ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রভৃতি আলোচনা কর ৷ বা, ঠান্ডা লড়াই কি একটি আদর্শগত সংঘাত নাকি শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা, ঠান্ডা লড়াই কি শুধুমাত্র একটি ভাবাদর্শগত সংঘাত ছিল
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব রাজনীতিতে এক আমূল পরিবর্তন এসেছিল ৷ এই সময় ঠান্ডা লড়াই ছিল আন্তর্জাতিক রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পরস্পর বিরোধী শিবিরে বিভক্ত হয়ে যে ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা ঘটিয়েছিল তার প্রকৃতি কি ছিল সে নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল ৷ এই ঠান্ডা যুদ্ধের প্রকৃতি নিয়ে পরস্পর বিরোধী মতবাদের সৃষ্টি হয়েছিল সেগুলি হল (১). চিরায়ত ভাস্য (২). সংশোধনবাদী ব্যাখ্যা ও (৩). বাস্তববাদী ব্যাখ্যা ৷
অনেকের বক্তব্য হলো ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রকৃতি ছিল মূলত আদর্শগত এবং ঠান্ডা লড়াইয়ের জন্য এই দায়ী সোভিয়েত ইউনিয়নের একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সাম্যবাদী মতাদর্শ । চার্চিলের "দ্য সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার" এবং জর্জ কেনানের "আমেরিকান ডিপ্লোমেসি" গ্রন্থে এই বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ৷ এদের বক্তব্য হলো ঠান্ডা যুদ্ধের জন্য দায়ী সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের উগ্র বিস্তার নীতি ঠান্ডা যুদ্ধ কে বাস্তবায়িত করেছিল ৷ এই রাষ্ট্রটি পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে সাম্যবাদের বিস্তার ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছিল ৷ সোভিয়েত বিস্তার নীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্যবাদের প্রসার ঘটানো ৷ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৯ই ফেব্রুয়ারি স্ট্যালিন একটি ভাষণ দিয়েছিলেন যেখানে তিনি বলেছিলেন সাম্যবাদ জয়ী না হওয়া পর্যন্ত কমিউনিস্ট ও পুঁজিবাদী দেশগুলির মধ্যে সংঘর্ষ বন্ধ হবে না ৷
চিরায়ত ভাষ্যের সমর্থকদের বক্তব্য গুলো যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আদর্শগত ঠান্ডা যুগের সূচনা হয়েছিল তার চরিত্র ছিল আদর্শগত সংঘাত ৷ দুই শিবিরের বিভক্ত দেশগুলির জীবন চর্চা ছিল পরস্পর বিরোধী তারা আপসহীন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন ৷ আমেরিকার লেখক জন লেপিয়ার এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে শাসনব্যবস্থার স্বৈরতন্ত্র বা পশ্চিমী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কোনটাই ছিল না । সেই জন্যই কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা যে ভালো এবং তাদের শাসনে যে আদর্শ আছে এটা প্রমাণ করার তাগিদে ছিল ৷ সেই জন্য সোভিয়েত রাশিয়া প্রয়োজনের ভিত্তিতে আদর্শগত সংঘাতের কথা প্রচার করেছিল ৷
চিরায়ত ভাস্যকে অনেকে গ্রহণ করেনি, এই ব্যাখ্যায় যারা সংশোধন করেছেন তাদের বলা হয় সংশোধনবাদী ৷ ১৯৬০ এর দশক থেকে এরা ঠান্ডা যুদ্ধের চরিত্রের বিশ্লেষণ কে অন্য দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করেছেন ৷ এই মতের ব্যাখ্যা কারীদের মধ্যে স্মরণীয় হলেন ডি.এফ ফ্লেমিং এবং ওয়াল্টার লিপম্যান ৷ তাদের বক্তব্য হলো ঠান্ডা যুদ্ধ ও আদর্শের সংঘাত ছিল না । আদর্শগত লড়াই ছিল লোক দেখানোর ব্যাপার, এটি ছিল একটি কৌশল মাত্র ৷ আসলে এটা ছিল একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে পূরণ করার বিষয় ৷
ফ্লেমিং এর মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেবলমাত্র সোভিয়েত সম্প্রসারণ কে বাধা দেওয়ার জন্যই ঠান্ডা যুদ্ধে যোগ দেননি । আসলে এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত হতে চেয়েছিলেন ৷ অনেকের মতেই প্রথম দিকে ঠান্ডা যুদ্ধ ছিল অনিবার্য কিন্তু পরবর্তীকালে সদিচ্ছা থাকলেও এই যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণ করা যেত ৷ কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাম্যবাদের বিরুদ্ধে একপ্রকার জিহাদ ঘোষণা করলে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছিল ৷ সেজন্যই অনেকেই এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে ঠান্ডা যুদ্ধের পেছনে আদর্শগত সংঘাত নয়, শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল আসল কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার শক্তি বাড়াতে চেয়েছিলেন ৷
চিরায়ত ও সংশোধনবাদী ব্যাখ্যা কর্তাদের মত বাস্তববাদীর ব্যাখ্যা ও কর্তাদের ও বিশ্লেষণ ঠান্ডা যুদ্ধে চরিত্র নির্ধারণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ৷ স্বার্থের সংঘাত, শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও শক্তির সাম্ম্যনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে তারা ঠান্ডা যুদ্ধের চরিত্র বিশ্লেষণ করেছিল ৷ তারা একতরফাভাবে ঠান্ডা যুদ্ধের জন্য কোন এক পক্ষকে দায়ী করেনি ৷ তাদের বক্তব্য হলো ঠান্ডা যুদ্ধের জন্য এই প্রতিদ্বন্দ্বি সমানভাবে দায়ী ৷ দুই পক্ষই নিজেদের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নিজেদের স্বার্থকে রক্ষা করতে চেষ্টা করেছিলেন ৷ পরিণতিতে ঠান্ডা যুদ্ধ ক্রমর্শ ব্যাপক আকার ধারণ করে ৷