ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বরাজ্য দলের গুরুত্ব নিরূপণ করো।
অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে চৌরিচৌরার হত্যাকান্ড অহিংস আন্দোলনের পূজারী মহাত্মা গান্ধীকে বেশ বিচলিত করে এবং এজন্য তিনি অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ করার করার নির্দেশ দেন। এরপর ১৯২২ খ্রিঃ ইংরেজ সরকার অসহযোগ আন্দোলনের ফলে দেশে যে অশান্তি দেখা দিয়েছিল তার জন্য গান্ধীজীকে দায়ী করে। এজনা তাঁকে গ্রেপ্তার করে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। জেলে থাকার ফলে সাময়িকভাবে রাজনীতি ক্ষেত্রে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয় তার জন্য কংগ্রেস দুটি দলে বিভক্ত হয়।
এর একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাস, মতিলাল নেহরু ও বিটলভাই প্যাটেল। তারা গান্ধীর বিদেশী অস্ত্র, আইন-আদালত, স্কুল-কলেজ উপাধি ও আইনসভা বর্জন- এই পাঁচ ধরনের বয়কট নীতিকে কোনোদিনই মনে প্রাণে গ্রহণ করেন নি। তাই গান্ধীজীর অনুপস্থিতিতে এরা কংগ্রেসের উপর প্রাধান্য স্থাপনে সচেষ্ট হন। এঁরা কংগ্রেসের কর্মনীতির পরিবর্তনের পক্ষপাতী ছিলেন বলে এঁদের অভিহিত করা হল 'পরিবর্তন-পন্থী' বলে। আর যারা এঁদের বিরোধীতা করলেন তাঁদের বলা হল 'পরিবর্তন বিরোধী'।
১৯২২ খ্রিঃ কংগ্রেসের গয় অধিবেশনে চিত্তরঞ্জন দাশের উত্থাপিত প্রস্তাব গোঁড়া গান্ধী-সমর্থকদের ভোটাধিকো বাতিল হয়ে যায়। এতে চিত্তরঞ্জন ও মতিলাল নেহরু কিছুমাত্র হতাশ না হয়ে কংগ্রেসের মধ্যে 'স্বরাজাদল নামে' একটি দল গঠন করলেন। দিল্লীতে কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে তাঁরা তাঁদের অনুকূলে প্রস্তাব পাশ করিয়ে দিতে সমর্থন হন এবং আসন্ন নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। স্বরাজ্যদলের নেতা ও কর্মী সকলেই ছিলেন কংগ্রেসের সদস্য। এদের আন্দোলনের পদ্ধতি ছিল আসন্ন আইনসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে আইনসভার ভেতর থেকেই সরকারের জনস্বার্থ বিরোধী কাজকর্মে বাধাদান।
স্বরাজ্যদলের প্রধান কর্মসূচী ছিল- ক) আইনসভায় প্রবেশ করে সরকারের কাজের বিরোধীতা করা, খ) সরকারী বাজেট প্রত্যাখ্যান করা, গ) বিভিন্ন বিল ও প্রস্তাব উত্থাপন করে জাতীয়তাবাদের অগ্রগতিতে সহায়তা করা এবং ঘ) সুনির্দিষ্ট অর্থনীতির নীতি গ্রহণ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শোষণ বন্ধ করা। এককথায় মন্টেও-চেমসফের প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থাকে ব্যর্থ করাই স্বরাজ্যদলের প্রধান উদ্দেশ্য। এই দলের অপর লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থেকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার লাভ করা।
১৯২৩ খ্রিঃ নির্বাচনে স্বরাজাদার বিপুলভাবে জয়ী হয়। মধ্যপ্রদেশে নিরস্তুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, বাংলাদেশে গরিষ্ঠতা এবং উত্তর-প্রদেশ ও আসামে দ্বিতীয়স্থান অধিকার করে। অন্যান্য প্রদেশেও এই সাল সাফলা উপেক্ষণীয় ছিল না। কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে ১৪৫টি আসনের মধ্যে এটি আসন দখল করে। বাংলাদেশের আইনসভায় চিত্তরঞ্জন দাশ এবং কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে মতিলাল নেহরু স্বরাজাদলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এই দল ভারতের রাজনীতিতে কিছুকাল যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে।
স্বরাজদল প্রথমেই সরকারের কাছে কতকগুলি দাবি পেশ করে। এগুলির মধ্যে ছিল রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি, দমনমূলক আইন প্রত্যাহার, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন ও গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করে শাসনতান্ত্রিক সংস্কার প্রবর্তন ইত্যাদি। এই দাবিগুলি সরকার অগ্রাহ্য করলে স্বরাজ্য দল আইনসভাগুলিতে অচল অবস্থার সৃষ্টি করবে বলে ইঙ্গিত দেয়। এ ব্যাপারে স্বরাজ্য দল কেন্দ্রীয় আইনসভায় অন্যান্য দলের সহযোগিতা লাভ করেছিল।
