প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কি অনিবার্য ছিল
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ হলো বিশ্ব ইতিহাসের এক অতি নিম্ন এবং কালিমা লিপ্ত অধ্যায় ৷ লক্ষ কোটি মানুষের অকাল প্রানয়ন বিশ্ব বৃহত্তর ভূখণ্ড জুড়ে ধ্বংসের লেলিহান শিক্ষা বিশ্ব মানবতাকে করেছিল স্তম্ভিত ৷ এই প্রলয়কারী যুদ্ধের সূচনা কেন হয়েছিল বা এই যুদ্ধের জন্য দায়ী কে এর সুনিশ্চিত উত্তর পাওয়া সম্ভব হয়নি । কোন কোন ঐতিহাসিকরা মনে করেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল পূর্ব নির্ধারিত, অথচ আধুনিক ঐতিহাসিকরা বলেন কোন যুদ্ধই পূর্ব নির্ধারিত থাকে না ৷ এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছিল একাধিক কারণে সমন্বয় । যেমন অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ,উগ্র জাতীয়তাবাদ,উপনিবেশ ও বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ৷ পরস্পর বিরোধীরা রাষ্ট্রজোট গঠন একাধিক যুক্তি মরক্কো সংকট,বলকান সমস্যা ইত্যাদি অর্থাৎ বলা যেতে পারে ৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের উপাদান নিহিত ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন দীর্ঘমেয়াদী বৈদিক মনোতাত্ত্বিক,কূটনৈতিক, রাজনৈতিক,সামাজিক ব্যবস্থার অভ্যন্তর ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ামের নেতৃত্বে জার্মান সাম্রাজ্য শুধু ইউরোপীয় রাজনীতিতে নিরঙ্কুশ প্রাধান্য বিস্তারে সশ্রেষ্ঠ ছিল তাই নয় ৷ তারা উগ্র মানসিক এবং সাম্রাজ্যবাদী নীতি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য অনেকটাই দায়ী ছিল এ কথা সত্য ৷ তিনি লোভের বসে বলেছিলেন,"পৃথিবীর যে দিকে তাকায় সেদিকেই হয় ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সের উপনিবেশ জার্মানি ও সূর্যের নিচে বাস করে ৷ তবে এই বিশ্ব যুদ্ধ কেবলমাত্র জার্মানির শ্রেষ্ঠ নয় ৷ মার্কসবাদী ঐতিহাসিকগণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চরিত্রের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা ও বীজ নিহিত ছিল বলে মনে করেন । ডেভিড টমসন বলেছেন পোস্ট ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে মরক্কো সংকট আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে অতি জটিল করে তোলে মরক্কোকে কেন্দ্র করে জার্মান অফ ফ্রান্সের কূটনৈতিক সংঘাত তীব্রতর হয়ে ওঠে। বাণিজ্যিক স্বার্থকে কেন্দ্র করে 1911 সালে ফ্রান্সের সেনা প্রেরণের অজুহাতে কাইজার প্যানথার নামে এক যুদ্ধজাহাজ প্রেরণ করলে ফ্রান্সের সমর্থনেও আবার ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ প্রেরণ করে ফলে পরিস্থিতি অতি সংকরজনক হয়ে ওঠে ৷
বিভিন্ন জাতি অধ্যুষিত বলকান অঞ্চল একাধিক রাষ্ট্রের বিক্ষিপ্ত লোলুপ দৃষ্টির প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন ৷ অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি তুরস্ককে কেন্দ্র করে বলকান সমস্যা জটিল আকার ধারণ করে ৷ বার্লিন চুক্তি ভঙ্গ করে অস্ট্রিয়া বশিনায়া, হারজেগোভিনিয়া নিজেদের স্বার্থে যুক্ত করলে উত্তেজনা বাড়ে ৷ ইতিমধ্যে দার্দিনেলিন প্রণালীতে রুশ যুদ্ধজাহাজ চলাচল কে কেন্দ্র করে অস্ট্রো-রুশ সম্পর্কের নির্ধারণ অবনতি ঘটে, বলকান অঞ্চলে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির ভূমিকা ছোট রাষ্ট্রগুলিকে ক্ষুদ্ধ করে এইভাবে দেখা যায় বলকান অঞ্চলকে কেন্দ্র করে দুটি ব্যয়বহুল যুদ্ধ পরস্পর বিরোধী একাধিক রাষ্ট্রের ঘাত প্রতিঘাত এক বৃহৎ যুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রস্তুত করে ৷
তবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে স্বৈরাচারী অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদী ছিল এই যুদ্ধের প্রধান কারণ ৷ ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের ভিয়েনা ব্যবস্থা জাতীয়তাবাদের ওপর যে সুতীব্র আঘাত হেনেছিল তা পরবর্তী ১০০ বছর ধরে বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে ৷ এই ব্যবস্থার ফলে আয়ারল্যান্ড হল্যান্ড বেলজিয়াম প্রভৃতি রাষ্ট্র অত্যন্ত ক্ষুদ্র হয়ে ওঠে ৷ সার্বিয়া কে নিয়ে অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি অত্যন্ত বিব্রত হয়ে