সুলতান মামুদ ও মহম্মদ ঘুরীর ভারত আক্রমণের প্রকৃতির মধ্যে তুমি কীভাবে পার্থক্য করবে?
ভারতে তুর্কী আক্রমণকারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম মামুদ গজনীর নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁর বারংবার আক্রমণের ফলে উত্তর ভারতের গুরুত্বপূর্ণ শহর, জনপদ ও তীর্থস্থান লুণ্ঠিত হয়। এইসব অভিযানের ফলশ্রুতিতে পাঞ্জাব গজনীর সাম্রাজ্যের অর্ন্তভুক্ত হয়েছিল। গজনীর দরবারের ঐতিহাসিকদের গ্রন্থ ও পরবর্তীযুগের আরবী ও ফার্সী ভাষায় লিখিত ইতিহাস মামুদের গুণাবলীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কারণ কেবলমাত্র দক্ষ সেনাপতি এবং ভারত ও মধ্যএশিয়াতে বিজিত বিস্তৃত সাম্রাজ্যের অধিপতি হিসেবেই নয়, পারসিক সাহিত্যের বোদ্ধা ও পৃষ্ঠপোষক রূপে এবং কবি ও দার্শনিকদের সমঝদার হিসেবেই তাঁকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু শাহনামার রচয়িতা ফিরদৌসি সুলতানের সাহিত্যিকদের লেখনীকে পুরস্কৃত করার ব্যাপারে কার্পণ্য সম্পর্কে ইঙ্গিত করে ব্যাঙ্গাত্মক রচনার মারফতে তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সুলতান মামুদকে ভারতে তুর্কী সাম্রাজ্যের স্থাপয়িতা বলা যায় না। কারণ ভারতে তিনি যে সব অভিযান প্রেরণ করেন সেগুলির ফলে বহু নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় গ্রাম ও নগরের মানুষের ধনসম্পদ, জীবন ও সম্মান বিনষ্ট হয়েছে কিন্তু কোন স্থায়ী সাম্রাজ্য গড়ে ওঠেনি। এইজন্য ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ মন্তব্য করেছেন যে, 'So far as India was concerned Mahmud was simply of bandit opereting on a large scale, who was too strong for the Hindu Rajas, and was in consequence able to inflict much irrerarable damage.
মুইজউদ্দীন মহম্মদ বিন সামকে অনেকে মামুদের সঙ্গে তুলনামূলক ভাবে বিচার করেন। কারণ, তুর্কী সাম্রাজ্য ভারতে প্রতিষ্ঠার মূলে এই দুইজনের অবদান ছিল সর্বাধিক। মহম্মদ ঘুরী তাঁর পূর্বসূরী মামুদের কাছে হিন্দুস্তান বিজয়ের পথিকৃত হিসেবে ঋণী। কিন্তু মামুদের ন্যায় তিনি রণদক্ষ সেনাপতি ছিলেন না। কারণ, মামুদ হিন্দুস্তান ও হিন্দুস্তানের বাইরে যুদ্ধে কখনও পরাজয় স্বীকার করেননি। মহম্মদ ঘুরী সম্পর্কে একথা বলা যায় না। তিনি বহুক্ষেত্রেই পরাজয়ের গ্লানি বহন করে রণভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু মহম্মদ ঘুরীর রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় ভারতে তুর্কী সাম্রাজ্য স্থাপন সম্ভবপর করেছিল। মামুদ তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের সুশাসনের জন্য কোন শাসনপদ্ধতির ভিত্তি স্থাপন করেননি। ফলে পরবর্তীকালে তাঁর দুর্বল বংশধররা এই সাম্রাজ্য রক্ষা করতে অক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু ঘুরীরা গজনী দখল করার পর তুর্কী জাতিগোষ্ঠীদের পুনরায় সংগঠিত করে নেতৃত্ব দান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ঐতিহাসিক ঈশ্বরীপ্রসাদের ভাষায় বলা যায়, 'But the chiefs of Ghori were men of a different stamp. They wre better fitted to lead and command the unruly Turks and knew how to employ their valour and zeal for the purposes of self-aggrandizement."
