গুপ্ত পরবর্তী যুগের শিল্প ও স্থাপত্য সম্পর্কে আলোচনা করো।

গুপ্ত পরবর্তী যুগের শিল্প ও স্থাপত্য সম্পর্কে আলোচনা করো।

 গুপ্ত পরবর্তী যুগের শিল্প ও স্থাপত্য সম্পর্কে আলোচনা করো।

গুপ্ত পরবর্তী যুগের শিল্প ও স্থাপত্য সম্পর্কে আলোচনা করো।

গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর সমগ্র ভারতবর্ষের সর্বত্রই এক পরিবর্তন ঘটে এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতার সূত্রপাত হয়। আঞ্চলিক এই নব-রাজবংশগুলি কেবল রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্যেই নয় বিভিন্ন শিল্প স্থাপত্যের দিকেও যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন। গুপ্ত পরবর্তী যুগে বলভীর মৈত্রক বংশ, পরবর্তী গুপ্ত বংশ, কনৌজের মৌখরী বংশ, উত্তর ভারতে থানেশ্বরের পুয্যভূতি বংশ, দক্ষিণ ভারতের বাতাপির চালুক্য বংশ, পল্লব বংশের নাম যথেষ্ট উল্লেখ্য। গুপ্ত পরবর্তী পর্যায়ে গড়ে ওঠা এই রাজবংশগুলির শিল্প স্থাপত্যবিষয়ক আলোচনা আমাদের আলোচ্য বিষয়।


গুপ্ত সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের ওপর যে সমস্ত রাজ্যের উদ্ভব ঘটেছিল সেগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি স্বায়িত্ব লাভ করেছিল বপ্নভী রাজ্য। পরবর্তীকালে পূর্ব ভারতে উত্থান ঘটে 'পরবর্তী গুপ্তবংশ' এছাড়াও কনৌজের মৌসরী বংশ, থানেশ্বরের পুয্যভূতি বংশে প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া ছিল গৌড়ের শশাঙ্কেনা রাজ্য। এই রাজবংশগুলির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, সাম্রাজ্য বিস্তার, শাসন কাঠামো নির্মাণে প্রভূত কৃতিত্ব থাকলেও শিল্প স্থাপত্যের ক্ষেত্রে তেমন গুরুত্ব দেখা যায় না। আবার দাক্ষিণাত্যের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, এই সময় বাতাপির চালুক্য বংশ এবং দক্ষিণ ভারতে পল্লব বংশ তাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে শিল্প স্থাপত্যের ক্ষেত্রে বহু উৎকৃষ্ট নিদর্শন লক্ষিত হয়। 



তবে থানেশ্বরের পৃষ্যভূতি বংশীয় রাজা হর্ষবর্ধনের সময়কালে কিছু স্থাপত্যশৈলীর কথা জানা যায়। হিউয়েন সাঙ লিখেছেন, হর্ষবর্ধনের সময় পাটলীপুত্রের পরিবর্তে কনৌজ উত্তর ভারতের প্রধান নগরে পরিণত হয়। এই নগরটি ছিল বেলাগড়, সুন্দর ও সুরক্ষিত। এখানে ১০০টি বৌদ্ধবিহার ও ২০০টি দেবমন্দির ছিল। এছাড়া জনশ্রুতি অনুসারে তিনি বহু বৌদ্ধস্তূপ ও বিহার নির্মাণ করেন।


