কলিঙ্গ যুদ্ধের রাজনৈতিক তাৎপর্য আলোচনা করো। বা,অশোকের কলিঙ্গ যুদ্ধের তাৎপর্য কী ছিল।
ভারত তথা বিশ্ব ইতিহাসে কিছু বিরল ব্যক্তিত্ব তাঁদের নিজ কৃতকর্মের জন্য ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। অশোক ছিলেন সেই সকল ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। যিনি আনুমানিক ২৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পাটলিপুত্রের সিংহাসন আরোহণের মধ্য দিয়ে মগধের শাসকরূপে অধিষ্ঠিত হন। তিনি ছিলেন একজন ক্ষমতাবান দক্ষ সুশাসক, প্রজাহিতৈষী সম্রাট। যে-কোনো ক্ষমতাশালী সম্রাটের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হল রাজ্যজয়ের মাধ্যমে তার সাম্রাজ্যের সীমানাকে বর্ধিত করা। সম্রাট অশোক তাঁর চারদশকব্যাপী রাজত্বকালে মাত্র একটি যুদ্ধই করেছিলেন। তা ইতিহাসে 'কলিঙ্গ যুদ্ধ' নামে পরিচিত। সাম্রাজ্যবাদী সম্রাট অশোক নানা কারণে কলিঙ্গ অভিযান করেছিলেন। সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা, দক্ষিণের রাজ্যগুলির সঙ্গে শক্তিজোট গঠন, সামুদ্রিক বাণিজ্যে নিয়ন্ত্রণ ও সাম্রাজ্যের বিস্তারের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তিনি কলিঙ্গ অভিযান করেন ৷
কলিঙ্গ যুদ্ধে সম্রাট অশোক বিজয়ী হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু এই বিজয় সহজ পথে হয়নি। এই যুদ্ধের ভয়াবহতা প্রকাশিত হয়েছে ত্রয়োদশ গিরিশাসনে। এই গিরিশাসনে অশোক নিজেই স্বীকার করেছেন যে, এই যুদ্ধে দেড় লক্ষ মানুষ বন্দি হয়েছিল এবং একলক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। যুদ্ধের পর কলিঙ্গ মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও ব্যাপক প্রাণসংহার ও ক্লেশদর্শনে গভীর অনুশোচনায় অনুতপ্ত অশোক আগ্রাসী যুদ্ধের নীতি পরিত্যাগ করে অহিংসা, মৈত্রী ও শান্তির আদর্শকে সামনে রেখে রাজকার্য পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
কলিঙ্গ যুদ্ধের প্রভাব ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই যুদ্ধের ভয়াবহতায় অশোকের মননে, চিন্তনে, কার্যকলাপে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল। এই পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছিল তাঁর সকল কর্ম, ধর্ম, অনুশীলনে ও প্রচারে, শাসনব্যবস্থায় ও পররাষ্ট্র নীতিতে। ধম্মনীতি প্রবর্তনের মাধ্যমে সমস্ত শ্রেণির মানুষের মধ্যে এক শান্তির বাতাবরণ তৈরি করলেন। দ্বাদশ মুখ্য গিরিশাসনে তিনি সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের কথা বলেছেন।
কলিঙ্গ যুদ্ধের পর একজন রাজার দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে অশোক সচেতন হয়েছিলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, 'সবে মুনিসে পজা মমা' অর্থাৎ, প্রজারা রাজার সন্তান। জনকল্যাণের আদর্শকে সামনে রেখে অশোক তাঁর রাজ্যাভিষেকের ত্রয়োদশ বছরে 'ধর্মমহামাত্র' নামক একশ্রেণির নতুন কর্মচারী নিয়োগ করেছিলেন। যাদের কাজ ছিল ধর্মের প্রচার করা ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের রক্ষণাবেক্ষণ করা। এছাড়া বিভিন্ন সম্প্রদায়ের (কম্বোজ, রাষ্ট্রিক, ভোজ, অন্ধ্র, পুলিন্দ প্রভৃতি) মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্যও অশোক তাদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
