দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাংলায় তেভাগা আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব আলোচনা করো। Tebhaga movement in Post-Second World War

 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাংলায় তেভাগা আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব আলোচনা করো। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাংলায় তেভাগা আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব আলোচনা করো। Tebhaga movement in Post-Second World War


 কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে তেভাগা আন্দোলন স্মরনীয় অধ্যায়। স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত আগে ও পরে যে সমন্ত্র আন্দোলন ভারতের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ন স্থান গ্রহন করেছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম হল 'তেভাগা আন্দোলন'। ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলার প্রাদেশিক কৃষানসভা এই আন্দোলন সংগঠিত করেছিল। ফ্লাউড কমিশনের সুপারিশ মেনে দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার রামচন্দ্রপুর গ্রামের কৃষকরা জোতদার ও ধনী কৃষকদের কাছে উৎপাদিত ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ নিজেদের অধিকারে রাখার দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে তোলে তা 'তেভাগা আন্দোলন' নামে পরিচিত । ইহা এক কৃষক আন্দোলনেরই রূপান্তর।


 ১৯৪৬ সালের নভম্বর থেকে এই তেভাগা আন্দোলন শুরু হয়েছিল। কারন এই সময়টা ছিল ফসল কাটার সময়। জমি থেকে ফসল ঘরে তোলা বা গোলায় তোলার মরসুম। এই আন্দোলনের অন্যতম স্লোগান ছিল "নিজ খামারে ধান তোলো"। অর্থাৎ ভাগ-চাষিরা তাদের নিজেদের খামারে ধান তুলবে, জোতদারদের খামারে ধান তুলবে না। খুলনা জেলার মৌভাগে যে কৃষকসভার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে কৃষ্ণবিনোদ রায়ের সভাপতিত্বে যেসব প্রস্তাব নেওয়া হয়, তাতেই তেভাগা আন্দোলনের প্রথম পরিকল্পনা গৃহীত হয়।


আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যঃ 

  • ক) হিন্দু-মুসলিম ধর্ম নির্বিশেষে নমশূদ্র, সাঁওতাল, রাজবংশী প্রভৃতি সম্প্রদায় সংঘবদ্ধভাবে এই আন্দোলনে যোগ দেয়। 
  • খ) এই আন্দোলনে মহিলারা গৌরব জনক ভূমিকা পালন করেছিল। জলপাইগুড়ির বুড়িমা, মেদিনীপুরের বিমলা মন্ডল, কাকদ্বীপের বাতাসী, দিনাজপুরের কৃষকবধূ জয়মনি প্রমুখ বীরাঙ্গনারা নারীজাতিকে গর্বিত করেছিলেন।
  •  গ) তেভাগা আন্দোলনের কৃষকদের দাবীগুলি ছিল সম্পূর্ন রূপে কৃষকশ্রেনীর স্বার্থ-সংক্রান্ত। কৃষক আন্দোলনের মাধ্যমেই প্রথম কমিউনিস্ট পার্টির গৌরবজনক ভূমিকায় সমাজের শোষিত শ্রেনী সন্তুষ্ট হয়।



 ভাগচাষিরা মূলত ধনী জোতদারদের জমি ভাড়া নিয়ে চাষ করত। ফলে এই কৃষকরা বেঁচে থাকার জন্য জোতদারদের কাছে ধান কর্জ বা ধার নিত। ফসল তোলার সময় কৃষকদের ওই কর্জ সুদ-সহ শোধ দিতে হত। তারা এই শোচনীয় দূরবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিল। জমিদাররা বিভিন্ন পূজা-পার্বন ও উৎসব উপলক্ষ্যে বছরের বিভিন্ন সময়ে কৃষক পরিবারের ওপর করের বোঝা চাপাত। জমিদারের মর্জির উপর কৃষক-পরিবারের পার্বন, বিবাহ বা মেয়েদের সম্মানরক্ষা নির্ভর করত। আবার জমির অধিকার সত্ত্বাও ছিল জমিদারের ইচ্ছা-নির্ভর।