গৌড়ের শাসক শশাঙ্কের সময়ের কিছু স্থাপত্য ভাস্কর্যের সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রাচীন কর্ণ-সুবর্ণ ও কয়েকটি অঞ্চলের প্রত্নস্থল থেকে সংগৃহীত হয়েছে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতকের কিছু নিদর্শন। রাজবাড়িডাঙায় উৎখননের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে ইষ্টকনির্মিত মনোরম সৌধের ধ্বংসাবশেষ। এখানে দেখা গেছে যে, রাজবাড়িডাঙায় প্রতিটি মন্দির ছিল প্রাকার দ্বারা পরিবেষ্টিত। প্রাচীর বেষ্টনীর মধ্যে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ এবং চারকোণ সমচতুষ্কোণাকারের ক্ষুদ্রায়তন মন্দিরসদৃশ সৌধকেন্দ্র প্রধান মন্দির প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আবিষ্কৃত মন্দিরের মধ্যে পঞ্চায়তন মন্দিরটি উল্লেখের দাবি রাখে। কেন্দ্রের ত্রিরসমন্দির এবং গর্ভগৃহের নির্মাণ কৌশল প্রশংসা করার মতো। ইষ্টকনির্মিত বেষ্টনী দেওয়ালের বহিরাংশের প্রতিমাটার পংক্তি সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয়। দেওয়াল চুনের পলেস্তারায় আবৃত ছিল। প্রতি সমকোণী আয়তক্ষেত্রের আধারে স্টাকো মূর্তি সন্নিবেশিত থাকত। চুনের পলেস্তারার ওপর অনেক সময় লাল মৃত্তিকার প্রলেপ দেওয়া হত। সৌধাদির শিল্পরীতি সপ্তম-অষ্টম শতকের বাংলার স্থাপত্যবিদ্যার উৎকর্ষের পরিচায়ক।


রাক্ষসীডাঙা ও রাজবাড়িডাঙায় উৎখননের ফলে বহু মনোরম ভাস্কর্য নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। নিদর্শনগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য বুদ্ধের স্টাকোমুন্ড। প্রাক গুপ্ত ও পরবর্তী গুপ্তযুগের কয়েকটি পোড়ামাটির মূর্তি ও তিনটি ব্রোঞ্জ মূর্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য (দুটি বুদ্ধ ও একটি গণেশ)। তাছাড়া বৌদ্দ্যতারা (ব্রোঞ্জ), বৌদ্ধধর্মচক্র (ব্রোঞ্জ) ইত্যাদি। নির্মাণরীতির বিচারে মূর্তিগুলি অষ্টম শতকের।


বাদামির চালুক্য রাজাদের খ্যাতি কেবল রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিষয়ের মধ্যেই সীমাবধ ছিল না সাংস্কৃতিক দিক থেকে মূলত স্থাপত্য ভাস্কর্যের অনুরাগী পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। চালুক্য আর রাষ্ট্রকূটদের পৃষ্ঠপোষকতায় ইলোরার প্রায় ১৬টি গৃহ স্থাপত্যের নিদর্শন মিলেছে। এগুলির মধ্যে দশাবতার, রাবণ-কা-ঘাই, রামেশ্বর প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বাদামি ও আইহোলে দুটি জৈন গুহা স্থাপত্যের ইঙ্গিত মিলেছে। মন্দির স্থাপত্যের ক্ষেত্রে চালুক্যদের অবদান কম নয়। দাক্ষিণাত্যে প্রথমদিকে ৫৫৩ থেকে ৬৪২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পশ্চিমী চালুক্যরা পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। এই অঞ্চলগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-আইহোল, পণ্ডদকল, মহাকুট, বাদামি, আলেমপুর। কর্নাটকের বিজাপুর জেলার বাদামিতে অবস্থিত আইহোলে আদি চালুক্য পর্বের প্রায় ৭০টি মন্দির রয়েছে। তাদের মধ্যে ৩০টি প্রাকারবেষ্টিত এবং বাকিগুলি নগরপ্রান্তে অবস্থিত।


আইহোলকে বলা হয় ভারতীয় মন্দির স্থাপত্যের লালনক্ষেত্র। মন্দিরগুলি ভাস্কর্যসদৃশ সুক্ষ্ম ও বিশদ কারকার্য সমন্বিত। আইহোলের তিনটি বিশেষ স্থাপত্য নিদর্শন ৪৫-অদখানের মন্দির, দুর্গামন্দির, ইচ্চিমলিগুড়ি মন্দির। আইহোলে মন্দিরগুলির মধ্যে প্রাচীনতম হল লাদখানের মন্দির।


বাদামির স্থাপত্যরীতিতে দেখা যায় যে, পাহাড় কেটে মন্দিরগুলি নির্মাণ করা হয়েছে। গোমিতে এই ধরনের একগুচ্ছ স্থাপত্যকীর্তি দেখা যায়। এদের মধ্যে তিনটি হিন্দমন্দির * একটি জৈন মন্দির উল্লেখযোগ্য। মালানিটি শিবালয় আকারে ক্ষুদ্র হলেও অত্যন্ত প্রতি সুন্দর একটি মন্দির।


