রোম-ভারত বাণিজ্য সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো। Rome-India trade

রোম-ভারত বাণিজ্য সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

রোম-ভারত বাণিজ্য সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

রোম-ভারত বাণিজ্য সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।


মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর রাজনৈতিক দিক থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে কোনো একটি শক্তির একক আধিপত্য পরিলক্ষিত হয় না, বরং একাধিক দেশীয় ও বৈদেশিক শক্তির যুগপৎ অস্তিত্ব এবং তাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড দ্বারা উপমহাদেশ পরিচালিত হয়েছিল প্রাক গুপ্তআমল পর্যন্ত। এই রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে এ যুগে ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল সদা প্রবহমান। যার মধ্য দিয়ে পূর্ববর্তী যুগের সঙ্গে সঙ্গতি ও ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়েছিল। এই ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম দিক ছিল রোম-ভারত বাণিজ্য যা ভারতবর্ষের অর্থনীতিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। 


প্রাচ্যের ইতিহাসে রোম-ভারত বাণিজ্য একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। ভারতের সঙ্গেঙ্গ রোমের বাণিজ্য শুরু হয় আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী নাগাদ এবং তা প্রায় খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতক পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক রোম এবং ভারতের শাসকদের আন্তরিক প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে স্থাপিত হয়েছিল। প্লিনি, টলেমি, পেরিপ্লাসসহ একাধিক গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, রোমান সম্রাট অগাস্টাস খ্রিস্টপূর্বাব্দ ২৫ অব্দে ভারতের উদ্দেশ্যে অভিযান পাঠিয়েছিলেন। আবার স্ট্যাবোর রচনা থেকে জানা যায় যে, জনৈক পাণ্ডারাজা অগাস্টাসের সভায় দূত প্রেরণ করেছিলেন এবং এথেন্সে তাঁদের সাক্ষাৎ হয়। একাধিক ঘটনার প্রতিক্রিয়া যেমন এই সময়ে সুগঠিত রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা, ভারতে কুষাণ সাতবাহন, শকদের সুগঠিত আধিপত্য, বিস্তারিত বাণিজ্যপথ এবং সর্বোপরি আরব সাগরে মৌসুমি বায়ুর ব্যবহার এই বাণিজ্যকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।


সুবিখ্যাত এই বাণিজ্য স্থলপথ এবং সমুদ্রপথ উভয় মাধ্যমেই হত এবং এই বাণিজ্যে উত্তর ও দক্ষিণ ভারত পৃথকভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে মূলত দক্ষিণ ভারতের সমুদ্র বাণিজ্য ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য ও লাভজনক। পশ্চিম এশিয়া ও ভূমধ্যসাগর এলাকার যবন বণিকরা দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে যেমন-পন্ডিচেরির আরিকামেডু, মাদুরাই, মুজিরিস-এ বসতি স্থাপন করেন। এই এলাকাগুলিতে তৎকালীন বিখ্যাত বন্দর ছিল। সম্প্রতি খনন কাজে আরিকামেডু থেকে একাধিক রোমান পণ্য যেমন অ্যামফোরা, কাচ, মুদ্রা পাওয়া গেছে যা থেকে বাণিজ্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মাদুরাই-এর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রোমের তাম্রমুদ্রা ও সিংহলেও নানারকম পণ্য ও মুদ্রা পাওয়া গেছে। সংগম সাহিত্য থেকে কাবেরীপত্তনম্ শহরের কথা জানা যায়, যা টলেমি খাবেরিস নামে উল্লেখ করেছেন। এটি বিখ্যাত বন্দর ছিল।


