বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা আলোচনা কর
উনিশ শতকে ভারতবর্ষে নারীরা অনন্তপুরবাসী ৷ তখনও নারীকে মনে করা হতো বাল্যকালে পিতার অধীনে ৷ যৌবনকালে স্বামীর অধীনে এবং বৃদ্ধকালে সন্তানদের অধীনে । কিন্তু বিংশ শতকের পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলস্বরূপ নারীদের মধ্যেও শিক্ষার অনুপ্রবেশ ঘটে ৷ ফলোতো নারীরা তাদের সত্তা ও স্বরূপ ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে এবং বহির জগতে পদার্পণ করতে শুরু করে ৷ এইসঙ্গে বেশ কিছু শিক্ষিতা ও জাগ্রত নারী ব্রিটিশ বিরোধী বিভিন্ন সংগঠন এবং জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে ৷ এই ঘটনা ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে যেমন নারী শক্তির গুরুত্ব বৃদ্ধি করে তেমনি পাশাপাশি স্বাধীনতার মূল আন্দোলন ও সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে পুরুষদের সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে ৷
বৈপ্লবিক কার্যকলাপ প্রধান প্রথম নির্দোষাবলী হয় বঙ্গভঙ্গ কে কেন্দ্র করে যে স্বদেশী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেইখান থেকে ৷ তাছাড়া ভারতবর্ষে মহাত্মা গান্ধীর আগমন জাতীয় রাজনীতিতে গভীরভাবে প্রভাব করেন ৷ তার ফলশ্রুতি হিসাবে বিংশ শতকে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনে বিভিন্ন নারীরাও যুক্ত হয়ে পড়েন ৷ সরলা দেবী চৌধুরানী, লীলা নাগ, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেকার ,কল্পনা দত্ত, শান্তি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরী, বীণা দাস প্রমূখ বঙ্গনারী সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন ৷ এই সকল বিপ্লবী নারীরা নিঃস্বার্থভাবে আত্মত্যাগের মাধ্যমে দেশমাতার জন্য বিশেষ অবদান রেখে গেছেন ৷ এদের মধ্যে সর্বপ্রথম যার নাম উঠে আসেন তিনি হলেন সরলা দেবী চৌধুরানী ৷ স্বাধীনতার সৈনিক রূপে নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ রূপে সুলেখিকা হিসেবে তিনি ভারতের ইতিহাসের চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন ।
সরলা দেবী চৌধুরানী বিশিষ্ট সমাজসেবী রামভঞ্জ দত্ত চৌধুরীর পত্নী ৷ স্বদেশী আন্দোলনের সময়কালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন ৷ তিনি ছিলেন ভারতী পত্রিকার সম্পাদিকা ৷ তিনি বিভিন্ন প্রবন্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন ৷ এই পত্রিকার মাধ্যমে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সংবাদ প্রকাশ করে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে গতিশীল করে তোলেন ৷ তিনি কয়েকটি উৎসব পালনের মাধ্যমে বাংলায় যুবকদের হীনমন্যতা দূর করার প্রয়াসী হয়েছেন ৷ এগুলির মধ্যে 'বীরাষ্টমী ব্রত' ও 'প্রতাপতিত্ব উৎসব' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ৷
যুবকদের দৈহিক শক্তি অর্জনের জন্য তিনি বীরাষ্টমী ব্রত পালনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন ৷ কুস্তি, তলোয়ার খেলা,ব্যায়াম,লাঠি খেলা,সাতরকাটা,শরীরচর্চা ইত্যাদি ছিল এই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ৷ এমনকি মোগল শাসনবিরোধী বীরদের আত্মত্যাগের ঘটনা ও স্মরণ করিয়ে দেয় ৷ বাঙ্গালীদের এই সমস্ত বীরদের আদর্শে উজ্জিবুত করার জন্য তিনি প্রতাপাদিত্য উৎসব চালু করেন ৷ বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন গঠনের উদ্দেশ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'লক্ষীর ভান্ডার' ৷ এটি ও হয়ে ওঠেন স্বদেশি তহবিল ৷ এর পাশাপাশি নারী জাতির কল্যাণ সাধনের একতা বৃদ্ধির জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'ভারত স্ত্রী মহামন্ডল' । বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে তার অবদান ছিল অপরিসীম ৷ বিপ্লবীবাদের প্রসারে নারী শক্তির জাগরণের যুবকদের আত্মবিশ্বাস বুদ্ধিতে তার অবদান চিরস্মরণীয় ৷
