স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কে একটি সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লেখো। Swadeshi movement

 স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কে একটি সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লেখো। Swadeshi movement.

স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কে একটি সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লেখো। Swadeshi movement.


 ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ এবং তার প্রতিবাদে স্বদেশী আন্দোলন এক গুরত্বপূর্ন স্থান অধিকার করে আছে। ইংরেজ অত্যাচারের বলিষ্ঠ প্রতিবাদ হিসাবে স্বদেশী আন্দোলন বাঙালীই সর্বপ্রথম করেছিল। বড়লাট লর্ড কার্জন বাংলাকে ব্যবচ্ছেদ করে বাঙালীকে হীনবল করার চক্রান্ত করেন। এই নীতির প্রতিবাদে ভারতবাসী তথা বাঙালী ব্রিটিশ-দ্রব্য বয়কট করে স্বদেশী আন্দোলন শুরু করেন। এই স্বদেশী আন্দোলন ভারতে ব্রিটিশ-ভিত্তি টলিয়ে দেয়। তবে শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।


স্বদেশী আন্দোলনের কারণঃ 


লর্ড কার্জনের বঙ্গ-ব্যবচ্ছেদের ঘোষনার বিরুদ্ধে বাঙালী জাতির প্রতিবাদ রূপে দেখা দেয় স্বদেশী আন্দোলন। কলিকাতা হাইকোর্টের উকিলরা আশঙ্কা করেন পূর্ব-বাংলায় নতুন হাইকোর্ট হলে মক্কেল হারাবেন। সংবাদ পত্রের মালিকরা আশঙ্কা করেন যে, তাদের কাগজ বিক্রি কমে যাবে। এজন্য তারা প্রতিবাদ জানাতে স্বদেশী আন্দোলন শুরু করে। সুতরাং স্বদেশী আন্দোলনের প্রধান কারণ হল বঙ্গ-ব্যবচ্ছেদ। বাংলার স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি চেতনাঃ বাংলা দীর্ঘকাল স্বায়ত্ত-শাসন ভোগ করে প্রবল আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। মুঘল যুগেও বাংলা ছিল পূর্বভারতের মুঘল শাসনের প্রধান কেন্দ্র এবং ঢাকা ছিল সুবাদের আবাসস্থল। ব্রিটিশ যুগের পূর্বে বাংলা তার ঐক্য ও স্বাধীনতা সম্পর্কে সচেতন ছিল। হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলীম সংস্কৃতির সমন্বয়ে বাঙালী সংস্কৃতি চেতনা গড়ে ওঠে। বাংলার লোক-সংস্কৃতি জাতীকে ঐক্য দান করে। কার্জন বাংলা ব্যবচ্ছেদ দ্বারা এই ঐক্যবোধের উপর কুঠারাঘাত করলে স্বদেশী আন্দোলন দেখা দেয়।


 উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ, সমাজ-সংস্কার, ধর্ম আন্দোলন এবং বাংলা সাহিত্যের বিকাশ বাঙালী জাতিকে নব ঐক্যবোধে বলীয়ান করে। কলিকাতা মহানগরী ছিল এই নবজাগরণের কেন্দ্রভূমি ও প্রেরণাস্থল। বাঙালীর মধ্যে জাতিভেদ ও সাম্প্রদায়িক ভেদ থাকলেও নবজাগরণের জোয়ার বাঙালীকে এক নতুনভাবে ও ঐক্যবোধে ভাবিত করে। বঙ্গ- ব্যবচ্ছেদ বাঙালীর এই সংহতিতে আঘাত করায় বাঙালী ক্ষিপ্ত হয়ে স্বদেশী আন্দোলন করে।


 শিক্ষিত, রাজনীতি সচেতন মধ্যবিত্তের কাছে বঙ্গ-ব্যবচ্ছেদ ছিল একটি প্রবল জাতীয় অপমান। জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর বাঙালী ভদ্রলোক সরাকরী চাকুরী ও আইনসভায় সদস্যপদ লাভের দাবী করলেও সরকার তাতে কর্ণপাত না করে বাঙালীদের উগ্রপন্থী, পুঁথিপড়া বাবু বলে অপদস্থ করেন। যেটুকু রাজনৈতিক অধিকার বাঙালীর ছিল বঙ্গচ্ছেদের মাধ্যমে কার্জন তাহাও খর্ব করেন। ফলে দেখা দেয় স্বদেশী আন্দোলন। 


