অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি আলোচনা করো। এই আন্দোলন কেন প্রত্যাহৃত হয়?
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে সকল আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দুটি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে সংঘটিত গান্ধীজী পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন। এই আন্দোলনই ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে টলাতে সাহায্য করে। এই আন্দোলন ছিল বেশ শক্তিশালী এবং ভারতবর্ষের অধিকাংশ মানুষ এতে যোগদান করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ ও বিপ্লবকে স্তব্ধ করতে রাওলাট আইনের ন্যায় দমন মূলক আইন প্রনয়ণ করেন। অতঃপর ১৯১৯সালে নৃশংস জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের ফলে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের কাছে ব্রিটিশ শাসনের নিষ্ঠুরতার নগ্নরূপ প্রকাশ পায়। এ সময় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। বিভিন্ন কারণে এই অসহযোগ আন্দোলন দেখা দেয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে স্বায়ত্তশাসনের আশায় ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে সফল করতে গান্ধীজীর আহ্বানে ভারতবাসী সক্রিয়ভাবে দলে দলে এই যুদ্ধে যোগ দেয় এবং যুদ্ধ তহবিলে প্রচুর অর্থ দান করে। কিন্তু যুদ্ধাবসানে শাসন-সংস্কার ছাড়া ভারতবাসীকে স্বায়ত্তশাসন না দেওয়ায় তারা আন্দোলনের পথ গ্রহন করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ভারতবাসীকে চরম অর্থনৈতিক সংকটের মুখে ঠেলে দেয়। খাদ্যাভাব, মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ফাটকাবাজী, বেকারত্ব চরম আকার ধারণ করে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলেও শ্রমিকের মজুরী বৃদ্ধি পায় নি। এর ওপর মন্দা ও শ্রমিক ছাঁটাই ভারতবাসীকে অসন্তুষ্ট করলে গান্ধীজী তাদের নিয়ে অসহযোগ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন।
ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার রাওলাট আইন পাশ করে। এই আইন দ্বারা সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার এবং বিনা বিচারে দন্ড দেওয়া যাবে। এই আইন দ্বারা সংবাদ পত্রের কণ্ঠও রোধ কর হয়। গান্ধীজী এই আইনের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন।
রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গেলে জালিয়ানওয়ালাবাগে নিরস্ত্র জনসমাবেশের ওপর ১৬০০ রাউন্ড গুলি চালিয়ে নারী, বৃদ্ধ ও শিশু সহ নিরীহ মানুষদের হত্যা করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঘৃণায় তাঁর 'নাইট' উপাধী ত্যাগ করেন। এতে গান্ধীজীও ক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলনের পথে নামেন।
ভারতীয় মুসলীমরা তুরস্কের সুলতানকে খলিফা বা মুসলীম জগতের ধর্মগুরু বলে মনে করত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক পরাজিত হলে মিত্রপক্ষ তুরন্ত সাম্রাজ্য নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় এবং সুলতানের ক্ষমতা খর্ব করে। এতে মুসলিম সম্প্রদায় অসন্তুষ্ট হয়ে খিলাফৎ আন্দোলন শুরু করে। গান্ধীজী এই আন্দোলনকে অসহযোগ আন্দোলনের সাথে যুক্ত করে।
অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থতার কারণঃ
গান্ধীজী নিজেই অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় এই আন্দোলন যে ব্যর্থ হয়েছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই আন্দোলন ব্যর্থতার কারণ ছিল-
- সুভাষচন্দ্রের মতে, গান্ধীজীর মতো একজন ব্যক্তির হাতে প্রচুর ক্ষমতা দায়িত্ব থাকার ফলে এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়।
- জহরলাল নেহরুর মতে, এই আন্দোলনকে দীর্ঘস্থায়ী করার মতো পর্যাপ্ত শক্তি জনগণের ছিল না।
- প্রতি অসহযোগ আন্দোলন ছিল রাজনৈতিক আন্দোলন বিশেষ। এর সর খিলাফতের মতো ধর্মীয় আন্দোলনকে যুক্ত করা ছিল দুর্ভাগ্য জনক। অহিংসার জন্শা খিলাফতিদের আস্থা ছিল না।
- সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে সত্যাগ্রহ বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। রবীন্দ্রনাথের মতো চিন্তাশীল ব্যক্তি সত্যাগ্রহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি মনে করতেন স্কুল-কলেজ বর্জন নিছক শূণ্যতার নৈরাজ্য সৃষ্টি করেন।
- কংগ্রেসের কিছু নেতা অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচীতে বিশ্বাসী ছিলেন না। গান্ধীজীর কাউন্সিল বর্জনের কর্মসূচীকে চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিলাল নেহরু প্রমুখ সমর্থন করেন নি।
এই সকল উপরিউক্ত কারণে অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থ হয়।