বাংলায় নারীদের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সামিল করার উদ্দেশ্যে বিপ্লবী লীলা রায় ১৯ ২৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার দিপালী সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন ৷ প্রীতিলতা ওয়াদ্দকার, কল্পনা দত্ত, বীণা দাস, শান্তি দাস প্রমুখ ছিলেন এই সংগঠনের সদস্য । 'জয়শ্রী' ছিল এই সংঘের পত্রিকা ৷ নারী বিপ্লবী আন্দোলন পরিচালনার জন্য যোগ্য করে তোলা তাদের শক্তি ও সাহস বৃদ্ধি করা, স্বদেশ প্রেম জাগ্রত করা ,নারীদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো ইত্যাদি ছিল এই সংঘ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ৷ এই সংঘের মাধ্যমে ভারতে বৈপ্লবিক কার্য নারীদের অংশগ্রহণ ছিল বিশেষ বিশেষ তাতপর্যপূর্ণ ৷ প্রকাশ্যে এই সংঘটি ছিল শরীরচর্চা ও নারী শিক্ষা বিকাশের কেন্দ্র কিন্তু গোপনে এই সঙ্গের মাধ্যমে বিপ্লবী আদর্শ প্রচার হতো । নারীদের শক্তি ও সাহস বৃদ্ধির জন্য এখানে নিয়মিত লাঠিখেলা, শরীর চর্চা অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দান করা হতো । এমনকি তার উদ্যোগে মেয়েদের হাতের কাজ, শিল্প ও অন্যান্য কাজের প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থাও এখানে হয় । এই সঙ্গের মাধ্যমে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ১২টি অনৈতিক প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ৷ দিপালী সংঘের প্রচেষ্টায় 1926 খ্রিস্টাব্দে গড়ে ওঠে 'দিপালী ছাত্র সংঘ' এটি ছিল ভারতের প্রথম ছাত্রী প্রতিষ্ঠান ৷ এর মাধ্যমে ছাত্রীদের স্বদেশপ্রেম উদ্ভূত করা ব্যবস্থা হয় ।
বিপ্লবী আন্দোলনের ওপর এক নারী হলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেকার । তিনি কলকাতার বেথুন কলেজে পড়াশোনার সময় কল্যাণী দাসের ছাত্র সংঘের সঙ্গে যুক্ত হন । দেশ মায়ের মুক্তির জন্য সংসারে সুখ শান্তি বিসর্জন দিয়ে মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে বিপ্লবী কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেন ৷ তিনি ফুলতার ছদ্মনাম গ্রহণ করেন ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্তাগার লুণ্ঠনের সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন ৷ টেলিফোন, টেলিগ্রাফ ধ্বংস বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠাতা ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করেন ৷ জালালাবাদ পাহাড়ে যুদ্ধে (১৯৩০ খ্রিঃ), ধলঘাটের যুদ্ধে (১৯৩২ খ্রিঃ) তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ৷
মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ২৩ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতার নেতৃত্বে ১৫ জন বিপ্লবী একটি দল পাহাড়তলিয়ে একটি ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ করেন ৷ চট্টগ্রাম শহরের উত্তর দিকে এই ক্লাবটি ছিল ব্রিটিশদের প্রমদ কেন্দ্র ৷ তাদের আক্রমণে একজন ইংরেজ নিহত ও ১১ জন আহত হন ৷ তিনি নিজে গুলিবদ্ধ হন ও পুলিশের হাতে গ্রেফতার হবার আগে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন ৷ অর্থাৎ দেশমাতাকে পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্ত করার জন্য প্রীতিলতার আত্মত্যাগ ভারতীয় বিপ্লবীদের দারুন ভাবে প্রভাবিত করে ৷ তিনিই ছিলেন ভারতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রথম মহিলা শহীদ তার দেশপ্রেম সাহসিকতা ভারতীয় নারীদের বিপ্লবী কাজে উদ্বুদ্ধ করে ৷
ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের আরেক নারী হলেন কল্পনা দত্ত ৷ তার দেশ ভক্তি স্বদেশ প্রেম সাহসিকতাকে ভারতের ইতিহাসের স্মরণীয় করে রেখেছে ৷ বেথুন কলেজে পড়াশোনার সময় তিনি বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু, কানাইলাল প্রমুখের বিপ্লবী ভাবাদর্শে উদ্ভুদ্ধ হন । ওই সময় কল্যাণী দাসের ছাত্রী সংঘের যোগদান করেন বিভিন্ন মিছিল,মিটিং,হরতাল প্রভৃতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন ৷ ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবী পুণেন্দু দস্তিদার নির্মল