চিন-সোভিয়েত সম্পর্কের অবনতির কারণ ওলি লেখ।

১৯৪৯ সালে ১লা অক্টোবর গণ-প্রজাতন্ত্রী চিনের আত্মপ্রকাশ বিশ্ব ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছিল । বহু বাঁধা বিপত্তিকে সামলে মাও সেতুং- এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট চিনের উত্থান এক গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলা ৷ চিনে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠার পর সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছিল । সোভিয়েত ইউনিয়ান সর্বপ্রথম চিনা কমিউনিস্ট সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল । চিনে সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠার পর রাশিয়া আদর্শগত কারণে, চিনকে গ্রহন করেছিল । সাম্যবাদী আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য এই দুই কমিউনিস্ট রাষ্ট্র কাছাকাছি হয়েছিল । ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব রাজনীতি দুই পরস্ত্রর বিরোধী শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল । পুঁজিবাদী দুনিয়ায় আগ্রাসন থেকে নিজেদের কে রক্ষা করার তাগিদে সাম্যবাদী চিন ও সোভিয়েত ইউনিয়ান একত্রে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল । কিন্তু ১০-এর দশকের শেষ দিক থেকে এই সম্পর্কের অবসান ঘটতে শুরু করে বেশ কিছু কারণের ফলে ।

আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
এই বিতর্কের সুচনা কাল হিসাবে চিহ্নিত করা যায় ১৯৫৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সোভিয়েত ইউনিয়ানের কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতী অধিবেশনকে । এই অধিবেশনে ক্রুশ্চেভ স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মারাত্মক অভিযোগ এনেছিলেন । ক্রুশ্চেভের কাছে স্ট্যালিনের চিন্তাভাবনা ছিল অপ্রাসঙ্গিক । এই সময় সোভিয়েত রাশিয়া শান্তিপূর্ণ সহাবসা, শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগীতা, শান্তিপূর্ণ পথে, সমাজতান্ত্রিক উত্তোরণ কে নীতি হিসাবে ও গ্রহণ করেছিল ৷ রাশিয়ার এই নাতিকে মানতে পারেনি এর ফলে দুই শীর্ষ স্থানীয় কমিউনিস্ট দেশের মধ্যে মতাদর্শগত সংগ্রাম শুরু হয়।
১৯৫৮ সালে রুশ বিপ্লনের চল্লিশতম বার্ষিকী পালন অনুষ্ঠানে মাও-সে-তুং উপস্থিত ছিলেন । চিন যে সোভিয়েত রাশিয়ার নতুন নীতিকে মানতে রাজি নয় তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল । সোভিয়েত ইউনিয়ন উন্নত ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত,করেছিল ৷ তাই চিন এগুলিকে মার্কিনদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতে চেয়েছিল । তার মতে স্যোশালিস্ট রা সাম্রাজ্যবাদীদের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী। তিনি সামরিক শক্তি বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে জোটের দ্বারা যুদ্ধে পরাজিত করতে চেয়েছিলেন । কারণ চিন মনে করেছিল যুদ্ধই সব সমস্যার সমাধান করবে । এই জন্যই চিন রাশিয়ার এই নীতিকে মেনে নিতে পারেনি। মতাদর্শগত এই বিতর্ক দুই কমিউনিস্ট দেশের মধ্যে সম্পর্ককে ক্রমশ খারাপ করেছিল ।
১৯৫৭ সালে নভেম্বর মাসের পর থেকে চিন সোভিয়েত খারাপ সম্পর্ক প্রকাশ্যে চলে এসেছিল । ১৯৫৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্শাল টিটোর সাথে সম্পর্ককে ভালো করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিল । রাশিয়ার এই নীতিকে চিন মানতে পারেনি । যুগশ্লাভিয়ার নেতা মার্শাল টিটো ছিলেন চিনাদের চোখে মার্কসবাদ বিচ্যুত বিশ্বাস-ঘাতক নেতা । ক্রুশ্চেভের এই সিদ্ধান্তকে চিন মানতে পারেনি ।
চিন সোভিয়েত সম্পর্কে ফাটল ধরার ক্ষেত্রে আর ও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ১৯৫৯ সালে, ক্যাম্প ডেভিডে সোভিয়েত নেতা ক্রুশ্চেভের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ারের আলোচনা । এই দুই মহান শক্তিধর রাষ্ট্র প্রধানদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা হয়েছিল । এই ধরণের সমঝোতা মূলক পরিবেশে মার্কিনীদের সঙেঙ্গ রাশিয়ার বৈঠককে চিন মানতে পারেনি ৷ চিনের মনে হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ান পুঁজিবাদের সাথে সমঝোতা করে সমাজতন্ত্রের অগ্রগতিকে রোধ করে দিচ্ছে । সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষে বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া আর সম্ভব নয় । চিন সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতি বিরক্ত হয়েছিল এবং এই নীতির কঠোর সমালোচনা করেছিলা ৷
১৯৬২ সালে ভারতের সঙ্গে সীমানাকে কেন্দ্র করে চিন-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়েছিল । চিনের আশা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ান মেহেতু কমিউনিস্টরা তাই সে চিনকে সমর্থন বারবে । কিন্তু চিনের এই আশা পুরণ হয়নি । বরং রাশিয়া ভারতনো সামরিক সাহায্য দিয়েছিল । সোভিয়েত রাষ্ট্রের কাছ থেকে চিন এ ধরনের আচরণ আশা করেনি । এবাই সময় যে কিউবা সংকট শুরু হয়েছিল তাতে ও দুই দেশের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছিল । কিউবা কে নিয়ে সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধময় পরিমিতির সৃষ্টি হয়েছিল । কিন্তু যুদ্ধকে আটকানোর জন্য ক্রুশ্চেভ কিউবাকে দেওয়া ক্ষেপণাস্ত্র ফিরিয়ে নিয়েছিল । বিনিময়ে আমেরিকা কিউবাকে আক্রমণ করেনি । সোভিয়েত ইউনিয়ানের এই ভূমিকাকে চিন মানতে পারেনি ৷
অর্থনৈতিক কারণে ও দুই দেশের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছিল । প্রথম দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ানকে চিনকে আর্থিক সাহায্য, দিয়েছিল । যদিও সেই সাহায্য চিনের প্রয়োজনের তুলনায় কমই ছিল । কিন্তু এই আর্থিক সাহায্যের বিনিময়ে চিনকে অনেক শর্ত মেনে নিতে হয়েছিল । যেমন- সোভিয়েতের সঙ্গে চিনকে বানিজ্য করতে হয়েছিল । চিনকে নিজের ক্ষতি করে কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি করতে হয়েছিল ৷ ফলে দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছিল । এই সব কারণের ফলে দুই কামিউনিস্ট দেশ সোভিয়েত রাশিয়া ও চিনের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছিল । এই বিরোধের ফলে কমিউনিস্ট আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়েছিল । সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার বিরোধ তার প্রতিপক্ষকে অনেক শক্তিশালী করে দেয় ৷