 

 ইউরোপীয় শাসকদের জাতিগর্ব এবং সাধারণ লোকের উপর পাশবিক অত্যাচার শিক্ষিত ভদ্রলোকের মনে ঘৃনা সৃষ্টি করে। ইউরোপীয়রা রেলে, স্টীমারে, রাস্তা-ঘাটে দেশীয় লোকেদের গালিগালাজ, দৈহিক নির্যাতন করে জাত্যাভিমান প্রকাশ করত। নীলচাষীদের উপর নীলকর-সাহেবরা অকথ্য অত্যাচার করত। রেলের প্রথম শ্রেণীর কামরায় ভ্রমন করা ছিল বিপজ্জনক। এসময় বঙ্গচ্ছেদ করলে শিক্ষিত বাঙালী স্বদেশী আন্দোলন করে।


 ভারতে ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালী ভদ্রলোক তারা বাঙালী সংস্কৃতি, সাহিত্য, বিজ্ঞানচর্চা প্রভৃতির জন্য গর্বিত ছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যগ্রন্থে জগৎসভায় বাংলার প্রান প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের 'আনন্দমঠ' উপন্যাস বাঙালীর হৃদয়ে এক মহান আবেগ সৃষ্টি করে। এরফলে বাঙালীর হৃদয়ে জাগে গভীর আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ। বাঙালী ভদ্রলোকের মধ্যে একটা ব্রিটিশ বিরোধী চরমপন্থী মনোভাব জেগে ওঠে। ঠিক এসময় কার্জনের বঙ্গ-ব্যবচ্ছেদ বাঙালীর মর্মে আঘাত করায় স্বদেশী আন্দোলন জেগে ওঠে।


 বাংলার প্রতিটি শহর ও মফঃস্বলে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ওঠে। তা সত্ত্বেও সরকার বঙ্গভঙ্গের ব্যাপারে অটল থাকলে বাঙালী ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ওঠে এবং স্বদেশী আন্দোলন দাবাগ্নির মতো প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে। কলকাতার টাউন হলে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভায় রবীন্দ্রনাথ বলেন, আমাদের গ্রামের শাসন-কার্য আমাদিগকে নিজের হাতে নিতে হবে। সুরেন্দ্রনাথ বজ্রকঠে ঘোষনা করেন-এই বঙ্গভঙ্গ রোধ করবে বাঙালীই। সভার সামনে একটিই প্রস্তাব ছিল- স্বদেশী।


 স্বদেশী আন্দোলন কিছুদিনের জন্য বাংলার বুকে প্রেরণা ছড়ায়। স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের তাঁতে তৈরী 'মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়' মাথায় করে বাড়ী বাড়ী ফেরী করেন। চারিদিকে জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। রবীন্দ্রনাধ বোলপুরে স্থাপন করেন 'ব্রহ্মচর্য আশ্রম বিদ্যালয়'। বাংলায় প্রায় ২৪টি মাধ্যমিক এবং ৩০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়।


আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের উদ্যোগে ভারতবাসীর প্রথম ঔষধ কারখানা বেঙ্গল-কেমিক্যালস্, বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিল স্থাপিত হয়। এছাড়া চীনামাটি, চামড়া, স্বদেশী দেশালাই ও সাবানের কারখানা স্থাপিত হয়। এই স্বদেশী উদ্যোগেই স্থাপিত হয় জামসেদজী টাটার লৌহ-ইস্পাত কারখানা। তাঁত শিল্পের বিশেষ অগ্রগতি হয়। বরিশালে অশ্বিনীকুমার দত্ত স্বদেশ-বান্ধব সমিতি গঠন করে অনেক মামলা-মোকদ্দমা স্বদেশী পঞ্চায়েতের বিচারে মিটিয়ে ফেলেন।


