পল্লব স্থাপত্যের উপর একটি সংক্ষিপ্ত টিকা আলোচনা কর অথবা,পল্লব স্থাপত্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।

পল্লব স্থাপত্যের উপর একটি সংক্ষিপ্ত টিকা আলোচনা কর অথবা,পল্লব স্থাপত্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।

 পল্লব স্থাপত্যের উপর একটি সংক্ষিপ্ত টিকা আলোচনা কর অথবা,পল্লব স্থাপত্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো। বা,পল্লব স্থাপত্য এবং শিল্প সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখ।


পল্লব স্থাপত্যের উপর একটি সংক্ষিপ্ত টিকা আলোচনা কর

উত্তর। ভারতবর্ষের ইতিহাসে গুপ্তযুগের পরবর্তীকালে দক্ষিণ ভারত তথা দক্ষিণ ভারতের উপদ্বীপিয় অঞ্চল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্র হিসাবেই নয়, শিল্প স্থাপত্যের অন্যতম ধারক হিসাবেও দক্ষিণ ভারতের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। এই

সময়কালে দক্ষিণ ভারতে চালুক্য, পল্লব, পান্ডারা ছিল শক্তিশালী। এদের মধ্যে সাংস্কৃতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে সর্বাধিক আলোচ্য রাজবংশ হল পল্লব। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক থেকে নবম তক পর্যন্ত পল্লব রাজবংশ দক্ষিণ ভারতে রাজত্ব করে। শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য এই রাজবংশের সুখ্যাতি রয়েছে। পল্লবদের উৎপত্তিবিষয়ক নানা বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও তাদের কৃষ্টিশীলতা ও শিল্পবোধ নিয়ে সার্বিক সহমত লক্ষিত হয়। পল্লবযুগের স্বপতি ও ভাস্কররা, এমন কিছু অসাধারণ শিল্প নিদর্শন রচনা করেন, যা পল্লব রাজাদের অমরত্ব দান করেছে। প্রসঙ্গত বলা যায় যে, পল্লব স্থাপত্যের উন্নয়ন ঘটেছিল একটি নির্দিষ্ট বিবর্তিত ধারায়। প্রায় ৪০০ বছরব্যাপী সময়কালে পল্লবদের শৈল্পিক ক্রিয়ার প্রবাহমানত লক্ষিত হয়। পল্লব স্থাপত্যের অন্যতম কেন্দ্র ছিল মামল্পপুরম্ এবং কান্তীপুরম্ । এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় হল পল্লবস্থাপত্য।


পল্লব সময়কাল থেকে দক্ষিন ভারতের স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের ইতিহাসের সূচনা ঘটে এই আমলে নির্মিত মন্দিরসমূহ থেকে। পল্লবযুগের মন্দিরগুলিতে সর্বপ্রথম দ্রাবিড় স্থাপত্য রীতির পরিচয় পাওয়া যায়। দ্রাবিড় মন্দিরের বৈশিষ্ট্য এগুলি পিরামিডসদৃশ উচ্চতা। এর শীর্ষদেশ গম্বুজাকৃতির। শিল্পশাস্ত্রে একে বলা হয় স্তূপিকা বা স্তূপ। মন্দির অভ্যন্তরস্থ চতুষ্কোণ গর্ভগৃহ। এর চারিদিকে একটি বৃহত্তর চতুষ্কোণ আচ্ছাদিত বেষ্টনী যাকে বলা হয় 'প্রদক্ষিণ'। দ্রাবিড় স্থাপত্যরীতির উদ্ভবক্ষেত্র তামিলনাড়ু। 


পল্লব স্থাপত্য রীতি চারটি ধারায় বিভক্ত, মহেন্দ্রধারা, মামল্লধারা, রাজসিংহধারা,অপরাজিতধারা।


মন্দির নির্মাণে প্রথম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন প্রথম মহেন্দ্রবর্মন। তাই এই সময়ের নির্মাণশৈলী মহেন্দ্রশৈলী নামে পরিচিত। তাঁর শাসনকালেই প্রথম তোণ্ডাইমন্ডলে পাথর কেটে গুহামন্দির নির্মিত হয়। তাঁর রাজত্বের প্রথমদিকে তৈরি মন্দিরগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য মন্দিরগুলি হল-উত্তর আর্কট ভোলোর মামন্দুরে দুটি ও মিয়ামঙ্গলমে একটি, তিরুচিরাপল্লিতে একটি, এগুলির মধ্যে তিরুচিরাপল্লির মন্দির মহেন্দ্রবর্মনের শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব। পাহাড় কেটে নির্মিত মন্দিরগুলির সাধারণ বৈশিষ্ট্য সাধারণ স্তম্ভযুক্ত মন্ডপ।


