১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে বাংলার রাজনীতিতে বামপন্থী আন্দোলনের প্রভাব কী ছিল? অথবা,১৯২০-র দশকে বাংলায় বামপন্থী ধারার উদ্ভব সংক্ষেপে লেখো।
উনিশ শতকে ভারতের বুদ্ধিজীবী চিন্তাবিদরা আধুনিক সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন ৷ ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় অমৃতবাজার পত্রিকায় কাল মার্কস সম্পর্কে সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় । ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত মহান রুশ বিপ্লব সমগ্র বিশ্বে এক প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ৷ ভারতীয় জাতীয়তাবাদী এবং শ্রমিক শ্রেণীর একাংশ হতাশাগ্রস্ত বিপ্লবীদের অনেকেই এই যুগান্তকারী ঘটনার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় ৷ ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে শ্রীমতি অ্যানি বেসান্ত রুশ বিপ্লবের আদর্শের কথা বলেন এবং ১৯১৯ এর বিপিনচন্দ্র পাল ধনতান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমজীবিদের জাগরনের স্বাগত জানিয়ে বলেন এরই নাম বলশেভিক বাদ ৷ এই আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে যুগান্তর দলের সদস্য এবং বাঘা যতীনের ঘনিষ্ঠ অনুরাগী নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বা মানবেন্দ্রনাথ রায় মেক্সিকান সোসালিস্ট পার্টির সংস্পর্শে এসে মার্কসবাদের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন ৷
ভারতীয় রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো বামপন্থী বা সামন্ততান্ত্রিক মতাদর্শের প্রসার ৷ অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকে ভারতে বামপন্থী মতাদর্শ জনপ্রিয় হতে শুরু করে । ভারতের অভ্যন্তরীণ আর্থসামাজিক অবস্থা এবং বিশ্ব রাজনীতির প্রভাবে ভারতের রাজনীতিতেও অনিবার্যভাবে বামপন্থী মতাদর্শের প্রবেশ ঘটে এবং ফলে ভারতে দুটি বামপন্থী গোষ্ঠীর উদ্ভব হয় ,প্রথমটি হল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এবং দ্বিতীয়টি হল কংগ্রেস সমাজপন্থী দল ৷ অবশ্য সমাজপন্থী দল যে কোন স্বতন্ত্র সংগঠন নয় কংগ্রেসের মধ্য থেকে এই গোষ্ঠী বামপন্থী ও সমাজতান্ত্রিক মতবাদকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা চালান ৷
ভারতে কমিউনিস্ট সাম্যবাদী আন্দোলনের জনক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লবী ও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক এর প্রতিনিধি মিথাইল বোরোদিন এর সংস্পর্শে আসেন এবং তারা রাশিয়ার বাইরে মেক্সিকোতে প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত করে এবং মানবেন্দ্রনাথ সভাপতির নির্বাচিত হন ৷ এরপর লেনিনের আমন্ত্রণে তিনি ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের রাশিয়ায় যান ৷ কমিউনিস্টদের সম্মেলনে এই সম্মেলনে তিনি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ১৭ই অক্টোবর তাসখন্দে অবনী মুখার্জী ও মহাজিরিনদের মধ্য দিয়ে বাছাই করা ২৮ জনকে নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত করেন ৷ মানবেন্দ্রনাথ রায়ের উপর ভারতে কমিউনিস্ট ভাবধারা প্রচারের দায়িত্ব অর্পিত করা হয়েছিল ৷