ইতিমধ্যে ১৯২৪ খ্রিঃ গান্ধীজীকে মুক্তি দেওয়া হয়। তাঁর মুক্তিদানের পশ্চাতে ব্রিটিশ সরকারের একটি অভিসন্ধি ছিল, গান্ধীজী ছিলেন আইনসভায় অংশগ্রহনের বিরোধী। তিনি জেলের বাইরে এলে স্বরাজ্য দলের জনপ্রিয়তা ও শক্তি বিপুল পরিমাণে হ্রাস পাবে বলে সরকার আশা করেছিল। কিন্তু গান্ধীজীর সাথে স্বরাজ্যদলের নেতাদের বিরোধ দেখা দেয় নি। বেলগাঁওয়ে ডাকা কংগ্রেসের অধিবেশনে গান্ধী সভাপতিত্ব করলেন এবং এই অধিবেশনে ঠিক হয় স্বরাজাপন্থীরা আইনসভায় তাঁদের ইচ্ছা অনুযায়ী কর্মসূচী গ্রহণ করতে পারবেন। কিন্তু আইনসভার বাইরে তাদেরকে কংগ্রেসের গঠনমূলক কর্মসূচি অনুসরণ করতে হবে। এই অধিবেশনেই স্বরাজ্যদলকে কংগ্রেসের অঙ্গরূপে স্বীকার করা হয়। এভাবে কংগ্রেসের ভাঙনের সম্ভাবনা দূর হয় এবং গান্ধীজীকে মুক্তি দেওয়ায় ব্রিটিশের যে অভিসন্ধি তা বার্থ হয়।
স্বরাজ্য দলের ভাঙন ও অবলুপ্তিঃ
স্বরাজ্যদলের ভাঙন তথা অবলুপ্তির পশ্চাতে বিভিন্ন কারণ পরিলক্ষিত হয়-
প্রথমতঃ চিত্তরঞ্জন দাশের অকলা মৃত্যুর পর তাঁর শূন্যস্থান পূরণকে কেন্দ্র করে দলের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব শুরু হয়। এর ফলে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় এবং জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ক্রমশ দলের প্রাধান্য অবলুপ্তির দিকে এগিয়ে যায়।
দ্বিতীয়তঃ গান্ধীজির বিরূপ মনোভাব এই দলের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। আইন সভায় অংশগ্রহণের রাজনীতি গান্ধীজী কোনোদিনই মনে থেকে মেনে নেন নি। মতিলাল নেহরু ও চিত্তরঞ্জনের সাথে এর একটা বোঝাপড়া হলেও, সেই বোঝাপড়ার কোনো বাস্তব ভিত্তি ছিল না।
তৃতীয়তঃ এই দলের ব্যর্থতার আর একটি বড় কারণ হল, এই দলের কাজকর্মের সাথে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক ছিল না বললেই চলে। অর্থাৎ শ্রমিক-কৃষকদের স্বার্থ নিয়ে এই দল মাথা ঘামায়নি। জমিদার শ্রেণীর কোনো ক্ষতি হোক, বোধ করি তা তাঁরা চাইতেন না।
মূল্যায়নঃ ১৯২৭ খ্রিঃ নাগাদ স্বরাজ্য দলের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব লোপ পাই অল্প দিনের ব্যবধানে এই দলের উত্থান ও পতন ঘটলেও বাংলা তথা ভারতের জাতীয়কট আন্দোলনে এই দলের অবদান উপেক্ষণীয় নয়।-
প্রথমতঃ এই দলের সবচেয়ে বড় অবদান হল, অসহযোগ আন্দোলনের পর সেদ যখন মুহ্যমান ও স্বাধীনতা আন্দোলনের গতি যখন স্তিমিত হয়ে এসেছিল, তখন এই দলের নেতারাই স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। গান্ধীজীর সাথে আন্দোলনের পদ্ধতি নিয়ে এই দলের নেতাদের মতবৈষম্য থাকলেও তাঁদের আদর্শ ও নিষ্ঠার ঘাটতি ছিল না।
দ্বিতীয়তঃ বাংলাদেশের মন্ত্রীপরিষদের উপর এই দল খুবই সতর্ক দৃষ্টি রাখতে সক্ষম হয়। অপরদিকে মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কারের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরতে এই দলের সদস্যরা সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। আইনসভার সদস্য হিসাবে এই সংস্কারের অসারত তাঁরা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেন।
তৃতীয়তঃ সংসদীয় রীতিনীতির আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার কৃতিত্বও তাঁরা দাবি করতে পারেন। জাতীয় কংগ্রেসের প্রাদেশিক সংগঠনের সাথে বিভিন্ন জেলার সংগঠনের গভীর সম্পর্কে গড়ে তোলার জন্য তাঁরা একান্তভাবে চেষ্টা করেন।
চতুর্থতঃ স্বরাজাদল আইনসভায় সরকারি বাজেট ও অন্যান্য আইনের খসজ বিষয়ে আলোচনার দ্বারা জনসাধারণের মনে পরিষদীয় গণতন্ত্র সম্বন্ধে আগ্রহ জাগায়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বরাজ্য দলের এক বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল। একদিকে অসহযোগ আন্দোলন ও অনাদিকে আইন অমান্য আন্দোলনের মতো দুটি বড় গণ-আন্দোলনের মধ্যে পড়ে স্বরাজ্যদলের কর্মধারা বহুলাংশে ম্লান মনে হলেও স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এই দলের গুরুত্ব উপেক্ষণীয় নয়।