প্রথম মহেন্দ্রবর্মনের রাজত্বকালে নির্মিত সবগুলি পাহাড়কাটা মন্দিরই যে এক ধরনের ছিল এমন নয়। তাঁর রাজত্বের প্রথমদিকে তৈরি মন্দিরগুলির সঙ্গে শেষদিকে তৈরি উত্তুবল্লি (গুন্টুরডোলা), অনন্তশায়ন মন্দির ও ভৈরবকোন্ত (উত্তর আর্কটডোলা)। এই দুই মন্দিরে কিছু পার্থক্য লক্ষিত হয়। এই দুই মন্দিরেই বৌদ্ধবিহারের কিছুটা অনুকরণ লক্ষ করা যায়। অনন্তশায়ন মন্দিরটি স্তম্ভযুক্ত মণ্ডপদ্বারা নির্মিত চারতলা। এর উচ্চতা ৫০ ফুট। ভৈরবকোস্তের মন্দিরটি ব্যাপকাকার ও অলংকৃত স্তম্ভগুলিতে নিশ্চিতভাবে পল্লবযুগের বৈশিষ্ট্যের সূচনা বলে অনুমিত হয়। এই স্তম্ভগুলির নিম্ন ও শীর্ষভাগে প্রথম সিংহমূর্তি যুক্ত করা হয়। এই নতুন ধরনের পরিকল্পনা পরবর্তীকালে অনেক বেশি মার্জিত হয়ে পরিপূর্ণ দ্রাবিড় রীতির বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। 


প্রথম মহেন্দ্রবর্মনের পুত্র প্রথম নরসিংতপর্যন মহামল্পর আমলেও পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণের ধারা বজায় ছিল। তবে নির্মাণ পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন আসে, যা মামল্লশৈলী নামে সুবিদিত। চেন্নাই শহরের (মাদ্রাজ) থেকে ৩২ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত মহাবলীপুরম্ মামল্লশৈলীর প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এই মহাবলীপুরমের মন্দিরগুলি নরসিংহবর্মনের আমলে নির্মিত হয়। পাহাড় কেটে রথের আকারে মন্দিরগুলি তৈরি হয়। এই রথশৈলীকে একশিলাশৈলীও বলা হয়। গ্রানাইট পাথরের পাহাড় কেটে সমুদ্রতীরে রখাকৃতি মন্দিরগুলি তেরি করা হয়েছিল। মহাবলীপুরমে মোট ৮টি রথ আছে। রথগুলিকে 'সাত প্যাগোডা'ও বলা হয়। এটি পঞ্চপান্ডবের নামে, আর একটি দ্রৌপদীর নামে, আর একটি গণেশের নামে। সবকটি রখই শিবমন্দির। ধর্মরাজ, ভীম ও সহদেবের রথের চূড়া পিরামিডের মতো কোনা ধাপে ধাপে উঠে গেছে। বাতায়ন বৌদ্ধচৈত্যের বাতায়নের অনুরূপ। দ্রাবিড় শিল্পরীতির বৈশিষ্ট্য সব চাইতে বেশি পরিস্ফুট অর্জুনের রথটিতে। রথগুলির সাধারণত দৈর্ঘ্য ৪২ ফুট, প্রস্থ ৩৫ ফুট আর উচ্চতায় ৪০ ফুট। শিল্পসমালোচকগণ এই ধারণা ব্যস্ত করেছেন যে, রথগুলি নির্মাণের মাধ্যমে পল্লব স্থাপত্যের একটি যুগের অবসান ঘটে। রথগুলির ভিতরের দিক অসম্পূর্ণ কিন্তু বাইরে অসাধারণ সূক্ষ্ম ভাস্কর্য। রথ মন্দিরগুলির প্রধান তিনটি বৈশিষ্ট্য-অলংকৃত প্রধান প্রবেশপথ, অষ্টকোণ শীর্ষস্তন্ত এবং দেওয়ালে উৎকীর্ণ রাজা-রানির চিত্র। তাছাড়া মহামন্নশৈলী অনুসারে পাহাড় কেটে গৃহামন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। ত্রিমূর্তি, বরাহ, দুর্গা প্রভৃতি গুহামন্দির পাহাড়ে খোদাই করে তৈরি।