ওঠে ৷ বলা হয়ে থাকে "Serbia was the focal point of triple conflict" অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদের সঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদ যুক্ত হলে পরিস্থিতি অতি জটিল হয়ে ওঠে ৷ উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রচারের এগিয়ে আসেন এক শ্রেনির লেখক ও সাহিত্যিক ৷ জার্মানির ঐতিহাসিক হেনরি ফলটি টস্কি, ফেড্রারিক ভন বনেহার্ডি প্রমুখরা প্রচার করতে থাকেন টিউটনিক জাতির শ্রেষ্ঠত্ব অনুরূপভাবে ইংল্যান্ডে হোমারলি, অ্যাংলো সম্পন্ন জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করতে থাকে যার পরিণাম স্বরূপ জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ত্বরান্বিত হয় ৷
১৮৭০ থেকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ পরস্পর বিরোধী দুটি সশস্ত্র শান্তি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে একদিকে ছিল জার্মানি ইটালি অস্ট্রেলিয়া কে নিয়ে গঠিত "ট্রিপল অ্যালায়েন্স" অপরদিকে ছিল ইংল্যান্ড ফ্রান্স ও রাশিয়াকে নিয়ে গঠিত "ট্রিপল আতাত" এই দুই সামরিক শিবিরের ক্রমবর্ধমান পেশি শক্তির আস্ফালন বিশ্ব রাজনীতির পরিমণ্ডলকে বিষিয়ে তোলে ৷ এ প্রসঙ্গে ডেভিড টর্মসন বলেছেন যুদ্ধের জাতি ও নিরাপত্তার অভাব থেকেই রাষ্ট্র জোটের উদ্ভব ঘটে, যা নিজেই যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়ায় ৷ ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে নগদ ইউরোপের জনসংখ্যার সম্পদ ও শক্তি ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায় ইউরোপের শুরু হয় "এজ অফ মেসি" প্রচলিত কাঠামো ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন ঘটে ফলে সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যায়, শিল্পায়ন ও গণতান্ত্রিকরণ শুরু হলেও তা শেষ হয়নি ৷ ফলে সর্বত্র অশান্তি বিক্ষোভ ধর্মঘট চলতে থাকে ৷
উপরিক্ত কারণগুলির সমন্বয়ে ইউরোপীয় রাজনীতি যখন অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে সেই সময় অস্ট্রিয়ার সিংহাসনের ভাবি উত্তরাধিকারী যুবরাজ ফার্দিনাথ সস্ত্রীক বসিনিয়ার রাজধানীর সেরাজেভো পরিদর্শন এলে ব্ল্যাক হ্যান্ড নামক এক সন্ত্রাসবাদী সংস্থার সদস্য নাভারেলে প্রিন্সেস কর্তৃক ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ২৮ শে জুন নিহত হন ৷ অস্ট্রিয়ার এই কাজের জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করে চরমপত্র দেয় । একমাত্র সার্বভৌমিকতার প্রশ্ন ছাড়া অন্যান্য শর্ত গুলির সার্বিয়া মেনে নেয় ৷ কিন্তু সার্বিয়ার উত্তর অস্ট্রিয়ার মরণপত্র না হয় পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করে আর এর সূত্র ধরে ২৮ জুন ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ৷
এই যুদ্ধ কি অবসম্ভাবী ছিল বা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কি অনিবার্য ছিল তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে ৷ কিন্তু আলোচনা শেষে এই কথা বলা যায় যে ইউরোপকেই এই রণক্লান্ত করার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে সংঘটিত একাধিক ঘটনা যেমন মরক্কো সংকট, বলকান জাতির মুক্তি স্পিয়া, পারস্পরিক সন্দেহের বাতাবরণ, ক্রমবর্ধমান অস্থির প্রসার, উপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের অদম্য ইচ্ছা প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে সামগ্রিকভাবে যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় ৷ তবে যে পরিস্থিতি এই যুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে তা হলো শিল্প বিপ্লব জনিত অর্থনৈতিক ৷ অর্থাৎ একধারে কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদিত পণ্য সামগ্রীর বিক্রর জন্য বাজার তৈরি অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বকে ইউরোপীয় রাজ্যগুলির সাম্রাজ্যের পরিণত করার উগ্রবাসনা এবং বৃহৎ রাষ্ট্র গুলির নায়করা নিজ নিজ আধিপত্য বিস্তারের উদ্যোগ গ্রহণ করে তাদের অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ কে তৃপ্ত করার লক্ষ্যে ৷ কিন্তু তারা একথা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয় যে ,"কারক্ত সফলতা সত্য কিন্তু শেষ সত্য নয় ৷"