 স্বদেশী আন্দোলনের পরিপূরক হিসাবে বয়কট আন্দোলন শুরু হয়। সুরেন্দ্রনাথ বলেন, ইংরেজকে জব্দ করার অর্থনৈতিক হাতিয়ার। দলে দলে স্বেচ্ছাসেবকরা বয়কট আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সঞ্জীবনী পত্রিকায় প্রকাশিত কৃষ্ণকুমার মিত্রের প্রস্তাব অনুযায়ী ইংরেজ প্রতিষ্ঠিত স্কুল, কলেজ, বয়কট শুরু হয়। শ্রমিকরাও কল-কারখানায় ধর্মঘট করে বয়কট শুরু করেন। সরকারী শিক্ষা, ব্রিটিশ দ্রব্য, ব্রিটিশ আলালত, অফিস সমস্ত কিছুই বয়কট হল এই আন্দোলনের চরিত্র। এজনা স্বেচ্ছাসেবকরা দোকানে দোকানে পিকেটিং চালায়। কিছু দিনের মধ্যেই এই আন্দোলন মরাগাঙে জোয়ার তোলে।


 বঙ্গভঙ্গের দিনটিকে দুখের প্রতীক করে তোলার জন্য স্বদেশী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ আয়োজন করেন। এই দিনে মিলন-চিহ্ন স্বরূপ রাখী বন্ধন ও ক্ষোভ প্রকাশের জন্য অরন্ধন প্রস্তাব সাগ্রহে কার্যকরী করা হয়। ভোরবেলা হাজার হাজার মানুষ গঙ্গাস্নান করে বন্দেমাতরম ধুনিতে একে অপরের হাতে রাখী পরিয়ে দেন।  বিদেশী দ্রব্য বর্জন এবং স্বদেশী দ্রবা ক্রয়ের জন্য কয়েকটি পদ্ধতি অনুসরন করা হয়। সংবাদপত্র, মিছিল, জনপ্রিয় সংগীত ও স্বেচ্ছাসেবকদের পিকেটিং করা হয়। শহর ও মফঃস্বলে ছাত্রদের নিয়ে সমিতি স্থাপন করা হয়। যিনি অনুরোধ সত্ত্বেও বিদেশী পনা বাবহার করবেন, তাকে সমাজে একঘরে করা হয়। ব্যবসায়ীদের বিদেশী পনা বিক্রয় না করতে বাধ্য করা হয়।


 বয়কট ও স্বদেশী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত বার্থ হয়। ইহা ছিল বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা পরিচালিত একটি আন্দোলন বিশেষ। এই আন্দোলনের পিছনে ভারতীয় বুর্জোয়াদের কোনো সমর্থন না থাকায় এই আন্দোলন বার্থ হয়। স্বদেশী আন্দোলনের ফলে বিদেশী দ্রব্যের আমদানী কম হলেও পরবর্তী সময়ে ব্যবসায়ীরা দেশপ্রেমের পরিবর্তে মুনাফাপ্রেমী হয়ে পড়ে। স্বদেশী আন্দোলনের ফলে তাঁত শিল্প, হস্ত-শিল্প ও রেশম শিল্পের কিছুটা উন্নতি হলেও বাস্তবে এই আন্দোলন বাংলার অর্থনীতির উপর ব্রিটিশ প্রাধান্যকে বিন্দুমাত্র আঘাত করতে পারে নি। 



 স্বদেশী আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সুচিত করেছিল। এই আন্দোলনের ফলে বাংলার তাঁত-শিল্প, হস্ত-শিল্প ও রেশম-শিল্পের কিছুটা উন্নতি হয়। এই আন্দোলনে অংশগ্রহন করে বাঙালী জাতি যে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয় তাহাই তাদের পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিতে সাহায্য করে। ফলে স্বদেশী আন্দোলন ব্যর্থ হলেও তাহা বাংলায় যে মরাগাঙে জোয়ার আনে তাতেই দেখা দেয় ভারতের স্বাধীনতা। এদিক থেকে স্বদেশী আন্দোলনের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না।


About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