ভারতের অভ্যন্তরে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার ব্যাপারে মানবেন্দ্রনাথ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে ৷ তার নির্দেশে নলিনী গুপ্ত ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ২৩ শে ডিসেম্বর কলকাতায় পৌঁছায় এবং তিনি বাংলায় প্রথম কমিউনিস্ট আন্দোলনের জনক মুজাফফর আহমদ এবং কাজী নজরুলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ৷ এইভাবে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে একটি কমিউনিস্ট স্থাপিত হয় ৷ শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে সাম্যবাদী মতাদর্শ দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে ৷ বিংশ শতকের দুই এর দশকে কমিউনিস্ট দলের উদ্যোগী ভারতে নানা অঞ্চলে বহু শ্রমিক ধর্মঘট সংঘটিত হয় শ্রমিকদের মধ্যে কমিউনিস্টদের জনপ্রিয়তায় সরকার শঙ্কিত হয় ৷
কমিউনিস্টদের এই প্রভাব বৃদ্ধি সরকার শুনজরে দেখেননি ৷ ১৯২২ থেকে ২৩ সালে মস্কোই শিক্ষিত মুহাজিরিনরা গোপনে ভারতের প্রবেশের চেষ্টা চালালে ব্রিটিশ সরকার তাদের গ্রেফতার করেন এবং পেশওয়ার কোটে তাদের বিচার হয় ও দীর্ঘমেয়াদী কারাদন্ডে দণ্ডিত হন এই মামলা পেশাওয়ার ষড়যন্ত্র মামলা বা প্রথম বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত ৷ ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে সরকার কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেফতার করে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে আনে এদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা বা কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করা হয় । মুজাফফর আহমেদ, ডাঙ্গে, নিলিনি গুপ্ত এবং শওকত ওসমানী প্রমুখো কমিউনিস্ট নেতা সহ অধিকাংশ অভিযুক্ত কারাদণ্ড হন ৷
কানপুর ষড়যন্ত্র মামলায় দীর্ঘকাল কারাবন্দি থাকার ফলে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অনেকটাই শিথিল হয়ে পড়ে ৷ কমিন্টানের ষষ্ঠ কংগ্রেসে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের গুরুত্ব পাই এখানে ভারতীয় নেতাদের পরামর্শ দেওয়া হয় যে তারা যেন জাতীয় সংস্কারবাদী নেতাদের ত্রুটিগুলি প্রকাশ করে এবং মেহনতি মানুষকে তাদের প্রভাব মুক্ত করার চেষ্টা চালান ৷ ১৯২০ সাল থেকে ভারতে ব্যাপক শ্রমিক অসন্তোষ দেখা যায় শ্রমিক এবং কৃষকদের এই স্বার্থে কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগী কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় "The labiour saraj party of the Indian national Congress". কাজী নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক হেমন্ত সরকার ছিলেন এর প্রধান নেতৃবৃন্দ । পরবর্তীতে এই দলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় "work and present" পার্টি ৷ এই দলের দুটি মুখপত্র ছিল লাঙ্গল এবং পরে যার নাম হয় "গণবানী" ৷
"work and present" পার্টির নেতৃবিন্দ একটি সর্বভারতীয় দলের অনুভব করেন এবং ১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের সময় এই দলের সর্বভারতীয় সম্মেলন ডাকা হয় ৷ এই দল শ্রমিক কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় জমিদারি প্রথা অবসান এবং পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি জানান ৷ এই দলের উদ্যোগে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের এক বিশাল মিছিল জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের মঞ্চের সামনে গিয়ে নিজেদের দাবি জানান দেয় ৷ পন্ডিত জহরলাল নেহেরু ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ শ্রমিকদের সামনে ভাষণ দেন ৷