রোম-ভারত বাণিজ্যের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় অজ্ঞাতনামা লেখকের 'পেরিপ্লাস অব দ্য এরিথ্রিয়ান সী' গ্রন্থে। এতে বলা হয়েছে, ইথিওপিয়ার পশ্চাত অঞ্চলে হাতির দাঁত এবং সোনা পাওয়া যেত এবং এখানে ভারতীয় মসলিনের বাজার ছিল। সকোট্রা দ্বীপে ভারতীয় জাহাজ চাল, গম, সুতিবস্ত্রসহ একাধিক পণ্য নিয়ে আসত, বিনিময়ে এখান থেকে কচ্ছপের খোলা নিয়ে যেত। সিন্ধু তীরস্থ বারবারিকম্, ভূগুকচ্ছ প্রভৃতি বন্দর থেকে মশলা, মসলিন, রেশমি সুতো, নীলকান্ত মণি, হিমালয়ের ঔষধিসহ একাধিক পণ্য বিদেশে রপ্তানি হত। আর মুস্তা, রং, মদ, খেজুর, স্বর্ণপাত্র ক্রীতদাস প্রভৃতি আমদানি করত। বিভিন্ন বিলাসসামগ্রীও রপ্তানি হত এবং সবথেকে উল্লেখযোগ্য ছিল দক্ষিণ ভারতের মশলা বিশেষত গোলমরিচ। প্লিনির বর্ণনা থেকে জানা যায়, ভারতীয় চিনির কদর আরবীয় চিনির থেকে বেশি ছিল। বিভিন্ন পশুপাখি যেমন, সিংহ, বাঘ, তোতাপাখি রোমে রপ্তানি করা হত।


পেরিপ্লাস গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ছোটো, মাঝারি ও বড়ো-এই তিন ধরনের নৌযান বাণিজ্যের জন্য ব্যবহার করা হত। ছোটো যানগলি বদ্বীপ ও উপকূল অঞ্চলে যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা হত। মাঝারি নৌকা অর্থাৎ, সাংগারা যেগুলি বড়ো গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি হত এবং কোলান্দিয়া নামে বড়ো জাহাজগুলি দূর সমুদ্রে পাড়ি দিত। রোম-ভারত বাণিজ্যের আমদানি-রপ্তানির তালিকা থেকে এই বাণিজ্যের ভারসাম্য যে রোমের অনুকূলে ছিল না, তা সহজেই অনুমান করা যায়। প্লিনি অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে মন্তব্য করেছেন, আমাদের বিলাসিতা ও নারীদের জন্য প্রচুর সম্পদ ভারতে চলে যেত, যার পরিমাণ প্রায় চার লক্ষ পাউন্ড মূল্যের সোনা।


রোম-ভারতের মধ্যে যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘ প্রায় ৪০০ বছর ধরে প্রবাহমান ছিল তার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্যও ছিল। অর্থনৈতিক প্রভাব মূলত দক্ষিণ ভারতে এবং উত্তরে গ্রিক-রোমান ভাবধারার একটা বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। ভারতীয় মুদ্রা, গ্রহ-নক্ষত্র, বিজ্ঞান, বৌদ্ধধর্মে এবং শিল্পের প্রভাব বিশেষ লক্ষণীয়। গান্ধার শিল্প ছিল এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। সংস্কৃত সাহিত্যে গ্রিক, রোমান তথা লাতিন শব্দ গৃহীত হয়। এর পাশাপাশি ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি দ্বারা পাশ্চাত্য জগৎও প্রভাবিত হয়। বুদ্ধের জন্ম বৃত্তান্ত দ্বারা খ্রিস্টান ধর্ম বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। স্থাপত্যের ক্ষেত্রে গির্জা এবং চৈত্যগৃহের অভূতপূর্ব সাদৃশ্য বিশেষভাবে এই সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।


তাই আলোচনা শেষে বলা যায়, মৌর্য পরবর্তী ও গুপ্ত পূর্ববর্তী যুগে রোম-ভারত বাণিজ্য ওপরে উল্লিখিত একাধিক দিক থেকে বিশেষ তাৎপর্য বহন করেছে। দুই দেশ-ই এই বাণিজ্যের সূত্রে একে অপরের সংস্কৃতি দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রেও একাধিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষত দক্ষিণ ভারতে রোমান উপনিবেশের সূত্রে সমাজে নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আবির্ভাব ঘটে। তবে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে রোমান সাম্রাজ্য বর্বর জাতির আক্রমণে বিধ্বস্ত হয় এবং নাটকীয়ভাবে এই সুদীর্ঘকালব্যাপী প্রচলিত বাণিজ্যের অবসান ঘটে ৷

তোমাকে অনেক ধন্যবাদ রোম-ভারত বাণিজ্য সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো। Rome-India trade এই নোটটি পড়ার জন্য

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