবশসান এবং শ্রমিক কল্যাণের বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে আন্দোলন করে। সংসদীয় প্রথা নয়, রুশ শ্রমিক শ্রেণীয় সাহায্যে মার্ক্সীয় তত্ত্ব অনুযায়ী বিপ্লবী পথেই রুশ জারতন্ত্রের উচ্ছেদের কথা তিনি ভাবতেন। ক্রিস্টোফার হিল লিখেছেন যে, 1903 থেকে 1917 খ্রিস্টাব্দের রাশিয়ার বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকেই মার্ক্সবাদ প্রয়োগ করার কথা লেনিন ভেবেছিলেন। এই বাস্তবসম্মত পন্থা গ্রহণই লেনিনের প্রধান কৃতিত্ব ("That in these years the Bolsheviks had evolved a political philosophy and analysis of events more realistic than those of any of their rivals")।¹
: 1905 খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব ব্যর্থ হলেও লেনিন তাকে পরবর্তী রুশ বিপ্লবের মহড়া বলে মনে করতেন। 1905-র বিপ্লব ব্যর্থ হলে 'দুই রণকৌশল '( Twolactics) শীর্ষক রচনায় লেনিন এই তত্ত্ব প্রচার করলেন যে, রাশিয়ার বুর্জোয়া শ্রেণী দুর্বল, বিপ্লবের দুই স্তরে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্ব কাম্য। মার্ক্সীয় তত্ত্ব অনুযায়ী বিপ্লবের দুটি স্তর কাম্য- প্রথম পর্বে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হবে বুর্জোয়া নেতৃত্বে এবং দ্বিতীয় পর্বে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবে। লেনিনের তত্ত্ব মেনশেভিকরা মেনে নেয় নি। লেনিন অবশ্য স্পষ্ট ভাষায় জানান যে রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ না হওয়াতে আগে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হওয়া শ্রমজীবীদের কারণেই দরকার, কারণ বুর্জোয়াদের দ্বারা স্বৈরতন্ত্রের উচ্ছেদ হলে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ সুগম হবে।
1917 খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়, জারতন্ত্রের অবসান হয় এবং কেরেনস্কির অধীনে অস্থায়ী সরকার (Provisional Government) গঠিত হলে বলশেভিক দল যখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে অনিশ্চিত ছিল, সেই সঙ্কট সময়ে 1917-র এপ্রিল মাসে লেনিন স্বদেশে ফিরে তাঁর 'এপ্রিল তত্ত্ব' (April Thesis) ঘোষণা করেন। এই তত্ত্বের মূলকথা হলো, (ক) অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে কোনও সহযোগিতা না করা, (খ) ক্রমাগত সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধ বিরোধী প্রচার চালানো, (গ) সকল জমির রাষ্ট্রীয় করণ এবং 'সোভিয়েট'গুলিকে সর্বক্ষমতা সম্পন্ন করে তোলা। সোভিয়েত বলতে বোঝায় পরিষদ যা শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল। 1905 খ্রিস্টাব্দে পেট্রোগ্রাড শহরে প্রথম এরকম সোভিয়েত গঠিত হয়। লেনিন বলেছিলেন, 'All powers to the Soviets' অর্থাৎ সোভিয়েত সমূহে বলশেভিকদের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। কী করতে হবে (What is to be done) রচনায় তিনি বিপ্লবের পন্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানান।' কেরেনস্কির অস্থায়ী সরকার জনসাধারণের দুঃখ মোচনে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার কোনও লাভ নেই একথাও লেনিন জানান। যেহেতু জারতন্ত্রের পতনে শ্রমিক শ্রেণীর ভূমিকাই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, সেজন্য মেনশেভিকদের বক্তব্য উড়িয়ে দিয়ে লেনিন অস্থায়ী সরকারের হাত থেকে বলপূর্বক ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। বলশেভিক দলের প্রভাব ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ক্রমেই বিভিন্ন সোভিয়েটে তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হতে থাকে।
'রুটি, জমি ও শান্তি'-এই তিন ধ্বনি দিয়ে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি নভেম্বর বিপ্লব সফল করে। লেনিনের নেতৃত্ব ছাড়া তা সম্ভব ছিল না। 10 অক্টোবর গোপনে তিনি পেট্রোগ্রাড শহরে এসে উপস্থিত হন, বলশেভিকদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের আহ্বান জানান। শেষ পর্যন্ত দুনিয়া কাঁপানো দশ দিনের শেষে 7-৪ নভেম্বর বলশেভিক দল ক্ষমতা লাভকরে। এর আগেই লেনিনের নির্দেশে তার অন্যতম সহকারী ট্রটস্কির নেতৃত্বে লালফৌজ রাজধানী পেট্রোগ্রাডের সরকারি অফিস, ব্যাঙ্ক, রেল স্টেশন, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ প্রভৃতি দখল করে। লেনিনের কৃতিত্ব এই যে, তিনি শ্রমিক, কৃষক, সৈনিক ও বুদ্ধিজীবী সকল শ্রেণীর মধ্যেই বলশেভিক প্রভাব ফেলতে সফল হয়েছিলেন।
লেনিনের রাষ্ট্রনৈতিক প্রতিভা, সাংগঠনিক শক্তি, তাত্ত্বিক ধারণা, বাস্তব পরিস্থিতিবোধ এবং লক্ষ্য স্থির করে তা কাজে পরিণত করার ক্ষেত্রে সাফল্য রুশ বিপ্লবে তাঁর নাম অবিস্মরণীয় করে রেখেছে। তবে তাঁর একক প্রচেষ্টা সফল হত না যদি তিনি দলের ও সহকারীদের সাহায্য না পেতেন। আবার 1917 খ্রিস্টাব্দের বলশেভিক বিপ্লবের পরে বিপ্লবী সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য গৃহযুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের সময় যুদ্ধ কালীন সাম্যবাদ (War Communism) এবং তার পরে নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (New Economic Policy) গ্রহণ করে লেনিন বিপ্লবের স্থায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রেও সমধিক কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।