এই সময় বাংলা সহ ভারতের শিল্পাঞ্চলগুলিতে কমিউনিস্টদের প্রভাব দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে ৷ তারা আইন অমান্য আন্দোলন থেকে কমিউনিস্টরা দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নেন ৷ জহরলাল, সুভাষচন্দ্র প্রমুখ ও বামপন্থী কমিউনিস্টদের তারা দেশের পক্ষে ক্ষতিকারক বলেছেন চিহ্নিত করেন ৷ কিন্তু গণ আন্দোলন থেকে বিচ্যুত থাকার ফলে কার্যত কমিউনিস্টদের গণসংযোগ বাহিত হয় ৷ ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে বহু কমিউনিস্ট জেল থেকে ছাড়া পান তখন তারা কমিউনিস্ট পার্টির স্বাধীন চরিত্র বজায় রেখে জাতীয় কংগ্রেসের সাথে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে আন্দোলনের ওপর জোর দেয় ৷ ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেসের প্রার্থীদের সমর্থন জানায় ৷ তিনের দশকের শেষ দিকে কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি পায় ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা ২৭১ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে 562 টি হয় ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে সারা ভারত কৃষাণ কংগ্রেস কমিউনিস্টদের প্রভাবে সারা ভারত কিষান সভায় পরিণত হয়।
ভারতছাড়ো আন্দোলনের সাথে কমিউনিস্টরা একাত্ম হতে পারেনি ৷ আবার ব্রিটিশ সরকারের সাম্রাজ্যবাদী দমননীতিকে তারা নিন্দা করেন ৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে কমিউনিস্ট দল প্রাথমিকভাবে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বলে নিন্দা করেন ৷ পরবর্তীকালে আবার কমিউনিস্ট পার্টি এই যুদ্ধ কে গণ যুদ্ধ নাম দেয় ৷ ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতে গণ্য আন্দোলনের জোয়ার আসে কমিউনিস্ট দলের নেতৃত্বে সংঘটিত হয় তেভাগা আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন ও বিদ্রোহী নৌসেনাদের ও কমিউনিস্ট সমর্থন জানান জাতীয় কংগ্রেসকেও সমর্থন জানান ।
বিংশ শতকের দ্বিতীয় শতক থেকে কংগ্রেসের রাজনীতিতে বামপন্থার প্রতি ঝোঁক দেখা যায়, জহরলাল নেহেরু ও সুভাষচন্দ্র বসু সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করেন ৷ আচার্য নরেন্দ্র দেব ,জয়প্রকাশ নারায়ণ, রাম মনোহর লোভিয়া প্রমুখ নেতা কংগ্রেস সমাজপন্থী দল গঠন করেন ৷ এই দলের উদ্দেশ্য ছিল কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী শক্তিকে সুদৃঢ় করা । বামপন্থীর প্রতি সুভাষ চন্দ্রের আস্থা কংগ্রেসের দমনপন্থী নেতাদের পছন্দ ছিল না । তাই হরিপুরা ১৯৩৮ এবং ত্রিপুরা কংগ্রেসের ১৯৪০ সভাপতি পদে সুভাষচন্দ্রের নির্বাচন দ্বারা ক্ষুদ্ধ হন ৷ দক্ষিণপন্থী বিরোধিতার সুভাষচন্দ্র সভাপতি পদত্যাগ করেন ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে ফরওয়ার্ড ব্লক নামে একটি গোষ্ঠী প্রচেষ্টা করে ৷ যা পরবর্তীতে একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ৷ অন্যদিকে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের অন্যতম সমর্থক ত্রিদিব কুমার চৌধুরী বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল গঠন করেন ৷
এইসব ঘটনার ফলে শ্রমিকরা একদিকে যেমন তাদের দাবি দাবিদাওয়া আদায়ের সক্ষম হয় তেমনি তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতন বৃদ্ধি পায় এবং দেশের মধ্যে কমিউনিস্ট ভাবধারা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ৷ কমিউনিস্ট আন্দোলন তখন একটি স্বীকৃত শক্তিতে পরিণত হয় । আতঙ্কিত সরকার এই আন্দোলন দমনের জন্য ১৯২৮ সালে সেপ্টেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের শিল্প বিরত বিল এবং জননিরপেক্ষতা বিল উপস্থাপন করেন এবং ১৯৩৯ সালে কুড়ি মার্চ ৩৩ জন কমিউনিস্ট নেতাকে গ্রেফতার করে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করে ৷ এইসব কর্মকাণ্ডই কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান ও জনপ্রিয়তার স্বাক্ষর বহন করে ৷ এইভাবে ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বামপন্থী রাজনীতি বা কমিউনিস্টদের উত্থানের সূচনা হয় ।
