কুষাণদের রাষ্ট্রনীতি কীভাবে ধর্মদ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল আলোচনা করো।
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের (১৮৭ খ্রিঃপূঃ) পর উপমহাদেশে কোনো বৃহৎ সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত না হলেও মধ্য এশিয়া থেকে আগত যাযাবর গোষ্ঠীদের মধ্যে অন্যতম কুষাণরা উত্তর ভারতে এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের পর। সদ্য আবিষ্কৃত রবাতক লেখ থেকে জানা যায় যে, কুষাণদের সাম্রাজ্য অক্ষু নদী থেকে ভারতের বিহারে শ্রীচম্পা (ভাগলপুর) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এছাড়া ভারতের উজ্জয়িনী, সাকেত, কৌশাম্বী, পাটলিপুত্র, গুজরাটসহ মধ্য এশিয়ার তাসখন্দ, কাশগড় (খাটান ও সগদিয়ানা) প্রভৃতি অঞ্চলও কুষাণ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এত বিশাল সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে কুষাণ সম্রাটগণ বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। যার মধ্যে ধর্ম ছিল একটি বিশেষ ক্ষেত্র।
কুষাণ সাম্রাজ্যে বিভিন্ন ধর্মীয় মতাদর্শের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। যার প্রমাণ মথুরা থেকে ৯ মাইল দূরে অবস্থিত 'মাট' নামক প্রত্নস্থল থেকে প্রাপ্ত দেবালয়; আফগানিস্তানের সূর্যকোটাল থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন ভগ্নস্মৃতি ও রবাতক লিপি থেকে পাওয়া যায়। লক্ষ্যণীয় যে, দেবদেবীর মূর্তির পাশাপাশি কুষাণ সম্রাটদের ভগ্ন মূর্তিও পরিলক্ষিত হয়। তাই অনুমিত হয় যে, কুষাণ সম্রাটদেরও দেবতাজ্ঞানে পুজো করা হত। সুতরাং, কুষাণ সাআজ্যে প্রচলিত ধর্মীয় ভিন্নতার পাশাপাশি কুষাণ সম্রাটদের নিজস্ব উপাসনারীতির (Con প্রচলন ঘটেছিল। কুয়াশ সম্রাটগণ নিজেদের কখনো দেবতা বা কখনো 'দেবপুত্র বয়ো অভিহিত করতেন এবং দেবকুলে নিজেদের মূর্তিও স্থাপন করান।
দেবালয় ও রবাতক লিপিতে প্রাপ্ত বিভিন্ন দেব-দেবীর মধ্যে যেমন ইরানিয়, হেলেন দেব-দেবীর নাম পাওয়া যায়, তেমনই ভারতীয় ব্রাহ্মণা দেবতা ও গৌতম বুদ্ধে উপস্থিতিও পরিলক্ষিত হয়। যার প্রতিফলন কুষাণ মূদ্রাতেও ঘটেছে। ইরানিয় দেব-শৌচ মধ্যে প্রথমেই ননা-যিনি আবেস্তীয় ধারণা অনুযায়ী রাজতন্ত্রের কেন্দ্রে অবস্থিত। উত্তর-পশ্চিম ভারতে নানা বা ননা খুবই শ্রস্থেও ও শক্তিশালী। তাছাড়া তিনি কুষাণদে রাজত্ব দানকারী হিসাবেও বন্দিত। এছাড়া ওম্মা বা উমা, ফারো আহুর মাজদা, মজদয়ানে। আশা, মাওসেন (মহাসেন) প্রমুখ ছিলেন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ইরানিয় দেবদেবী।
গ্রিক তথা হেলেনীয় দেবদেবীর আরাধনাও কুষাণ আমলে প্রচলিত ছিল। কুদ কদফিসেসের কিছু মুদ্রায় ও যুবিদ্ধের তাম্রমুদ্রার গৌণ দিকে গ্রিক দেবতা হেরাক্লেস-এর মূর্তি দেখা যায়, যাঁকে ভারতীয় দেবতা বাসুদেব কৃত্বের সঙ্গে অভিন্ন হিসাবে মনে করা হয়। তক্ষশিলা থেকে আবিষ্কৃত মুদ্রা থেকে জিযুস-এর প্রতিকৃতি পাওয়া গেছে-যিনি ইন্দ্রের সঙ্গে তুলনীয়। কণিদ্ধের মুদ্রায় গ্রিক দেবতা হেলিয়াস সূর্যদেবতা হিসাবে পুজিত, চন্দ্রদেবতা। সেলিন ও হিফায়েস্টাস-এর প্রতিকৃতিও উৎকীর্ণ হয়েছিল।
