বাংলায় হুসেন শাহের শাসনকালের সাংস্কৃতিক জীবন আলোচনা করো।
উত্তর ভারতের সঙ্গে এই যুগে বিচ্ছিন্ন হওয়াতে বাংলাদেশ তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে বিকশিত করার সুযোগ লাভ করেছিল। এইযুগে সাহিত্য ও সংস্কৃতির স্ফুরণ সম্পর্কে উল্লেখ করে ঐতিহাসিক তরফদার বলেছেন যে, সাহিত্যের ক্ষেত্রে এইসময় একটি রেনেসাঁ বা নবজন্ম দেখা যায়। হুসেন শাহী যুগের শাসকরা বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং জনসংযোগের এই মাধ্যমকে জনপ্রিয়তার অন্যতম বাহন বলে গণ্য করতেন। সংস্কৃত মহাকাব্য রামায়ন ও মহাভারতের বঙ্গানুবাদ, লৌকিক দেবদেবীর কাহিনী ও স্থানীয় সাহিত্যের বিকাশে সুলতান ও তাঁর আমলাদের অকুন্ঠ সমর্থন ছিল। ব্রাহ্মহ্মণ্যধর্মের প্রভাবও এযুগে লক্ষ্য করা গিয়েছিল। এইযুগে ফার্সী ও আরবী ভাষাও অবহেলিত হয়নি।
হুসেন শাহী আমলে অনুসৃত সকল ধর্মের প্রতি উদারতা ও সমন্বয় নীতি এযুগের সাংস্কৃতিক বিকাশের অন্যতম কারণ। মনসামঙ্গলের লেখক বিজয়গুপ্ত সুলতান হুসেন শাহকে 'নৃপতি তিলক' বলে উল্লেখ করেছেন। দ্বিজ বিপ্রদাসের মনসামঙ্গলে সুলতান হুসেন শাহর প্রভুত প্রশংসা করেছিলেন। কবি যশোরাজ খান বসু সুলতান হুসেন শাহর পৃষ্ঠপোষকতা লাভকরেছিলেন। তিনি সুলতান হুসেন শাহকে কবি 'জগৎভূষণ' বলে উল্লেখ করেছেন।
চট্টগ্রামের শাসক পরগল খাঁর উৎসাহে কবিন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের অংশবিশেষের বঙ্গানুবাদ করেছিলেন। পরগল খাঁর পুত্র ও চট্টগ্রামের পরবর্তী শাসক ছুটী খাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় কবি শ্রীকর নন্দী অশ্বমেধ পর্বের রচনা করেন। সুলতান ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের অনুসরণ করে অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাসকরাও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। ষোড়শ শতকে বাংলা সাহিত্যের বিকাশের জন্য শ্রীচৈতন্যের জীবনী কাব্যের বিশেষ অবদান আছে। বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবৎ, কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য চরিতামৃত, জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল ও লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গল বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল রত্ন। এছাড়া লৌকিক সাহিত্য, জনগণের বিশ্বাস ও পৌরাণিক কাহিনী সম্বলিত মঙ্গলকাব্য এযুগের বাংলা সাহিত্যের বিকাশের অন্যতম নিদর্শন।
সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য রাজসভায় সমাদৃত না হলেও বাংলা ও মিথিলায় সংস্কৃত চর্চার কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। সংস্কৃত সাহিত্যে এযুগে অনুপ্রেরণার প্রধান উৎস ছিল চৈতন্যজীবনী ও রাধাকৃষ্ণ লীলা কাহিনী। মুরারী গুপ্তের চৈতন্যচরিতামৃতই ছিল সম্ভবতঃ শ্রীচৈতন্যের জীবনকাহিনী নিয়ে রচিত প্রথম গ্রন্থ। হুসেন শাহের মন্ত্রী রূপ গোস্বামী রাধাকৃষ্ণ লীলা নিয়ে দানকেলী কৌমদী, ললিতমাধব ও বিদগ্ধ মাধব নামক নাটক রচনা করেছিলেন। বাংলাদেশের পণ্ডিতগণ এই যুগে স্মৃতি ও ন্যায়শাস্ত্রের চর্চায় সময় ব্যয় করতেন। এইযুগে নব্যন্যায়ের চর্চার জন্য নবদ্বীপ প্রসিদ্ধিলাভ করেছিল। রঘুনন্দনের ধর্মশাস্ত্র বিষয়ক আলোচনা ও তর্কশাস্ত্রে রঘুনাথ শিরোমণির যশ এবং শ্রীচৈতন্যের সংস্কৃতে ব্যুৎপত্তি এযুগে সুপরিচিত ছিল। শ্রীচৈতন্যের ভক্তি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এইসময় বঙ্গদেশে সাহিত্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক আলোড়ন হয়। কিন্তু সংস্কৃত পণ্ডিতদের অনেকেরই লক্ষ্য ছিল প্রাচীন ধর্মীয় প্রথা ও নিয়মগুলিকে পুনরুজ্জীবন করে নতুনের জোয়ারের বিরুদ্ধে বাঁধ দেওয়া। ফলে তাঁরা সামাজিক প্রগতি ও পরিবর্তনের বিরোধী ছিলেন।