তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা কর

তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা কর [5/10]
ভারতের অন্যান্য স্থানের মত বাংলায় কৃষক আন্দোলন ছিল নানা ধরনের সামন্ততান্ত্রিক শোষণের শিকার ৷ সারা বছর জমিতে চাষ করেও অনাহার অপুষ্টি দরিদ্র বাধা ও অশিক্ষা ছিল তাদের নিত্য সঙ্গী ৷ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে অক্টোবর মাসে বাংলায় দরিদ্র অত্যাচারিত কৃষকরা জমিদার ও জোরদারদের বিরুদ্ধে এক প্রচলন আন্দোলনের সূচনা করেন যা তেভাগা আন্দোলন নামে পরিচিত ৷ স্বাধীনতা পূর্ব বাংলায় কৃষক আন্দোলন গুলির মধ্যে তেভাগা আন্দোলন ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ৷ বিশিষ্ট মার্কসবাদী নেতা মহাম্মদ আব্দুল্লাহর মতে বাংলাদেশের কৃষক সভার ইতিহাসে এটাই ছিল তখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যাপক ও শক্তিশালী আন্দোলন ৷" অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ বলেন যে," তেভাগা আন্দোলন ছিল বর্গাকার ভাগা চাষীদের ন্যায় অধিকারের আদায়ের সংগ্রাম ৷"
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
জোরদার বা ধনী-ভূস্বামীর কাছ থেকে ভাড়া নেওয়ার জমিতে কর্মরত কৃষকদের বলা হয় বর্গাকার বা ভাগ চাষি ৷ এই কৃষকরা নিজেদের খরচে জোরদার দের জমিতে চাষ করতো এবং বিনিময়ে তাকে উৎপাদিত শস্য তুলতে হতো জোরদারের খামারে । তার প্রাপ্য ছিল উৎপাদিত শস্যের অর্ধেক যা সে কখনোই পেত না ৷ কারণ নানা অজুহাতে তা কেটে নেওয়া হতো । নানা কারণে কৃষকের কাছ থেকে ধান ধার করতে হতো এমনকি ফসল তোলার সময় কৃষকদের সুদ সহ ওই ধান ফেরত দিতে হতো ৷ যার ফলে কৃষকদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে ৷ নানা পূজা-পার্বণ বিভিন্ন কারণে অকারণে কৃষকদের ওপর চাপানো হতো নানা ধরনের করের বোঝা ৷ যেমন কৃষকদের বিবাহ, শ্রাদ্ধ, পার্বণে এমনকি দরিদ্র কৃষক হাটে বাজারেও সামান্য কিছু বিক্রি করতে গেলেও জোরদার জমিদারকে 'তোলা'(Tax) দিতে হতো । এত অত্যাচারের পরে ওই জমিতে ভাগচাসীদের অধিকার কিন্তু স্থায়ী ছিল না ৷ জমিদার ইচ্ছা করলেই তাকে জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারত ৷ কৃষকদের পক্ষে যুগ যুগ ধরে এইসব মেনে নেওয়া বা সহ্য করা অসম্ভব ছিল ৷
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় সর্বভারত কৃষক সভা । ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় এই অধীনস্থ প্রাদেশিক কৃষক সভা । এই কৃষক সভা দাবি তোলে বিনা ক্ষতিপূরনের জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ যায়, লাঙ্গল যার জমি তার ৷ ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কে অনুসন্ধানের জন্য যে ক্লাউড কমিশন গঠিত হয়েছিল ৷ ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে তার রিপোর্ট প্রকাশিত হয় এই রিপোর্টে বাংলার ভাগ চাষিকে উৎপন্ন ফসলের দুই থেকে তিন শতাংশ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয় ৷ এই বছরের বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা তেভাগা দাবি সম্পর্কে প্রস্তাব গ্রহণ করে ৷ বলা যায় এই ব্যাপারে কাজ কিছুই এগোয়িনি ৷ ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে দেখা যায় ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ 30 লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটে এবং এক কোটি মানুষ একেবারে নিঃস্ব হয়ে যায় ৷ ছোট ও মাঝারি চাষীরা তাদের জমি জমা বিক্রি করে ভাগ চাষী বা ভূমিহীন মজুরি পরিণত হয় ৷
