অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলতে কী বোঝ?
প্রতিবাদী ধর্মান্দোলনের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় ছিল বৌদ্ধধর্মের কার্যকলাপ। আর এই বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক ছিলেন বুদ্ধদেব। তিনি ছিলেন একজন বাস্তববাদী সংস্কারক, তিনি বিশ্বাস করতেন প্রত্যেক মানুষের জীবনে দুঃখ অপরিহার্য। তিনি বলেন প্রত্যেক মানুষকে বিভিন্ন কর্ম করতে হয় আর সেই কর্ম থেকেই মানুষের আকাঙ্ক্ষা, আসক্তি ও দুঃখ প্রভৃতি জন্মায়। আর এই কামনা, বাসনা আকাঙ্ক্ষা ও দুঃখ থেকে মুক্তি পেতে গেলে একটা নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করতে হবে। তিনি বলেছেন যে দুঃখের হাত থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য যে পথ বা মার্গ অনুসরণ করতে হবে তার আটটি দিক আছে। এই আটটি পথ বা মার্গ একসঙ্গে অষ্টাঙ্গিক মার্গ নামে পরিচিত। এই মার্গগুলি হল যথাক্রমে-সৎ বাক্য, সৎ কার্য, সৎ জীবিকা, সৎ চেষ্টা, সৎ চিন্তা, সৎ চেতনা, সৎ সংকল্প ও সৎ দৃষ্টি।
এইসব পথ বা মার্গগুলির সমন্বিত রূপ 'মধ্যপন্থা' নামেও পরিচিত। সৎ বাক্য বলতে সত্য, প্রিয় ও মিতবাক্যকে বোঝায়। মিথ্যা কথা বলা, কটু কথা বলা ও বাচালতাকে এখানে ত্যাগ করতে বলা হয়। সৎকার্য বলতে কল্যাণকর কর্মকে বোঝায়। এখানে জীবহত্যা, চুরি ব্যাভিচারকে বর্জনের কথা বলা হয়। সৎজীবিকা বলতে সমাক জীবিকাকে বোঝায়।
সমাজের ক্ষতি হয় এমন সব জীবিকা পরিহার করতে বলা হয়। সৎচেষ্টা বলতে চারটি বিশেষ মানসিক প্রক্রিয়াকে বোঝায়। এগুলি হল কুচিন্তার পরিহার ও বিনাশ এবং সদিচ্ছার চয়ের ও বিকাশ। সৎচিন্তা বলতে দেহ ও মনের স্বরূপ স্মরণ রাখাই হল সৎচিন্তা। দেহ কয়েকটি অপবিত্র ও নম্বর পদার্থ দিয়ে তৈরি। ইন্দ্রিয় সুখের কারণে মন স্বভাবতই ধরা দিতে চায়। তাই এখানে ইন্দ্রিয় বন্ধন থেকে মনের মক্তির কথা অহরহ চিন্তা করা দরকার বলে মনে করা হয়। সৎচেতনা বলতে চিত্তের একাগ্রতাকে বোঝায়। চিত্তের একাগ্রতা মনের চঞ্চলতাকে দূর করে। সকলের প্রতি মৈত্রী ও করুণা প্রদর্শনের অঙ্গীকারই হল সৎসংকল্প। রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, স্পর্শ, কামনা জয় করে জিতেন্দ্রীয় হতে হবে। এই রিতেন্দ্রিয় হবার অঙ্গীকারও সৎ সংকল্প। সমাজে লোভ, হিংসা ও অনৈতিকতার দরুন পৃথিবী ভারাক্রান্ত, প্রকৃত শান্তি লাভ করতে গেলে এই সমস্ত বিষয়গুলিকে নিবৃত্ত করতে হবে এবং এই নিবৃত্তির জন্য সৎপথ ও অহিংসার পথ অনুসরণ করতে হবে। এই পথকেই তিনি 'সৎবৃষ্টি' বলে অভিহিত করেছেন ৷
আবার অষ্টাঙ্গিক মার্গের সঙ্গে তিনটি বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এগুলি হল প্রক্রমে-'শীল', 'চিত্ত' ও 'প্রজ্ঞা'। এখানে 'শীল' বলতে নৈতিক শুদ্ধতাকে বোঝায়।
চিত্ত' শব্দটি অভিধর্মপিটকে বিশেষভাবে উল্লেখিত রয়েছে। এর অর্থ হল ধ্যানের মাধ্যমে মানসিক সংযোগকে বজায় রাখা। 'প্রজ্ঞা' অর্থে পরম জ্ঞানকে বোঝায়। অর্থাৎ, বুদ্ধির বিকাশের মাধ্যমে একজন মানুষ সত্য বা বাস্তবকে উপলব্ধি করতে পারেন। আবার প্রবর সঙ্গ্যে নির্বাণের সংযোগ খুবই ঘনিষ্ঠ। 'নির্বাণে'র অর্থ হল চরম মুক্তি লাভ। উল্লেখ্য, ঠিক রাহুণ্য ধর্মবিরোধী মনোভাব এই মার্গগুলির মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে, কেননা এই খুলির অনুসরণের জন্য কোনো যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রয়োজন ছিল না। সবশেষে বলা যায় সঠিকভাবে ওই পথগুলি অনুসরণ করলে দুঃখের হাত থেকে মুক্তিলাভ অর্থাৎ, অভীষ্ট মুল্য পৌঁচানো সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।