সুলতান মামুদ বা মহম্মদ ঘুরীর ভারত আক্রমণের মধ্যে একটি বিষয়ে ঐক্য ছিল। এদের মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাসের পটভূমি ও তুর্কী বিজয়ের কাহিনী,দুইজনের মধ্যে কেওই ইসলামের প্রচারের জন্য মহান আদর্শের দ্বারা অনুপ্রানিত হয়ে হিন্দুস্তানে অভিযান প্রেরণ করেননি। রাজ্যজয় ও লুণ্ঠন যে তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এ-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। মামুদের সৈন্যবাহিনীতে এবং মহম্মদ ঘুরীর অভিযানে হিন্দু সৈন্য ও উচ্চপদস্থ সৈনিক ও সেনানীরা রণক্ষেত্রে বিশ্বস্ততার সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। এই উদাহরণের অভাব নেই। মামুদকে যাঁরা ইসলামের গাজী হিসেবে বর্ণনা করেন তাঁদের মামুদের একান্ত সচিব আল-উতবী লিখিত কিতাব-ই-ইয়েমিনিতে যে দুর্ভিক্ষের কথা উল্লিখিত আছে সে সম্পর্কে অবহিত হওয়া কর্তব্য। এই দুর্ভিক্ষে নিশাপুরে মামুদের অজস্র মুসলমান প্রজার অনাহারে মৃত্যু সত্ত্বেও সুলতান তাদের জন্য বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি বা দুর্ভিক্ষের সময় যারা চড়াদাম পাওয়ার জন্য খাদ্য মজুত করেছিল তাদের শাস্তিদানের ব্যবস্থা করেননি। হিন্দুস্তান থেকে লুণ্ঠিত অর্থে মামুদ গজনীর শোভাবর্দ্ধন করেন কিন্তু সাধারণ প্রজার দুঃখ নিরসন করেননি। মহম্মদ ঘুরীর রাজ্যজয়ে যতটা লক্ষ্য ছিল প্রজার সুখ-দুঃখের কথা চিন্তা করার জন্য ততটা সময় ছিল না। যেসব হিন্দু রাজা বিজয়ী তুর্কী বাহিনীর বশ্যতা স্বীকার করে করদ রাজা হতেন তাঁদের রাজ্য সাধারণতঃ দখল করার রীতি ছিল না। আজমীরের সিংহাসনে এইজন্য পৃথ্বীরাজ চৌহানের পুত্রকে মহম্মদ ঘুরী পুনঃস্থাপন করেছিলেন। মূলতঃ তুর্কীরা হিন্দুস্তানে তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে 'মুলুক' বা রাজ্য স্থাপন করেছিল। ধর্মের জেহাদ, যুদ্ধ জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় আওয়াজ হিসেবে অনেক সময় ব্যবহৃত হলেও মূল উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুস্তানের সম্পদ লুন্ঠন। কারণ রিজভীর ভাষায় বলা যায় যে, 'Both were in need of plunder from India to maintain their slave armies and to attract the wandering bands of Islamicized mereanaries known as ghazis to their forces.' অতএব হিন্দুস্তানে ইসলাম ধর্মের প্রসার তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। কোন কোন সমকালীন ফার্সী ও আরবী ঐতিহাসিকদের অতিরঞ্জিত কাহিনীতে তুর্কী বাহিনীর বিজয় সম্পর্কে বিবরণীতে লিখিত মামুদ গজনী ও মহম্মদ ঘুরীকে ইসলামের গাজী হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে। আসলে তারা উভয়েই রাজ্য জয়, রাজনৈতিক প্রাধান্য বিস্তার ও লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যেই হিন্দুস্তানে অভিযান করেছিলেন। এইদিক থেকে উভয়ের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু কার্যতঃ মহম্মদ ঘুরী তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন এবং মামুদের তুলনায় তিনি রণদক্ষতার নিদর্শন রাখতে সক্ষম না হলেও তাঁরই দক্ষতায় হিন্দুস্তানে তুর্কী অধিকার স্থায়িত্ব লাভ করেছিল।
এই সূত্রে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, মামুদ যখন ভারত লুণ্ঠনে লিপ্ত হয়েছিলেন তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি গজনীর সুলতানের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল। সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি গজনীর সুলতানের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল। সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে হিন্দুস্তানের সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো ও বর্ণবৈষম্য জর্জরিত পরিবেশে বিশেষ কোন পরিবর্তন বা উন্নতি হয়নি। মামুদ গজনীর আক্রমনে পাঞ্জাবে তুর্কী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং হিন্দুস্তানের সৈন্যবাহিনীর রণনীতি, সমাজ ও সভ্যতা এবং রাজন্যবর্গের অনৈক্যের বিষয়ে তুর্কীরা অবহিত হয়েছিলেন। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে, মুইজউদ্দীন মহম্মদ ঘুরীকে অনহিলওয়াড়ার দ্বিতীয় মূলরাজ বা পৃথ্বীরাজ চৌহানের ন্যায় শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হবার ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। অপরদিকে খোয়ারজিমের শাহ আলাউদ্দীনের প্রবল পরাক্রান্ত বাহিনী মধ্যএশিয়া এমনকি নিশাপুর ও হিরাট থেকে ১২০১ সালের মধ্যে ঘুরীদের প্রাধান্য উৎখাত করেছিল। এই পরিস্থিতিতে মুইজউদ্দীন হিন্দুস্থানের সাম্রাজ্য ও গজনীতে ঘুরী সাম্রাজ্য যথাক্রমে তাজউদ্দীন ইলদিজ, কুতুবউদ্দীন আইবাক ও অন্যান্য দক্ষ ক্রীতদাস সৈন্যাধক্ষ ও অনুগত অনুচরদের প্রচেষ্ঠায় রক্ষা পায়। ঘুরী সাম্রাজ্য হিন্দুস্তানে পরবর্তীকালে স্থায়িত্ব লাভ করেছিল এবং এইজন্য মামুদ গজনীর ধূমকেতুর ন্যায় উত্থান অপেক্ষা মহম্মদ ঘুরীর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা অধিক প্রশংসনীয় এবং কৃতিত্বের দাবী রাখে।