 ১৯৩৬ -এ প্রতিষ্ঠিত 'সারাভারত কৃষকসভা' দাবী তুলেছিল 'লাঙল যার, জমি তার'। পরে বাংলায় ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত কৃষক-প্রজা পার্টির সরকারের প্রচেষ্টায় বঙ্গীয় প্রজাসত্ব আইন সংশোধিত হয়। এই আইনে ঋনের উপর সুদের উর্দ্ধহার বেঁধে দেওয়ায় কৃষকরা উৎসাহী হয়ে ওঠে। ভারতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব ভয়ঙ্কর রূপে দেখা দেয়। এর প্রভাবে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, নিত্য-প্রযোজনীয় জিনিসের আকাল দেখা দেয়। এর পর ৪৯ -র দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে ভাগচাষিরা ভূমিহীন মজুরে পরিনত হয়। এই সব কারনে তারা বিদ্রোহের পথে যেতে বাধ্য হয়।


আন্দোলনকারীদের দাবীঃ 

তেভাগা আন্দোলনের প্রধান দাবীগুলি হল -

  1. নিজ খোলানে (গোলায়) ধান তোলা, 
  2. আধি (অর্দ্ধেক) নাই, তেভাগা চাই, 
  3.  ধার করা ধানের সুদ নাই, 
  4. আবাদযোগ্য পতিত জমিতে আবাদ করতে হবে।


 উত্তর বাংলা ছিল এই তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম প্রানকেন্দ্র। দিনাজপুরের ঠাকুর-গাঁ মহকুমা, জলপাইগুড়ি, রং-পুর, মালদা প্রভৃতি অঞ্চলে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ, মেদিনীপুরের মহিষাদল, নন্দীগ্রাম, ২৪পরগনার কাকদ্বীপ অঞ্চলের আন্দোলনও উল্লেখযোগ্য।


 মুসলমানদের এক বিরাট অংশ এই আন্দোলনে অংশগ্রহন করেছিল। তবে কোন কোন মুসলমান নেতা, যেমন-কলকাতা ও নোয়াখালির হাজী মহম্মদ দানেশ, নিয়ামত আলি এই আন্দোলনে জোতদারদের নির্যাতনের নিন্দা করেন। তবে দক্ষিন-পূর্ব বাংলা এই আন্দোলনে একেবারে নীরব ছিল। এই সাথে পুলিশী নির্যাতনও বৃদ্ধি পেয়েছিল।


 বর্গাদারদের হাতে লাঠি থাকলেও কোন রাইফেল ছিল না। একদিকে পুলিশী নির্যাতন, অপরদিকে সরকারী বর্গাদারী বিল আইন-সভায় আনয়ন- এই আন্দোলনকে স্তিমিত করে দিয়েছিল। ১৯৪৭ সালে এই আন্দোলনে সংকট দেখা দেয়। বালুর ঘাটের কাছে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে প্রায় আঠারো জন সাঁওতাল প্রান হারায়। কোন কোন অঞ্চলে কৃষকরা অস্ত্র ব্যবহার করতে চাইলেও, ঠিক সেই সময় সাম্যবাদীরা সশস্ত্র সংগ্রামের কথা ভাবে নি। সামাজিক দিক থেকে এর সীমাবদ্ধতা দেখা দিয়েছিল।


 উত্তর-বঙ্গে অনেক জমিদার বা জোতদাররা বর্গাদারদের এই আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন। সাম্যবাদীরা ঠিক এই সময় সাধারন ধর্মঘটের ডাক দেয়। ইতিমধে হিন্দু-মহাসভা বাংলা বিভাগের ডাক দিয়েছিল এবং তা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তেভাগা আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেও বঞ্চিত কৃষকদের ব্যথা-বেদনা ও আর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মানুষের মনে দাগ কেটেছিল। 

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