১৯৪৭ এর দেশভাগ এবং উদ্বাস্তু সংস্থা বাংলাকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল
"ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন ইংরেজকে এই ভারত ত্যাগ করে যেতে হবে, কিন্তু কোন ভারতবর্ষকে সে পেছনে ত্যাগ করে যাবে ? লক্ষীছাড়া দীনতার আবর্জনাকে একটি শতাব্দীর জীবনধারা যখন শুষ্ক হয়ে যাবে তখন একি বিস্তীর্ণ পঙ্গু শয্যা দুর্বিষহ নিষ্ফলতা বহন করতে থাকবে? (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪১ সালে মৃত্যুর তিন মাস আগে) ১০ লক্ষ মানুষের প্রান বিনিময়ে ১৯০ বছর পর প্রাপ্ত স্বাধীনতার মুহূর্তের দেশবাসীকে প্রত্যক্ষ করতে হলেও দেশভাগের অশ্রু সিক্ত যন্ত্রনা । মানুষকে বিভাজিত করে মাথা তুলে দাঁড়ালো কাঁটাতারের বেড়া । তাই স্বাধীনতার আনন্দ উৎসব শুরু হলেও জন্মভিতে হারানোর হাহাকার এবং প্রিয়জন বিচ্ছেদের নয়নে মাউন্টব্যাটেনের নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের ঘোষণা হয় । লেডি কলেজ এবং ডমিনেট ল্যাপিলিয়ার লেখা "মাউন্টব্যাটেন এন্ড পার্টিশন অফ দা ইন্ডিয়া" গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে মাউন্টব্যাটেন বলেন ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি যুদ্ধের থেকেও কঠিন ভারত একটি বিরাট পরীক্ষা ৷"
এইচ হার্ডসন রচিত "দ্যা গ্রেট ডিভাইডেড" গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে ভারতের আসার ১০ দিনের মধ্যেই মাউন্টব্যাটেন মন্তব্য করেন দৃশ্যপটে শুধু অন্ধকার যদি দ্রুত অবস্থা নিতে না পারি গৃহযুদ্ধ বেধে যাবে ৷ দেশ বিভাজন সম্পর্কে নিজস্ব নোটে মাউন্টব্যাটেন লিখেছেন এই দেশভাগের ব্যাপারটা নিছক পাগলামি এর ফলে দেশটার অর্থনৈতিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৷ অকল্পনীয় সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা না থাকলে আমি কিছুতেই বেশভাগ সংক্রান্ত মীমাংসায় রাজি হতাম না । স্বাধীনতার আন্দোলনের গৌরবের ভূমিকা পালনকারী দুটি প্রদেশ বাংলা এবং পাঞ্জাব দ্বীখন্ডিত হলো ৷ পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিম পাঞ্জাব গেল পাকিস্তানের আর পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্বপাঞ্জাব রইল ভারতে, তাই ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী বলেছেন," এ আজাদী একবার ঝুটা না হলেও জন্মসূত্রে প্রতিবন্ধী" দেশ বিভাজনের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো এবং নারী নির্যাতন ৷ লক্ষ্য কোটি মানুষ হলো গৃহহীন সম্পদ হীন ৷ এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় ১৯৫০ এ এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত এইমাত্র চার মাসে ৪ লক্ষ ৬০ হাজার ৬১০ জন হিন্দু পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসে এবং ১ লক্ষ ৩৯ হাজার ৯৯০ জন মুসলমান পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ববঙ্গে চলে যান ৷ centrel for studies in social science থেকে জানা যায় ১৯৪৭ থেকে ৫৭ তে ৩৫ হাজার হিন্দু পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলেন অন্যদিকে ১৯৫০ এর দাঙ্গার পর ১১ মুসলমান পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ববঙ্গে চলে যায় ৷ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এক কোটি অমুসলিম এবং কিছু মুসলমান ও পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসাম ত্রিপুরায় চলে আসে ৷ ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবর রহমানের হত্যার সময় ৬০ হাজার চাকমা আদিবাসী ত্রিপুরায় চলে আসে ৷