সাধারণ মানুষ যাতে সমস্ত রকম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারেন এ ব্যাপারেও তিনি সচেতন ছিলেন। এই কারণে তিনি কুপখনন, বৃক্ষরোপণ এবং বিশ্রামাগার স্থাপন করেছিলেন। এছাড়াও তিনি তীর্থস্থানাদি পরিদর্শনের ব্যবস্থা করেছিলেন, ব্রাহ্মণ-শ্রমণ ও বৃদ্ধদের উদ্দেশ্যে দান-ধ্যানের ব্যবস্থা করেছিলেন, মানুষ ও পশুর জন্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। তিনি বলেন, জনকল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে আমি প্রজাদের ঋণশোধ করতে চাই।
রাজত্বের প্রথমদিকে অশোক পিতামহের অনুসৃত নীতিতে শাসন পরিচালনা করতেন। কিন্তু এই যুদ্ধের ফলে প্রশাসন, সামরিক, বিচারব্যবস্থা সর্বক্ষেত্রেই তার দায়িত্ববোধ জাগরিত হয়েছিল। অশোক তাঁর আদর্শকে রূপায়িত করার জন্য বহু আধিকারিক নিয়োগ করেছিলেন। এঁরা হলেন মহামাত্র, মুখ্য, রাষ্ট্রিক, রাজুক, প্রাদেশিক, যুক্ত, নগর-ব্যবহারক, পুরুষ, প্রতিবেদক, দূত, আয়ুক্ত, ব্রজভূমিক, লিপিকর ও কারণিক। এই সমস্ত আধিকারিকরা এক-একটি বিষয় তত্ত্বাবধান করতেন। সম্রাটের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতেন। সাধারণ মহামাত্রদের দায়িত্ব ছিল সাধারণ প্রশাসন, নগর প্রশাসন, জরুরি ও পরিদর্শনমূলক কাজের।
এই যুদ্ধের পর অশোক তাঁর বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে কিছু সংস্কার সাধন করেন। আগে শাস্তির ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণরা যে বিশেষ সুবিধা লাভ করতেন অশোক তা রদ করেন। তিনি দণ্ড সমতা ও ব্যবহার সমতা নীতি প্রয়োগ করেন। ফৌজদারি দণ্ডবিধির কঠোরতা হ্রাস করেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে কয়েদিদের মুক্তিদানের ব্যবস্থা করেন। কলিঙ্গ রাজ্য জয়ের পর অশোক সাম্রাজ্যবাদী নীতি সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে বিভিন্ন বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ভাব বিনিময়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি দূতদের বিদেশে পাঠিয়েছিলেন। এমনকি প্রতিবেশী রাজ্য চোল, পান্ড, কেরলপুত্র, সত্যপুত্রের সঙ্গেও তিনি সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন।
কলিঙ্গ যুদ্ধের পর মৌর্য সাম্রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত হয়েছিল। উত্তরে আফগানিস্তান থেকে দক্ষিণে কর্ণাটক, পশ্চিমে কাথিয়াওয়াড় থেকে পূর্বে কলিঙ্গ পর্যন্ত এক সুবিশাল এলাকা পর্যন্ত মৌর্য সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করেছিল। এত কিছুর পরেও অশোক কলিঙ্গের ওপর কর্তৃত্ব ত্যাগ করেনি। কলিঙ্গকে অশোক সরাসরি স্বীয় প্রশাসনিক-রাজনৈতিক প্রাধান্যের অধীনে রেখেছিল এই বিষয়টি একটু বিস্ময়ের।
সম্রাট অশোক ছিলেন সমদর্শিতার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। আইনের চোখে ধনী, দরিদ্র, ব্রাহ্মণ, শ্রমণ, শূদ্র সকলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করে তিনি সামাজিক বৈষম্য দূর করেছিলেন, বিভিন্ন আধিকারিক নিয়োগ করে জনকল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে তিনি প্রজাদের সমস্ত রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিলেন, ধর্মমহামাত্রদের নিয়োগ করে ধর্মের প্রচার করেছিলেন। অধ্যাপক হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী কলিঙ্গ যুদ্ধের পর ভারত ইতিহাসের চিরাচরিত নীতির পরিবর্তনের চিত্র তুলে ধরেছেন। কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোকের চরিত্রের আমূল পরিবর্তন এসেছিল যার সূত্র ধরে মৌর্য রাষ্ট্রব্যবস্থায় এক বিরাট পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল কলিঙ্গ বিজয় ও মৌর্য সাম্রাজ্যে কলিঙ্গের অন্তর্ভুক্তি এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পরিণতি ও পূর্ণচ্ছেদরূপে দেখা দিল।