মৌখরী বংশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনা করো।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতীয় ইতিহাসের রাজনৈতিক মানচিত্রে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়েছিল। গুপ্তোত্তর পর্বে উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কতিপয় রাজশক্তি আত্মপ্রকাশ করে। এই সময় একটি বৃহৎ সাম্রাজ্যের পরিবর্তে স্থানীয় ভিত্তিতে কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের সৃষ্টি হয়েছিল। এই খণ্ডিত, বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন রাজ্যগুলিকে একসূত্রে গাঁথার মতো দৃঢ়চেতা, বিচক্ষণ কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব এই পর্বে হয়নি। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের প্রারম্ভে হর্ষবর্ধনের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে আসার পূর্ব মহূর্ত পর্যন্ত উত্তর ভারতের রাজনৈতিক আকাশ ছিল অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতার কালো মেঘে আচ্ছন্ন। এই পর্বে আবির্ভূত ক্ষুদ্র রাজ্যগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল কনৌজের মৌখরী বংশ যেটি আমাদের আলোচ্য বিষয়।
![]() |
সাসানীয় সাম্রাজ্যের রাজা প্রথম খসরু দাবার বোর্ডের সামনে বসে আছেন, যখন তার উজির এবং কনৌজের ভারতীয় দূত দাবা খেলছেন। শাহনামা , ১০ম শতাব্দী। |
মৌখরী নামটি অত্যন্ত প্রাচীন সম্ভবত এটি একটি প্রাচীন গোষ্ঠী খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে পতঞ্জলি এমনকি খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের পন্ডিত পানিনির রচনাতেও এই গোষ্ঠীর নাম-পাওয়া গেছে । সম্ভ মৌখীর উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বাস ছিলেন ক্ষত্রিয় এবং গুপ্তদের পতনের পর তাঁরা উত্তর ভারতের রাজনীতিতে পুকুরপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। মৌখরীদের সম্ভবত দুটি শাখা ছিল, একটি গয়া জেলাতে শাসনকারী অন্যটি রাজত্ব করতো কনৌজে। কনৌজের মৌখরী বংশ ভারত ইতিহাসে মৌখরী বংশরুপে প্রসিদ্ধ।
![]() |
মৌখরি রাজবংশের শর্ববর্মণের আসিরগড় সিল শিলালিপি , ষষ্ঠ শতাব্দী। |
কনৌজে মৌখরী বংশের কে প্রতিষ্ঠা করেন তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। তবে ভণ খ্রিস্টাব্দে প্রাপ্ত হরিবর্মার শংকরপুর তাম্রশাসনে মহারাজ গীতবর্মা ও মহারাজ বিজয়া তামহ ও পিতার নাম উল্লেখ থেকে মনে হয় এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাত নামে হরিবর্মার পিতামহ ছিলেন সম্ভবত গীতবর্মা। বিভিন্ন শিলালেখ, মুদ্রা ছাড়াও সমসাময়িক রচনা, বাণভট্টের হর্ষচরিত থেকে মৌখরীদের সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায় তা থেকে এই বংশের ৭ জন শাসকের নাম জানা যায়। তাঁরা হলেন যথাক্রমে মহারাজ হরিবর্মা, মহারাজ আদিত্যবর্য মহারাজ ঈশ্বরবর্মী, মহারাজাধিরাজ ঈশানবর্মা, মহারাজাধিরাজ শর্ববর্মা, মহারাজাধিরাজ অবন্তীবর্মা ও মহারাজাধিরাজ সুববা সূচ প্রমুখ। তবে বাণভট্টের হর্ষচরিত থেকে একমাত্র তথ্য পাওয়া যায় যে, অবন্তীবর্মার পর তাঁর পুত্র গ্রহবর্মা মৌখরী সিংহাসনে বসেছিলেন।
৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে শংকরপুর তাৎশাসন থেকে জানা যায় যে, মহারাজ হরিবর্মা বাজে খন্ডে গুপ্তসম্রাট বুধগুপ্তের অধীনস্থ একজন সামন্তরাজা ছিলেন। হরাহা লেখতে তবে জ্বালমুম বলা হয়েছে। হরিবর্মার পর এই বংশের সিংহাসনে বসেন রানি জয়স্বামিনীর গর্ভজাত পুত্র আদিত্যবর্মা। তাঁর সময় সম্ভবত মৌখরী ও উত্তরকালীন গুপ্ত রাজপরিবায়ে মধ্যে মৈত্রীসূত্র গড়ে উঠেছিল। আদিত্যবর্মার পর মৌখরী সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন তাঁয় পুত্র ঈশ্বরবর্মা। আদিত্যবর্মার সময় উত্তরকালীন গুপ্ত রাজপরিবারের সঙ্গে যে মৈত্রী বন্ধন গড়ে ওঠে ঈশ্বরবর্মার শাসনকালে উত্তরকালীন গুপ্তরাজাদের পরিবারের কন্যা উপগুপ্তবে বিবাহ করার মধ্য দিয়ে সেই সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হয়। জৈনপুর লেখতে ঈশ্বর বর্মনে। তিনট কৃতিত্ব পাওয়া যায়। যথা-
- তাঁর পরাক্রমে অস্ত্র নৃপতি বিখ্যাঞ্চলে পলায়ন করেন, তিনি সম্ভবত বিস্তৃকুন্ডি
- মৌখরীরাজ রৈবতক ও হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে সমরাভিযান করেন।
- তিনি হিংস্র প্রকৃতির শত্রুদের পরাভূত করে মানুষের উৎকণ্ঠা দূর করেন। ঈশ্বরবামার পর মৌখরী সিংহাসনে বসেন ঈশানবর্মা যিনি মৌখরী রাজ্যটিকে স্বাধীন
সার্বভৌম, বৃহৎ রাষ্ট্রে পরিণত করেন। তিনি প্রথম মহারাজাধিরাজ উপাধি গ্রহণ করেন নূরহ শিলালেখতে ঈশানবর্মা দাবি করেন যে, তিনি অল্প, শলিক ও গৌডদের পরাজিত করেছেন। পরাজিত শক্তিগুলিকে সাধারণভাবে শনাক্ত করা হয়ে থাকে অস্ত্র সালটি বিছুকুন্ডি, উড়িষ্যার সুলিক ও বাংলায় শাসনরত কিছু শন্তির সঙ্গে। উত্তরকালীন গুঞ্জনে সঙ্গে মৌখরীর যে প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল ঈশানবর্মার সময় তার অবসান হয় ৷
মগধের গুপ্ত বংশীয় শাসকদের সঙ্গে তিনি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন এবং কুমারগুপ্তও সম্ভবত মোগুতের কাছে তিনি পরাজিত হন। ঈশানবর্মা ও মহিষী লক্ষ্মীবতীর পুত্র শর্ববর্মা ছিলেন মৌখরী বংশের পরবর্তী শাসক। এজসেন পিতার সুযোগ্য পুত্র। তিনি উত্তরাধিকারীসূত্রে পিতার থেকে যা লাভগ্রেসেন তিনি তা কেবল রক্ষাই করেননি তার দক্ষিণ সীমান্তের বিস্ততিও ঘটান। নামার পর মৌখরী সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র অবন্তীবর্মা। দ্বিতীয় জীবিত গুপ্ত দেওবরনা দেবের থেকে প্রমাণিত হয় যে, তিনি একজন পরাক্রমশালী ও মাননীয় নরপতি ছিলেন।
এর পরবর্তী শাসক সম্পর্কে সেভাবে তথ্য পাওয়া যায় না তবে হর্ষবর্ধনের সভাকবি মলট্রের হর্ষচরিত থেকে জানা যায় যে, অবন্তীবর্মার জ্যেষ্ঠ পত্র ছিলেন মহারাজাধিরাজ প্রবর্মা এবং পিতার মৃত্যুর পর তিনি সিংহাসনে বসেন। নালন্দায় প্রাপ্ত একটি সিলমোহরে বাঁকার এক পুত্রের উল্লেখ আছে যাঁর নামের প্রথম অক্ষর সু ও দ্বিতীয় অক্ষর 'ব' এলবা চ. দীনেশচন্দ্র সরকার মনে করেন তাঁর প্রকৃত নাম সুব্রতবর্মা কিন্তু তিনি সুচন্দ্রবর্মা কে পারেন। তিনি সম্ভবত শশাঙ্কের অভ্যুত্থানের পূর্বকাল পর্যন্ত মগধে স্বাধীনভাবে রাজত্ব
পরিশেষে বলা যায় যে, গুপ্ত পরবর্তীকালে যে সমস্ত ক্ষুদ্র রাজ্যের উদ্ভব ঘটেছিল তাদের যা মৌখরী ছিল অন্যতম। এই বংশের শাসকরা তাদের রাজ্য সুদৃঢ়করণে মনযোগ দিলেও শ্যামা ও ঈশানবর্মা ছাড়া আর কোনো শাসক সেভাবে সফল হয়নি। সম্ভবত ঈশানবর্মার এ থেকে কনৌজের মৌখরী বংশের শাসকদের দুর্বলতা লক্ষণীয় হয়ে উঠে। তৎসত্ত্বেও গায়ায় যে, গুপ্ত পরবর্তী শাসনে উত্তর ভারতে ক্ষুদ্র রাজ্যগুলির মধ্যে মৌখরী কিছুকাল লর তাদের ক্ষমতা ধরে রেখেছিল।
ছবির সূত্রঃ- উইকিপিডিয়া
ইতিহাসের কন্ঠস্বর /itihasherkonthoshor
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ মৌখরী বংশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনা করো।Moukhari dynasty এই নোটটি পড়ার জন্য