বাংলায় সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর ভারত বিভাজনের প্রভাব লেখো।
ভারতীয় সমাজের উপর ভার-বিভাজনের প্রভাবঃ
ভারত বিভাজনের ফলে ভারতীয় সমাজে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ছিল সাম্প্রদায়িক সমস্যা। দেশ বিভাগের ফলে প্রায় ষাট লক্ষ মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিল। তারা ভারতে আশ্রয় নিতে বাধা হয়েছিল। ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেই সংখ্যালঘুদের উপর অমানবিক অত্যাচার শুরু হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ সংখ্যালঘু নিহত হয়েছিল। দিল্লী, পাঞ্জাব, বাংলা, বিহার প্রভৃতি অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। এর ফলে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ বিপন্ন হয়েছিল।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
১৯৪৭ খ্রিঃ সেপ্টেম্বরে দিল্লীর পথে সেনা নামানো হয়েছিল। পুলিশকে কঠোরভাবে এই দাঙ্গা দমনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তার ফলে সাম্প্রদায়িক সমস্যা অচিরেই নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্বায়ন ভারত সরকার প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে সভাতা ও স্বাধীনতা বিপন্নকারী সমস্যাকে সমাধান করতে সক্ষম হয়েছিল। সরকার ভারতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা দিতে সক্ষম হয়েছিল। তার ফলে প্রায় সাড়ে চার কোটি মুসলমান ভারতে রয়ে গিয়েছিল।
তবুও জাতির জনক মহাত্মাগান্ধী সাম্প্রদায়িকতার কাছে নিজের জীবন দিয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার ব্যাপারে গান্ধীজী দুঃখ করে বলেছিলেন, তিনি ঈশ্বরকে জানিয়েছেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিশ্বস্ত ভারতের 'অশ্রু প্লাবিত ভূমি' থেকে তাঁকে তুলে নিতে। ১৯৪৮ সালে ৩০ জানুয়ারী গান্ধীজী এক উগ্র হিন্দুবাদী নাথুরাম গডসের হাতে নিহত হন। গান্ধীজীর শহীদ হওয়ার ঘটনা সাম্প্রদায়িক শক্তিকে একটি বড় ধাক্কা দিয়েছিল। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা মোকাবিলার একমাত্র পথ বলে স্বীকৃত হয়েছে।
ভারত বিভাজনের দ্বিতীয় প্রভাব ছিল ছিন্নমূল পরিবারবর্গের আশ্রয়ের সমস্যার সমাধান করা। ভারত বিভাগের ফলে প্রায় ষাট লক্ষ ভারতবাসীকে গৃহহারা হতে হয়েছিল। তাদের ত্রানের ব্যবস্থা এবং পুনর্বাসনের সমস্যা স্বাধীন ভারতকে বিব্রত করেছিল। স্বাধীন সরকারকে সর্বশক্তি নিয়ে এই সমস্যার সমাধানে নামতে হয়েছিল। এই সমস্যার সমাধান করতে যথেষ্ট সময় লেগেছিল। তবে ১৯৫১ খ্রিঃ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান মোটামুটিভাবে নিষ্পত্তি হয়েছিল।
ভারত বিভাগের ফলে হিন্দুরা পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানে নিরাপত্তার অভাববোধে ভুগছিলেন। হিন্দুদের উপর দৈহিক অত্যাচার বৃদ্ধি পেয়েছিল। পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে পূর্ব পাঞ্জাবে আগত সংখ্যালঘুরা ব্যাপক নরহত্যার সম্মুখীন হয়েছিল। ১৯৪৬ এবং ১৯৫০ খ্রিঃ দাঙ্গার ফলে প্রায় দু-লক্ষ হিন্দু বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবাংলায় আশ্রয় নিয়েছিল। তাছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) সমাজের উচ্চ ও সম্পদশালী ব্যক্তিরা নানারকম নিরাপত্তার অভাবে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন।
