সমুদ্র গুপ্তের কৃতিত্ব আলোচনা কর / উত্তর ও দক্ষিণ ভারত বিজয়ের সমুদ্র গুপ্ত অনুষ্ঠিত রাজ্য জয় নীতির পার্থক্য বিচার কর
কুষান সাম্রাজ্যের পতনের পর সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়৷ খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের উত্থানের পর এই অস্থিরতা দূর হয় । গুপ্ত রাজ বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট ছিলেন সমুদ্রগুপ্ত ৷ প্রথম চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পূর্বে সমুদ্র গুপ্তকে তার উত্তরাধিকার হিসাবে মনোনীত করেন ৷ তবে রাজত্বকালের সময় নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে । ঐতিহাসিক স্মিথ বলেছেন,"৩৩০ থেকে ৩৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেছিলেন ৷" ডক্টর রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেছেন,"৩৪০-৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে যেকোনো সময়ে তিনি সিংহাসন আরোহন করেছিলেন ৷"
সমুদ্র গুপ্ত ছিলেন সমর কুশলী সেনাপতি, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন প্রশাসক, প্রজাহিতৈষী রাজা এবং বিদ্যুৎসাহী মানুষ ৷ তার রাজত্বকাল সম্পর্কে জানতে হলে বহু ঐতিহাসিক উপাদানের উপর আমাদের নির্ভর করতে হয়। সেগুলি হল হরি সেনের "এলাহাবাদ প্রশস্তি", মধ্যপ্রদেশের "এরান লিপি" সমুদ্রগুপ্তের স্বর্ণমুদ্রা, "আর্য মঞ্জুশ্রী", 'পুরাণ', চৈনিক পরিব্রাজকদের বিবরণ ৷
সমুদ্র গুপ্ত ছিলেন খুবই প্রতিভাসম্পন্ন উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ ৷ তিনি একটি ক্ষুদ্র রাজ্যকে বিরাট গুপ্ত সাম্রাজ্যের পরিণত করেছিলেন ৷ হরি সেনের 'এলাহাবাদ প্রশস্তি' থেকে জানা যায় তিনি প্রথমে উত্তর ভারত ও আর্যগত বিজয়ে মনোননিবেশ করেন তিনি উত্তর ভারতে নয় জন রাজাকে পরাজিত করেছিলেন ৷ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন নাগাসেন, অচু্তনন্দ,চন্দ্রবর্মন,নাগদত্ত,রুদ্রদেব প্রমুখ ৷ তিনি আর্যবর্তে আধিপত্য বিস্তার করার পর 'সর্বরাজ্যচ্ছত্তা" উপাধি গ্রহণ করেন ৷ এরপর তিনি উত্তরপ্রদেশে, মধ্যেপ্রদেশ ও উত্তর-দক্ষিণ ভারতের মধ্যবর্তী অঞ্চল আধিপত্যদের বিরুদ্ধে অস্তধারন করেন ৷
সমুদ্রগুপ্ত উত্তর ভারত জয় করার পর দক্ষিণ ভারতে ১২ জন রাজাকে পরাজিত করেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন - রাজা মহেন্দ্র,রাজা মন্ত্ররাজ মহেন্দ্রগিরি, ধনঞ্জয় প্রমুখ ৷ মাত্র তিন বছরের মধ্যে দক্ষিণ ভারতের এই রাজ্যগুলি জয় করে নিয়েছিলেন ৷ তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন,"দক্ষিণ ভারতের রাজাদের কাছে তিনি দাঁড়াতে পারেননি ৷" তবে "এলাহাবাদ প্রশস্তি" থেকে জানা যায় তিনি দক্ষিণ ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণ ধন সম্পদ নিয়ে এ বীরের মতো প্রত্যাবর্তন করেছিলেন ৷ তবে উত্তর ভারতের ক্ষেত্রে বিজয়নীতি গ্রহণ করেন দক্ষিণ ভারতের ক্ষেত্রে গ্রহণ মুখ্য ও অনুষ্ঠিত নীতি গ্রহণ করেছিলেন ৷ এই কথাটির অর্থ হল প্রথমে শত্রুকে বলপূর্বক গ্রহণ এবং দ্বিতীয় তার বর্ষতা স্বীকার করা এবং তৃতীয়ত তাকে শর্তসাপেক্ষ মুক্তি দেওয়া এই নীতি থেকে তার রাজনৈতিক দূরদর্শিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।
তবে অনেক ঐতিহাসিকের মনে করেন সমুদ্র গুপ্তের দাক্ষিণাত্য অভিযানের মূল কারণ ছিল অর্থনীতি ৷ টলেমির ভূগোল গ্রন্থ থেকে জানা যায় দক্ষিণ ভারতে সেই সময় বহু বন্দর ছিল ৷ যেগুলি আর্থিকভাবে খুব সমৃদ্ধি ছিল সেই কারণে সমুদ্রগুপ্ত দক্ষিণ ভারত অভিযান করেন ৷ উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের সাফল্য দেখে ভীত হয়ে পাঁচটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের রাজারা তার বর্ষতা স্বীকার করে নেয় ৷
সমুদ্রগুপ্ত শুধু ভারতের অভ্যন্তরেই নয় ভারতের বাইরে ও রাজ্য বিস্তারিত সক্ষম হয়েছিলেন "এলাহাবাদ প্রশস্তি" থেকে জানা যায় ভারতের বাইরে বেশ কয়েকটি রাজা তাকে উৎকোচ প্রদান করতেন ৷ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন," পশ্চিমে হিমালয়ে এবং কাথিয়ার অঞ্চলে কুষান ও শকদের পরাজিত করেছিলেন ৷" তিনি সিংহলের রাজা মেঘ বর্মনের সাথে ও মৃত্রতা স্থাপন করেছিলেন ৷ তার সাম্রাজ্যবাদী নীতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় প্রাচীন ভারতে এরূপ বৃহৎ সাম্রাজ্য বিরল উত্তরে হিমালয় থেকে বিন্ধ পর্বত পূর্বে বঙ্গদেশ থেকে পশ্চিমে পাঞ্জাব পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ছিল ৷
সুতরাং বলা যায় সমুদ্র গুপ্ত ছিলেন প্রাচীন ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যবাদী শাসক তাই তাকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে নতুন যুগের প্রবর্তক বলা হয় ৷ ঐতিহাসিক স্মিথ তাকে "ভারতের নেপোলিয়ান" বলে আখ্যা দিয়েছেন ।