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে আগস্ট মাসে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা খুলনা জেলার অধিবেশনে দেবার সমর্থনে প্রস্তাব গ্রহণ করলে ৷ তাদের প্রধান দাবি গুলি হল --
উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ চাই ৷
জমিতে ভাগ চাষীকে অধিকার দিতে হবে ৷
রশিদ ছাড়া কোন ধান দেওয়া হবে না ৷
জোরদার এর পরিবর্তে খামারে ধান তুলতে হবে
এছাড়াও তাদের দাবি ছিল জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ধান পাকার সময়ের দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমা থেকে তেভাগা আন্দোলনের সূচনা হয় । ঠাকুরগাঁও মহকুমায় ভাগ চাষীরা দলবদ্ধভাবে ধান কেটে নিজেদের খামারে তুলতে লাগে সেই সঙ্গে তাদের কন্ঠে ধ্বনিতে ওঠে "তেভাগা চাই"," নিজ নিজ খামারে ধান তোলো"," জান দিব তবু ধান দেব না" জোরদারদের লাঠিয়াল বাহিনী ও পুলিশ বাধা দিতে এলে সংঘর্ষ হয় ৷ মেয়েরা কাঁসার ঘন্টা ও শাক বাজিয়ে পুরুষদের সতর্ক করে দিত, নিজেরা লাঠির, ঝাঁটা, কুলো নিয়ে পুলিশদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতো ৷ শহরে বহু ছাত্র ও কমিউনিস্ট কর্মী ভাগ চাষীদের সংঘটিত করার কাছে অগ্রসর হন এই তেভাগা আন্দোলন বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে ৷ তবে এর প্রধান কেন্দ্র ছিল ঠাকুরগাঁও মহকুমা ৷ অল্পদিনের মধ্যে এই আন্দোলন বাংলার বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ে যেমন রংপুর ,মালদহ , জলপাইগুড়ি, খুলনা, যশোর ,পাবনা প্রভৃতি ৷
সরকারের পক্ষে তেভাগার দাবি একেবারে উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না ৷ জমি থেকে ভাগচাষীদের উচ্ছেদ বন্ধ এবং উৎপন্ন ফসলের দুই থেকে তিন শতাংশ অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয় ৷ নিজ খামারের ফসল তোলার অধিকার ধান ,প্রাপ্তির রশিদ দেওয়ার প্রভৃতি মানা হয়নি ৷ ভাগচাষীদের প্রধান দুটি দাবি স্বীকৃতি হওয়ায় কৃষকদের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা তা দেখা দেয় ৷ আন্দোলন অন্যত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে বিক্ষুব্ধ কৃষকরা জোরদার জমিদারদের গৃহ ও খামার আক্রমণ করলে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় ৷ সরকার নিষ্ঠুর দমন নীতির পথ ধরে বহু কৃষকদের মৃত্যু হয় ৷ শেষ পর্যন্ত ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তেভাগা দাবি মেনে নেয় ৷
এই আন্দোলন একেবারে ত্রুটিহীন ছিল না ৷ এই আন্দোলনের বহু ক্ষেত্রে মুসলিম জোরদারদের বিরুদ্ধে মুসলিম কৃষকদের সংঘটিত করার ব্যাপারে সমস্যা দেখা দেয় । তাছাড়াও নেতৃত্বরা তেভাগার কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল ৷ সমাজ ব্যবস্থার কোন মৌলিক পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলন পরিচালিত হয়নি ৷ এমনকি শ্রমিক শ্রেণীকেও এই আন্দোলনে যুক্ত করা সম্ভব হয়নি ৷ এইসব নানা ত্রুটি থাকা সত্বেও কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে তেভাগা আন্দোলন এক স্মরণীয় অধ্যায় ৷ এই গুরুত্বকে অস্বীকার করার কোন উপায় নাই ।