পূর্ব পাকিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ হিন্দু পশ্চিম বাংলায় এসেছিলেন। পশ্চিমবাংলার পক্ষে এই সমস্যার সমাধান করা সত্যিই কঠিন ছিল। তবে শেষপর্যন্ত মুখামন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় এবং ভারত সরকারের যৌথ প্রচেষ্টায় এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়েছিল। তথাপি পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম বাংলায় অনুপ্রবেশ আজও বন্ধ করা যায় নি। ১৯৭১ খ্রিঃ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বহু অসহায় হিন্দু পশ্চিমবাংলায় আশ্রয় নেয়। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই সমস্যার সমাধান অত্যন্ত দক্ষতার সাথে করেন।
ভারতীয় সংস্কৃতির উপর ভারত বিভাজনরে প্রভাবঃ
ভারত বিভাজন ভারতীয় সংস্কৃতিতে যথেষ্টই প্রভাব ফেলেছিল। বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বাংলা প্রদেশ। বাংলাতে ব্রিটিশ আমল থেকেই পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এক ভদ্রলোকের শ্রেণী গড়ে উঠেছিল। তারা পাশ্চাত্য শিক্ষার ফসল প্রথম ঘরে তুলেছিল। এরাই পরবর্তীকালে ভদ্রলোক শ্রেণী বলে বিবেচিত হয়েছিল। তাঁরা নিজেদের যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথম সারির নেতারূপে মনে করতেন। তবে বাংলার সামাজিক কাঠামোয় তাদের সংখ্যা ছিল নগণা। গরীব ও অনুন্নত কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর সংখ্যাই বেশী ছিল। তথাপি বাঙালী বাবুরা ব্রিটিশ শাসনের উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। ঊনবিংশ শতকের শেষ এবং বিংশ শতকের শুরুতে 'বাঙালী ভদ্রলোক শ্রেণী'-এ প্রভাব ভারতের রাজনীতিতে অস্বীকার করা যায় না।
কার্জন একথা বুঝেই ১৯০৫ সালে 'বঙ্গব্যবচ্ছেদ নীতি' গ্রহণ করেন। অচিরেই ব্রিটিশ নীতির পরিবর্তন ঘটেছিল। ব্রিটিশ নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল সামরিক বাহিনী ও প্রশাসনে বঙ্গদেশ ছাড়াও অন্যান্য প্রদেশ থেকে শিক্ষিত মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘু শ্রেণীদের নিয়োগ করা। ১৯১১ খ্রিঃ বাংলা থেকে বিহার ও উড়িষ্যাকে পৃথক করা হয়েছিল। ১৯১২ খ্রিঃ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত হয়েছিল। ক্রমশ কলকাতা তথা বাঙালী ভাদ্রলোক শ্রেণীর প্রভাব হ্রাস পেতে শুরু করেছিল।
১৯৪৭ সালে ১৫ আগস্ট ভারতের রাজনীতিতে বাংলার আধিপত্যে এক ব্যাপক আঘাত এসেছিল। ভারত বিভাজন মেনে নিতে হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে পশ্চিম পাঞ্জাবে ও পূর্ব বাংলায় হিন্দু-মুসলমানরা পাশাপাশি বাস করেছিল। বংশপরম্পরায় তাদের মধ্যে এক গভীর সাংস্কৃতিক বন্ধন গড়ে উঠেছিল। লাহোর, ঢাকা কলকাতা হিন্দু-মুসলমানের মিলনে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এই ব্যবচ্ছেদ মেনে নিয়ে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের সম্পর্ক বিপন্ন হয়েছিল।
পূর্ব বাংলার দক্ষিণভাগে হিন্দুরাই বেশী ছিল। তাঁরা ছিল শিক্ষিত ও বিত্তশালী। বরিশাল, দক্ষিণ ফরিদপুর, ঢাকা প্রভৃতি অঞ্চলে হিন্দুরা শিক্ষিত ও প্রভাবশালী ছিল। বেশীর ভাগই ছিলেন জমিদার। তবে তাদের অনেকেই শিক্ষকতার পেশায় যুক্ত ছিলেন। পশ্চিম পাঞ্জাবেও অনেক বিত্তশালী ও প্রভাবশালী হিন্দু পরিবার ছিলেন। কিন্তু দেশভাগের পর হিন্দুদের প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলা, অত্যাচার, হত্যালীলা বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। এভাবে পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম বাংলাতেও অনেক পরিবার চলে এসেছিল।
দলে দলে শিক্ষিত হিন্দুরা কলকাতা, হুগলী, চব্বিশ পরগণা এবং বর্ধমানে প্রবেশ করেছিল। কলকাতায় শরণার্থীদের ভীড় ছিল বেশী। কলকাতায় শিক্ষিত শ্রেণীর কর্মসংস্থানের সুবিধা ছিল। পূর্ববাংলার লোকেদের বলা হত 'বাঙ্গাল' এবং পশ্চিম বাংলার লোকেদের বলা হত 'ঘটি'। অনেক কারিগর গ্রাম বাংলায় না গিয়ে শহরে ও শিল্পাঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিল। যেমন- টিটাগড়। সেখানে পাটশিল্পে বহু লোকের কর্মসংস্থান হয়েছিল।