ভারতীয় দেব-দেবীর মধ্যে ব্রাহ্মণ্য দেবতারা যেমন ছিলেন, তেমনি গৌতম বুদ্ধকে। কুষাণ দেবালয়ে স্থান দেওয়া হয়েছিল। বিম কদফিসেস ও প্রথম কণিষ্কের মুদ্রায় শিবের মূর্তি অঙ্কিত হয়েছিল। আবার প্রথম বাসুদেবের মুদ্রায় ত্রিমুখবিশিষ্ট শিবের মূর্তি খোদিত হয়েছিল। শিব ছাড়া কার্তিক, উমা বা পার্বতীও পূজিত হতেন। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অপর বিখ্যাত দেবতা ছিলেন বাসুদেব-কৃষ্ণ। কুষাণসম্রাট কণিষ্ক ছিলেন বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। তাঁর স্বর্ণ ও তাম্রমুদ্রায় বৃদ্ধের মূর্তি বিভিন্ন ভঙ্গিতে উৎকীর্ণ হয়েছে। একটি মুদ্রায় দেখা যায়, বুদ্ধ উপবিষ্ট অবস্থায় একটি হাত বুকে এবং অপর হাতে বোতল ধরে আছেন। বুদ্ধের অভা মুদ্রা ভঙ্গিতে অবস্থানও কুষাণযুগের বেশ কয়েকটি মূদ্রায় পরিলক্ষিত হয়।
ধর্মীয় ভাবাবেগ বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কুষাণরা মুদ্রাকে সুচতুরভাবে ব্যবহার করেছিলেন। ব্যাকট্রিয়াতে দীর্ঘদিন ইরানিয়রা বসবাস করতেন। তাঁদের পূজিত দেব-দেবীর মূর্তিযুক্ত মুদ্রা প্রচলন করে ব্যাট্রিয়াবাসীর মন জয় করতে চেয়েছিল কুষাণরা। আবার উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে গ্রিকরা অবস্থান করত। তাদের দেবতাদেরও কুষাণ্যরা। গ্রহণ করেছিলেন। এই সকল দেবদেবীর পাশাপাশি কুষাণ সম্রাটগণ ভারতীয় দেব-দেবী। এবং নিজেদের মূর্তিও দেবালয়ে স্থাপন করেছিলেন। মথুরা থেকে প্রাপ্ত কণিদ্ধের মস্তকহীন মূর্তি যেখানে কণিষ্ক মধ্য এশিয়ার যাযাবরের পোশাক পরিহিত-এর মধ্য দিয়ে কনিদ্ধ নিজেদের মথুরা অঞ্চলের থেকে পৃথক সেটি বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন এবং তারা যে পুজোর যোগ্য এটি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন-এ অভিমত ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের।
কুষাণ সম্রাটদের মুদ্রায় বিভিন্ন দেব-দেবীর প্রতিকৃতি অঙ্কন, রবাতক লিপিতে উল্লিখিত দো-দেবীর নাম ও দেবালয়গুলিতে ভগ্নমূর্তিগুলির অবস্থান এগুলি একটি বিষয়ে ইঙ্গিতে দেব যে, কুষান সম্রাটগণ সাম্রাজ্যে অবস্থানকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ সম্পর্কে অবগত উলেন। আর এই সমস্ত কার্যাবলি তারা শুধুমাত্র ধর্মীয় উদ্দেশ্যসাধনের জন্য করেছিলেন, তা বলা যাবে না। আসলে মুদ্রাগুলি প্রচারের মাধ্যম হিসাবে কাজ করেছিল। সাম্রাজ্যে সংশিত বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে সাম্রাজ্যিক ঐকা বজায় রাখার প্রচেষ্টা ছিল এর কর্মগুলি। কুষাণ সম্রাটগণ ভারতীয় দেব-দেবী ও বুদ্ধকে গুরুত্ব দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয়দের জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছিলেন। সুতরাং বলা যায় যে, রাষ্ট্রনৈতিক ঐক্য ও সাহতি স্থাপনে কুযাণরা ধর্মকে খুব সুনিপুণভাবে রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে একাত্ম করেছিলেন।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ কুষাণদের রাষ্ট্রনীতি কীভাবে ধর্মদ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল আলোচনা করো। state policy of the Kushans influenced by religion এই নোটটি পড়ার জন্য