মামল্লশৈলীর পর মন্দির নির্মাণের ধারায় পরিবর্তন আসে। পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণের কৌশল পরিত্যক্ত হয়। এই পর্যায়ে মন্দির স্থাপত্যের ক্ষেত্রে এক অধ্যায়ের শেষ ও অন্য এক অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। এই অধ্যায়ের মন্দিরগুলি স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে নির্মিত হয়। এই অধ্যায়ের মন্দিরগুলিকে দুইটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। প্রথম শ্রেণির মন্দিরগুলি রাজসিক গোষ্ঠীর রাজত্বকালে (৭০০-৮০০ খ্রিস্টাব্দ) নির্মিত হয়েছিল। দ্বিতীয় শ্রেণির মন্দিরগুলির নির্মাণকাল নন্দীবর্মনগোষ্ঠীর রাজত্বকাল (৮০০-৯০০ খ্রিস্টাব্দ), রাজসিংহ ধারার মন্দিরের সংখ্যা ৬টি। এর মধ্যে রয়েছে ৩টি তাঁর মন্দির (ঈশ্বর ও মুকুন্দমন্দির) ইত্যাদি। কাঞ্চীর কৈলাসনাথ ও বৈকুণ্ঠ পেরমল মন্দির এবং আর্কটের পনমলই মন্দির। মন্দিরগুলিতে অমরাবতী শিল্পকলার প্রভাব লক্ষিত হয়। কৈলাসনাথ মন্দির সর্বশ্রেষ্ঠ স্বতন্ত্র মন্দির।


এই স্বাধীন স্বতন্ত্র মন্দির নির্মাণযারার দ্বিতীয় পর্ব তথা নন্দীবর্মনগোষ্ঠীর সময়ের মন্দির • বিষয়ে আলোচনায় দেখা যায় যে, এই সময়ের মন্দিরগুলির সংখ্যা অনেক কম এবং সেগুলি আকারে অনেক ছোটো। এগুলি হল-কাঞ্চীপুরমের মুক্তেশ্বর ও মতঙ্গেশ্বর, চিরেলেপটের কাছে ওরপডম্ গ্রামে বাড়ামল্লিশ্বরের মন্দির এবং অরকোমের কাছে তিবুওনিতে বীরজনেশ্বরের মন্দিরের মধ্যে কাশ্মীপুরমের মন্দির দুটি উল্লেখযোগ্য।


পল্লব স্থাপত্যের চতুর্থ বা শেষ পর্যায়ের ধারা হল অপরাজিত ধারা (মূলত ৮৮০-৮৯৭ খ্রিস্টাব্দ) অপরাজিত পল্লব এই ধারার প্রবর্তক। চোলশিল্পের অনুকরণে এই রীতি গড়ে উঠেছিল। তবে পল্লবযুগের শেষ পর্যায়ের মন্দিরগুলি আগের পর্যায়ের মতো উজ্জ্বল নয়।


পরিশেষে বলা যায় যে, পল্লব আমলের স্থাপত্যসংক্রান্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হল মন্দির স্থাপত্যের ক্রমবিবর্তনের ধারা, এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দ্রাবিড় রীতির ক্রমবিবর্তন। ভারতীয় ধর্মীয় স্থাপত্যের ক্ষেত্রে পল্লবযুগের শিল্পকলাকে একটি বিশেষ অধ্যায় হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। প্রথম মহেন্দ্রবর্মনের রাজত্বকাল থেকেই এই শিল্পের বিকাশ ও রূপায়ণে সম্পূর্ণভাবে পল্লব রাজাদের স্বইচ্ছা ও পৃষ্ঠপোষকতায় সম্পন্ন হয়। এককথায় বলা যায় যে, শিল্পকলার প্রধান দুটি উপাদান নন্দনতত্ত্ব ও আধ্যাত্মিকতা পল্লবযুগের শিল্পকলায় প্রবলভাবে উপস্থিত ছিল।

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