সেনের মাধ্যমে বিপ্লবী সূর্য সেন এর সঙ্গে তিনি পরিচিত হন এবং পরবর্তীকালে তিনি ইন্ডিয়ান রিপাবলিক আর্মির অন্যতম সদস্য হন ৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে বাংলার অগ্নিকন্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেন ৷ চট্টগ্রাম অস্তাগার লুণ্ঠনের অভিযুক্ত গনেশ ঘোষ, অনন্ত সিং লোকনাথ বল প্রমুখদের উদ্ধারের জন্য তিনি একটি পরিকল্পনা করেন ৷ কলকাতা থেকে গোপনে আনা বিস্ফোরক দিয়ে গান কটন তৈরি করে বিপ্লবীদের মুক্ত করার পরিকল্পনা করেন ৷ তবে এই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায় ৷ এটি ডিনামাইট ষড়যন্ত্র নামে পরিচিত ৷ এছাড়াও তিনি প্রীতিলতা ওয়াদ্দকারের সঙ্গে চট্টগ্রামের ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব নেন কিন্তু আক্রমণের পূর্বেই তিনি গ্রেফতার হন ৷ জেল থেকে মুক্তি লাভের পর 1933 খ্রিস্টাব্দে ১৭ই ফেব্রুয়ারি সমুদ্র তীরবর্তী গরিলা গ্রামের একটি সংঘর্ষ তিনি জড়িয়ে পড়েন এতে মাস্টারদা ধরা পড়লে তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন তিন মাস পর ওই গ্রামে অন্য একটি সংঘর্ষে তিনি ধরা পড়েন এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন ৷
১৯২০ দশকে বাংলার এক ছাত্রী ছিলেন বিপ্লবী বীণা দাস ৷ ১৯৩২ সালে ৬ই জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমবর্তন অনুষ্ঠানে বাংলা বাংলার গভর্নর স্টানলি জ্যাকসন যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন বীণা দাস পরপর তিনবার গুলি ছুঁড়লেও স্টানলি জ্যাকসন বেঁচে যান ৷ আর বীনা দাস গ্রেপ্তার হন এবং ৯ বছরের কারাদণ্ড হয় ৷ এই বীণা দাস ছিলেন আবার সুভাষচন্দ্রের শিক্ষক বেণীমাধব দাসের কনিষ্ঠ কন্যা ৷ জেল থেকে ছাড়া পাবার পর বীণা দাস পুনরায় ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগদান করেন ৷ বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার দুই ছাত্রী শান্তি ঘোষ ও সুমীতি চৌধুরী ১৯৩১ সালে ১৪ই ডিসেম্বর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিফেন কে গুলি করে হত্যা করে যাবজ্জীবন কারাগারে যান ৷ আবার উজ্জ্বলা মজুমদার দার্জিলিং এর লেবং ঘৌড় দৌড়ে মাঠে বাংলার গভর্নর অ্যান্ডারসনকে হত্যা করার চেষ্টা করলে ধরা পড়েন এবং ১৪ বছরের জেল হয় ৷ এরা তিনজনই ছিল অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী । এছাড়াও সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে যেসব নারীদের ভূমিকা অন্যতম ছিলেন তারা হল লক্ষী সাগ্যাল, মাদাম কামা, ননীবালা দেবী , দুকুড়ি বালা দেবী, ভগিনী নিবেদিতা ,পারুল মুখার্জি তুষা মেহতা ,অরুনা আসফ আলী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ৷
উপরের আলোচনা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের যোগদান ছিল সীমিত ৷ তারা সংখ্যাই ছিল খুবই অল্প তাদের কাজও ছিল সীমাবদ্ধ ৷ তারা পুরুষদের সতর্কবার্তা প্রেরণ,সংবাদ প্রেরণ, অস্ত্র পৌঁছানোর কাজেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং বিপ্লবী নারীরা ছিল বেশিরভাগই বাঙালি । তা সত্ত্বেও বলা যায় যে সময়ে নারীদের বাড়ির বাইরে যেতে প্রতিবন্ধকতা ছিল সেখানে দেশের জন্য সশস্ত্র বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে কারাবাস এমনকি তারা প্রান দিতে কুঙ্খাবোধ করেননি । তাই সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে তাদের ভূমিকা সীমিত হলেও দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য তাদের আত্মত্যাগের ভূমিকা কে কখনোই অস্বীকার করা যায় না।
সম্ভাব্য প্রশ্নঃ
- বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা সংক্ষেপে লেখো।
- বিংশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় বিপ্লবী নারী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।
- বিংশ শতকের প্রথমার্ধে নারী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর
- বাংলায় নারী আন্দোলন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা কর অথবা
