দ্রাবিড় ও নাগর শিল্পশৈলী সম্পর্কে আলোচনা কর
মহাপুণ্যভূমি ভারতবর্ষকে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, ভারতের ধর্ম, ভারতের দর্শন, তার অধ্যাত্মবিদ্যা সর্বত্রকেই অধিকার করে আছে আধ্যাত্মিকতা, যার পরিপূর্ণ রূপের প্রকাশ ঘটে নির্মাণশৈলী বিশেষত মন্দির নির্মাণের মধ্য দিয়ে। ভারতীয় স্থাপত্য প্রায়শই ধর্মীয় চিন্তাধারার বাহকের ভূমিকা পালন করে। প্রাক্ ইসলামীয় যুগে ভারতীয় উপমহাদেশে যত স্থাপত্য নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে তা সবই হল ধর্মীয় স্থাপত্য। ভারতীয় শিল্পশাস্ত্রের অনুশাসনের ভিত্তিতে ভারতীয় মন্দির নির্মাণশৈলীকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়-দ্রাবিড়, নাগর ও বেসর এই মন্দিরশৈলীকে বিভক্তকরণের কাজটি করেন মনীষী ফার্গুসন।
এই মন্দিরশৈলীগুলির বিষয়ে প্রাপ্ত তথ্য বহুক্ষেত্রেই অপ্রতুল, তা সত্ত্বেই নির্মাণশৈলীর নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এগুলি স্বতন্ত্র হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। এখানে আমাদের প্রশ্নোলাচিত বিষয় হল দ্রাবিড় ও নাগর মন্দির নির্মাণশৈলীর বৈশিষ্ট্য।
'দ্রাবিড়' মন্দিরশৈলীর আলোচনা প্রসঙ্গে বলা যায় যে, এটি মূলত দক্ষিণ ভারতের কৃয়া নদী উপত্যকা থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে পরিলক্ষিত হয়। দ্রাবিড় স্থাপত্য শৈলীর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল পিরামিডের আকৃতির গম্বুজ। কেন্দ্রীয় গর্ভগৃহের অংশ স্তরে স্তরে এই অংশটি নির্মিত হয়েছে। প্রতি নিম্নস্তরের তুলনায় উচ্চ স্তরটি হ্রস্বাকৃতি এবং এইভাবে গম্বুজ অংশটি একটি পিরামিডের আকার ধারণ করে।
এই দ্রাবিড়শৈলীতে দেখা যায় গর্ভগৃহস্থ চতুর্ভুজ আকৃতির এবং এই গর্ভগৃহকে পরিবেষ্টিত করে অবস্থান করে প্রদক্ষিণ পথ। গর্ভগৃহের ঊর্ধ্বে থাকে ছাদ বহিঃপ্রাচীরকে কুলুঙ্গীর দ্বারা বিভক্তিকরণ এই ধরনের স্থাপত্যরীতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য। উত্তল ঘোরানো কার্নিশ, অশ্বক্ষুরাকৃতি চৈত্যগবাক্ষ এবং উচ্চস্তরের বহির্বিভাগের প্রসারিত কারুকার্যময় অংশও ছিল এই মন্দিরশৈলীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। স্তম্ভযুক্ত বিশাল কক্ষ বা মন্ডপ। গর্ভগৃহ ও মন্ডপের মধ্যস্থ সরু চলাচলের পথ বা অন্তরাল এবং বিশাল গোপুরম্ বা প্রবেশদ্বার ছিল দ্রাবিড়ীয় মন্দিরশৈলীর অপরিহার্য অংশ। দ্রাবিড়ীয় মন্দিরশৈলীর কতগুলি উদাহরণ হল-কর্ণাটকের লাদঘানের শিবমন্দির, মধ্যপ্রদেশের নাচনাকুঠারার পার্বতী মন্দির প্রমুখ।
পরবর্তী মন্দির স্থাপত্যরীতির মধ্যে নগরশৈলী এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য রীতি। 'নাগর' রীতি মূলত হিমালয় পর্বত থেকে বিন্ধ্য পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের মধ্যে লক্ষিত হয়। নাগর মন্দিরশৈলীর প্রারম্ভিক প্রয়াস শুরু হয় খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে, (ভিতরগাঁয়ের) বা (ভিতেরগাঁওয়ের) ইটের মন্দির ও দেওগড়ের দশাবতার মন্দিরে প্রথম এই রীতির প্রয়োগ দেখা যায়। শিল্পশাস্ত্রগ্রন্থগুলিতে একেই নাগররীতি বলে। উড়িষ্যার অনেকাংশে মন্দির নাগররীতি শৈলীতে নির্মিত। মূলত খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে উড়িষ্যায় প্রথম এই রীতির প্রয়োগ ঘটানো হয়।
নাগর স্থাপত্য রীতির মধ্যে দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। প্রথমত, এগুলি উচ্চাকৃতি এবং গর্ভগৃহের ওপর শিখর অবস্থিত। দ্বিতীয়ত, এগুলি আয়তাকার এবং প্রতিপার্শ্বের মধ্যস্থল ক্রমিক অংশে বিভক্ত ও প্রসারিত। এই প্রতিপার্শ্বের মধ্যস্থল ক্রমিক অংশে বিভক্ত ও প্রসারিত। এই প্রতিপার্শ্বের প্রসারিত অংশে রয়েছে বহু পুনঃপ্রবেশকারী কোণ। এই বিশেষ নকশা মন্দিরটিকে একটি ক্রুশের আকৃতি প্রদান করেছে। এই মন্দিরগুলি উচ্চ হয় এবং ক্রুশোর আকার ধারণ করে শিখরের আকৃতি হয় গম্বুজের ন্যায়। নাগরশৈলীতে 'রেখ শিখর' এর উপস্থিতি লক্ষিত হয়। এই শিখরে উপস্থিতির জন্য নাগরশৈলীর মন্দিরকে 'রেখ দেউল'ও বলা হয়।
নাগরশৈলীর আয়তাকার নকশায় প্রতিপার্শ্বের প্রসারিত অংশের দ্বারা যে কোণগুলি সৃষ্টি হয়, তাকে শিল্পশাস্ত্রের পরিভাষায় বলে অস্র। সংস্কৃত গ্রন্থসমূহে এই কোণগুলিকে বলে 'রথক', উড়িষ্যার শিল্পশাস্ত্রে একে বলা হয়েছে রথ। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন গ্রন্থে এই মন্দিরগুলিকে চতুরাশ্র, আয়তাত্র ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। কোণের সংখ্যার বিচারে ত্রিরথ, পঞ্চরথ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। তবে ক্রুশাকৃতি নকশা এবং ক্রম বক্রাকার শিখর যে-কোনো নাগর মন্দিরের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে গণ্য হতে পারে। নাগর স্থাপত্যের মৌলিক উপস্থিতি প্রথম খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে নির্মিত মন্দিরগুলিতে দেখা যায়। আমলক শিলার ব্যবহার হল নাগর শিল্পরীতির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
পরিশেষে বলা যায়, উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে ভারতীয় মন্দির স্থাপত্যশৈলী অত্যন্ত অসাধারণ ও চিত্তাকর্ষক বিষয়। এখানে আলোচিত দ্রাবিড়, নাগররীতি শৈলীর মধ্য দিয়ে অসাধারণ কারুকার্যময়তা, দক্ষতা ও কারিগরী বিদ্যার পরিচয় পাওয়া যায়, যা প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্যশৈলী তথা মন্দির নির্মাণ শৈলীকে সমৃদ্ধতা দান করেছে।