অনুশীলন সমিতি সম্পর্কে আলোচনা কর অথবা,গুপ্ত সমিতি হিসাবে অনুশীলন সমিতি সম্পর্কে আলোচনা করো।
বাংলায় বিপ্লবী জাতীয়তাবাদের সূচনা উনবিংশ শতকের ৭০ দশকে । এই সময় বাংলাদেশে গুপ্ত সমিতি গড়ে তোলার কাজ শুরু হয় । বাংলায় বিপ্লবী সমিতিগুলির মধ্যে অগ্রণী ছিল অনুশীলন সমিতি (২৪ মার্চ ১৯০২ খ্রি.) । ১৯০২ সালে ২৮ মার্চ কলকাতার হেদুয়ার কাছে মদনমিত্র লেনে সতীশচন্দ্র বসু অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন । বঙ্কিমচন্দ্রের 'আনন্দমঠ' উপন্যাসের সন্ন্যাসীদের সমিতির নামানুসারে এই সমিতির নামকরণ কর হয়েছিল । পরে এই সমিতির কার্যালয় কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটে স্থানান্তরিত হয় ৷ তরুণ বাঙ্গালীদের নৈতিক শিক্ষার বিকাশ ও শারীরিক উন্নতি ঘটানোই ছিল অনুশীলন সমিতির প্রাথমিক কর্মসূচি । বিখ্যাত ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র ছিলেন এই অনুশীলন সমিতির সভাপতি ও সর্বাধিনায়ক । সহ- সভাপতি ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ ছিলেন এই সমিতির হিসাবরক্ষক। ভগিনী নিবেদিতা ছিলেন এই অনুশীলন সমিতির একজন একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ।
এই সময় ভগিনী নিবেদিতা গাইকোয়াড়ের আমন্ত্রণে বারোদায় গিয়ে অরবিন্দ ঘোষের সাথে সাক্ষাৎ করেন । তিনি বাংলায় গুপ্ত সমিতিগুলির মধ্যে সমন্বয়ে গড়ে তোলার জন্য অরবিন্দ ঘোষ কে কলকাতায় যাওয়ার অনুরোধ করেন । অরবিন্দ ঘোষ নিবেদিতার আহ্বানে বরোদা কলেজের উপাধ্যক্ষের পদ ত্যাগ করে স্থায়ীভাবে কলকাতায় চলে আসেন ।
অনুশীলন সমিতি গঠনের সময় সুনির্দিষ্টভাবে সন্ত্রাসমূলক কাজের কোন কর্মসূচি ছিল না । এখানে মূলত শরীরচর্চা, লাঠিখেলা, ব্যায়াম প্রভৃতির মাধ্যমে নিজেদের শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করত। 'গীতা' এবং 'আনন্দমঠ' পাঠ করা ছিল এই সমিতির সকল জন্য বাধ্যতামূলক ছিল । ম্যাৎসিনি, গ্যারিবন্ডি প্রমুখো ইতালীয় জননায়কের জীবনী, আইরিশ বিপ্লবীদের কর্মধারা, ইউরোপের নানা দেশের মুক্তির সংগ্রাম ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হতো । ভগিনী নিবেদিতা, প্রমথনাথ মিত্র, প্রভাত কুসুম রায় চৌধুরী, সুরেন দাস প্রমূখ সমিতিতে সদস্যের সাথে রাজনীতি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, অধিকার ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন । খুব কম সময়ের মধ্যেই অনুশীলন সমিতি তরুণ সমাজের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে । কলকাতা ও পশ্চিমবাংলা নানা অঞ্চলে অনুশীলন সমিতির কর্মকাণ্ড প্রসারিত হয় । ঢাকায় অনুশীলন সমিতির খুব শীঘ্রই পূর্ববঙ্গের ও আসামে পাঁচশত শাখা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় ।
অনুশীলন সমিতির একটি সুবিন্যস্ত সাংগঠনিক কাঠামো ছিল । অনুশীলন সমিতির সদসাদের কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হত। সমিতির সকল নিয়ম মেনে চলা, পরিচালকের আদেশ পালন করা ও সদা সত্য কথা বলা, সমিতির তহবিলে অর্থ ও মূল্যবান দ্রব্য জমা দেওয়া, সর্বদা ন্যায় প্রতিষ্ঠার আদর্শ মেনে চলা প্রভৃতি ছিল এই অনুশীলন সমিতির নিয়মাবলী । এজন্য তাদের নানা পর্যায়ে প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে হতো । প্রতিজ্ঞা গ্রহণের মাধ্যমে সদস্যদের নানা অঙ্গীকার করতে হতো,যেমন-সমিতি থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়া, সর্বদা সমিতির আদর্শ ও কর্মকর্তাদের নির্দেশ মান্য করা, সমিতির গোপনীয়তা রক্ষা করা ইত্যাদি । চূড়ান্ত ছিল মূলত আত্মত্যাগের অঙ্গীকার, যেমন-আত্মীয় পরিজনের মোহে পড়ে সমিতির কর্তব্য কর্ম থেকে বিচ্যুত না হওয়া, বিশ্বাস ভঙ্গকারী সহকর্মীকে শাস্তি দিতে দ্বিধা না করা ইত্যাদি ।
তবে প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই অনুশীলন সমিতিতে মতভেদ দেখা যায় । মূলত দুটি কারণে এই মতভেদের সূচনা একটি ব্যক্তিগত এবং অন্যটি আদর্শগত মতভেদ । ব্যক্তিগত কারণ হলো যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে প্রমথনাথ মিত্রের মতভেদ সাংগঠনিক কাজকে কেন্দ্র করে । পরে বারীন ঘোষের সাথেও যতীন্দ্রনাথের মতান্তর দেখা যায় । ফলে যতীন্দ্রনাথ দল ও বাংলা ছেড়ে চলে যান । এই সময় অরবিন্দ ঘোষ কলকাতায় চলে আসেন । এভাবেই অনুশীলন সমিতিগুলি পৃথক পৃথক দলের বিভক্ত হয়ে যায় । তবে পৃথক সংগঠন হলেও আন্দোলন চালানোর ক্ষেত্রে এদের সম্পর্ক ছিল সহায়কের ।