দেশভাগের পর নারী জীবনের নেমে আসে অসহায়তা এবং দুর্দিনের বড় অভিসম্পাবাত লক্ষ লক্ষ হিন্দু মুসলিম নারী ধর্ষিতা হন,বহু নারী পাচার হয় দেশ বিদেশের পতিতালয় গুলিতে ৷ ঋতু মেননের প্রবন্ধ "ইকোনমি এন্ড পলিটিকাল উইকলি" থেকে জানা যায় ভারত ও পাকিস্তানের যৌথ প্রবাসে ১২,০০০ নারীকে ভারতে এবং ৬,০০০ জনকে পাকিস্তানের পতিতালয় থেকে উদ্ধার করা হয় কিন্তু এই সংখ্যা ছিল মোট নারীর অতি সামান্য অংশ । চিত্রবিদ ছদ্মনামে এক মনস্তত্ত্ববিদ এর লেখা "উৎসমুখ" থেকে এক রোগীর মুখে শোনা যায় যে করুন কথা ৷ ডঃ পিতার ১৬-১৭ বয়স্ক ম্যাট্রিক পাস করা যশোরের এই যুবতী বলেন আক্রমণকারীরা আমাদের সবাইকে নিশংসভাবে হত্যা করল লুট করল কিভাবে যেন আমি বেঁচে গেলাম সে কত মর্মান্তিক তা আজ জীবন দিয়েও শেষ করতে পারবো না । যে মানুষটি আমার ভাই বোন বাবা-মাকে হত্যা করেছে তার আরো দুটি বউয়ের সাথে আমার স্থান হলো তার হারেমে ৷ কাতারে কাতারে লোক হাহাকার কান্না কে কার দুঃখের হিসাব নেয় ৷ ক্লান্ত সচ্ছন্ন শরীর টানতে পারিনা তবুও পারলাম এই ক্যাম্প ও ক্যাম্প করতে করতে বনগাঁ ক্যাম্পে এসে পৌঁছেছিলাম ৷ ডাক্তাররা জানালেন আমার পেটে বাচ্চা আছে মাথায় বজ্রঘাত হলো.." ৷
১৯৪৮ সালে ২৪ অক্টোবর আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হল মুখ্যমন্ত্রী ডক্টর বিধানচন্দ্র রায় স্বীকার করছেন প্রতিদিনই পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে হাজার হাজার মানুষ চলে আসছে ৷ বেঙ্গল রি হ্যাবিলিটেশন অর্গানাইজেশন" এর তথ্য থেকে জানা যায় ১৯৪৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে আশা লোকের মধ্যে ১১ লক্ষ মানুষ ফুটপাথ, প্লাটফর্মে শিবিরে রয়েছেন, অথচ স্বাধীনতার মুহূর্তে ভারতের অশিক্ষা ও স্বাস্থ্য ও দরিদ্রতার সমস্যা ছিল চরম ৷ ওই পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে ভারতের মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যশস্যের পরিমাণ ছিল ৩৩. ৪২ গ্রাম, বছরে বস্ত্র পরিধান করতো গড়ে ১০ মিটার ৷ প্রতি হাজারে মৃত্যুর হারছিল ২৭.৪ শিশুদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার ছিল হাজারে ১৯০ জন ৷ ভারতীয়দের গড় আয়ু ছিল মাত্র 32 বছর ৷ ১৯৪০ থেকে ৪৯ প্রতিবছর গড়ে কেবল কলেরাতেই মারা যেতেন দু'লক্ষ । বসন্ত ৭০ হাজার এবং জরে মারা যেতন ৩৩ লক্ষ জন ৷
অথচ মৌলিক সমস্যা সমাধানের অপেক্ষায় দেশ বিভাজন দাঙ্গা উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানে সরকারকে অনেক বেশি মননিবেশ করতে হয় । এই পসঙ্গে ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠি বলেছেন স্বাধীনতার আনন্দ ধ্বনি মেলানোর আগে এই লক্ষ লক্ষ হিন্দু,শিখ, মুসলিমের রনহুংকার আর্তনাদ সীমান্তের আকাশকে বার্দীন করল ৷ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লেখেন রাত্রি নিঃসঙ্গ ছায়া নামে প্রাণ যমুনার তীরে মৃত্যুর উৎসব সাঙ্গবদ্ধ হৃদয় ছিন্ন পাখা দাঙ্গা এবং উদ্বাস্য সমস্যা সমাধানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খা ১৯৫০ সালে ১৭ই এপ্রিল নেহেরু লিয়াকত চুক্তি বা দিল্লি চুক্তি স্বাক্ষর করেন ৷ এতে বলা হয় যে সংখ্যালঘুদের যে যার দেশের প্রতি অনুগত থাকবেন এবং সেই রাষ্ট্রের কাছে অধিকার চাইবে ৷
দাঙ্গা হাঙ্গামা রক্তপাতের হিসাবে স্বাধীনতার উৎসব শুরু হল উত্তর কলকাতায় দুটি পাড়া গরফা আর রাজা বাজার ৷ গড়ফা ছিল হিন্দু গুন্ডা এবং রাজাবাজার ছিল মুসলিম গুন্ডাদের জন্যখ্যাত দুটি অঞ্চলের তরুণ বানানোর জন্য কাজ শুরু হল ৷ মাঝখানে সামান্য দূরত্ব কিন্তু কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে না দুই পক্ষই সতর্ক ৷ অমলেন্দু সেনগুপ্তের "উত্তাল চল্লিশ অসমাপ্ত বিপ্লব" থেকে জানা যায় রাজাবাজার থেকে এক যুবক গড়ফার যুবকদের বলল একটা হাতুড়ি দিতে পারবেন আর মুহূর্ত চলে গেল সব বলভীতি সন্দেহ অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল একে অপরকে মারার জন্য, সেই বোমায় ফাটিয়ে উল্লাস করা হলো স্বাধীনতা দিবস ৷ তবে অশুত্ব নয়নে দেশবাসীর প্রত্যক্ষ করল ভাতৃ-তাত্তিক দাঙ্গা লক্ষ্য লক্ষ্য নারী ধর্ষণের লজ্জায় মুখ ঢাকতে বাধ্য হল ভারত মাতা । শুকনো পাতায় উড়ে এলো স্বাধীনতার তাই বেদনা হতো ৷ কবি দীনেশ দাস ১৫ই আগস্ট কাব্য সম্পর্কে লিখেছেন,"
সীমানার দাগিদাগে জমাট রক্তের দাগ কালনামি করে লঙ্কা ভাগ তবু এল স্বাধীনতার দিন উজ্জ্বল রঙিন প্রানের আবেগে অসীম। ডাক দেয় এই মাতা পদ্মা পিতা সিন্ধুতীর ৷
দীনেশ দাস