দাক্ষিণাত্যে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতক চালুক্য ভাস্কর্যের বিকাশের কাল। চালুক্য ভাস্কর্যের এখন কেন্দ্র আইহোল, বাদামি ও পত্তদকল, কোন্টিগুড়ির মন্দিরগুলির বারান্দাসদৃশ মণ্ডপে সলিং-এর পাথরের বড়ো বড়ো তিনটি ফলকে বামদিক থেকে ডানদিকে পরিলক্ষিত হয়, গরমে ব্রহ্মা, উমা, মহেশ্বর ও বিষ্ণুমূর্তি। বাদামির ১নং গৃহামন্দিরে নৃত্যরত বিশেষ মূর্তি এবং ২নং গুহামন্দির চিত্তবিনোদনরত দ্বারপালের মূর্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাদামির এনা গুহামন্দিরে ত্রিবিক্রম হরিহর ও নরসিংহের মূর্তি অতি উন্নতমানের ভাস্কর্যের নিদর্শন ৷



গল্পবযুগের মন্দিরগুলিতে সর্বপ্রথম দ্রাবিড় স্থাপত্যরীতির পরিচয় পাওয়া যায়। পল্লব খাপত্যের চারটি ধারা লক্ষ করা যায়। মহেন্দ্রধারা-পল্লবরাজ প্রথম মহেন্দ্রবর্মনের রাজত্বকালে পাহাড় কেটে মন্দির তৈরি শুরু হয়। মহেন্দ্ররীতির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পাহাড়ের ভিতরটা পুরো কেটে তার ভিতরে গুহামন্দির তৈরি করা, ছাদ ধরে রাখার জন্য ত্রিকোণ বাম অথবা গোলাকার থাম, এর পরবর্তী পর্যায়ে মামল্লধারার প্রবর্তন ঘটে। এই রীতিতে গহাড় কেটে রথের আকারে মন্দিরগুলি তৈরি হয়। রথ মন্দিরের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল অলংকৃত প্রধান প্রবেশপথ, অষ্টকোণ স্তম্ভশীর্ষ এবং দেওয়ালে উৎকীর্ণ রাজারানির চিত্র। নাবলীপুরম্-এর উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এর পরবর্তী পর্যায়ে রাজসিংহ ধারার প্রবর্তন হয়। এই রীতিতে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র মন্দির নির্মাণ শুরু হয়। চতুর্থ ধারাটি ছিল অপরাজিত ধারা। এটি চোল শিল্পের অনুকরণে তৈরি। কাঞ্চীর কৈলাশনাথ মন্দির ও বৈকুন্ঠ পেরুমল মন্দির-এর উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। পল্লব ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে পল্লব রাজাদের গৌরব বর্ণিত এয়। এস. কে. সরস্বতী-র মতে, পল্লব ভাস্কর্য লেঙ্গিতে অমরাবতীর ভাস্কর্যরীতির ধারা প্রভাবিত। পল্লব ভাস্কর্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন মহাবলীপুরমের গঙ্গাবতরণ রিলিফ। মহাবলীপুরমের রিসিফটিকে অনেকে 'পাথরের প্রাচীর চিত্র' বলে অভিহিত করেন। পল্লব ভাস্কর্যে পশুমূর্তি বিশেষত হাতির মূর্তি অতুলনীয়। মূর্তিগুলি খুবই স্বাভাবিক ও বাস্তব।


পরিশেষে বলা যায় যে, উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায় গুপ্ত পরবর্তী যুগের শিল্পস্থাপত্য। নিঃসন্দেহে এক প্রশংসার দাবি রাখে। যার আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা সেই সময়কার সার্বিক সমৃদ্ধির পরিচয় পাই।

তোমাকে অনেক ধন্যবাদ গুপ্ত পরবর্তী যুগের শিল্প ও স্থাপত্য সম্পর্কে আলোচনা করো। এই নোটটি পড়ার জন্য

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