মহম্মদ-বিন-তুঘলকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা আলোচনা করো। দিল্লি সুলতানির পতনের জন্য মহম্মদ-বিন-তুঘলক কতখানি দায়ী ছিলেন।
ষোড়শ শতকের ঐতিহাসিক বাদায়ুনী মন্তব্য করেছেন যে, মৃত্যুর শীতল স্পর্শে সুলতান তাঁর প্রজাদের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন এবং তাঁর প্রজারাও সুলতানের হাত থেকে মুক্তি লাভকরেছিল। কেমব্রিজ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া (৩য় খণ্ডের) সম্পাদক স্যার উলসী হেগ লিখেছেন যে, মহম্মদ বিন তুঘলক একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি ছিলেন এবং তাঁর চরিত্রের স্ববিরোধ, যাঁরা তাঁকে জানতেন তাঁদের কাছে বিভ্রান্তিকর বলে মনে হত।
শাসক হিসেবে মহম্মদ বিন তুঘলক নিঃসন্দেহে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি যেসব বিভিন্ন সংস্কারের প্রবর্তন করেন তার প্রায় প্রত্যেকটি ব্যর্থতায় পরিণত হয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে সুলতান বহু সদ্গুণের আধার হলেও তাঁর নিষ্ঠুরতা ও খামখেয়ালীর জন্য তিনি প্রজাদের সহানুভূতি থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। বারানী বলেছেন যে, 'সুলতান অকারণে নিরাপরাধ মুসলমানদের রক্তপাত করেছেন'। কিন্তু কেবল মুসলমানদের নয়, মহম্মদ বিন তুঘলকের সঙ্গে মতবিরোধের জন্য তিনি সকলকেই কঠোর শাস্তিবিধান করতেন।
সমকালীন লেখকদের মধ্যে আরব ভ্রমণকারী ইবনবতুতা, ইসেমী এবং তারিখ-ই-ফিরোজশাহীর লেখক জিয়াউদ্দীন বারানী সুলতানের কঠোর সমালোচনা করেছেন। ইবন বতুতা সুলতানের নিষ্ঠুর শাস্তিদানের কথা বারংবার উল্লেখ করেছেন। এইসব উদাহরণগুলির মধ্যে কিছু কিছু অতিরঞ্জনের নমুনাও পাওয়া যায়। যথা রাজধানী পরিবর্তনের সময় একজন অন্ধ ও খঞ্জকে জোরজবরদস্তি নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় তাদের মৃত্যু বা সমস্ত দিল্লীর জনগণকে দেবগিরি যেতে বাধ্য করার কাহিনী প্রভৃতি। বারানী সুলতান ফিরোজ তুঘলকের আমলে ইতিহাস রচনা করেন এবং ফিরোজ তুঘলক তাঁর পূর্বসূরীর প্রতি শ্রদ্ধাবান ছিলেন। এই কারণে বারানী তাঁর লেখনীতে মহম্মদ বিন তুঘলক সম্পর্কে কিছুটা সংযত ভাবে মন্তব্য করেছেন। এতদসত্বেও বারানীর লেখায় স্ববিরোধ যেকোন পাঠকের কাছে কোন কোন ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট। বারানী এক জায়গায় মন্তব্য করেছেন যে, রাজধানী পরিবর্তনের পর একটি কুকুর বা বেড়ালও দিল্লীতে ছিল না, আবার আরেকজন বলেছেন যে, কেবলমাত্র উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরাই দৌলতাবাদে প্রেরিত হয়েছিল। দক্ষিণ ভারতীয় ঐতিহাসিক ইসেমী ছিলেন আরেকজন সমকালীন লেখক। তাঁর মতে, সুলতান আলাউদ্দীন খলজী সুলতানী আমলের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন এবং মহম্মদ বিন তুঘলক ছিল নিকৃষ্টতম শাসক। ইসেমী সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলককে হেয় করার জন্য তার গ্রন্থ ফুতু-উস-সালাতিনে চরম অতিরঞ্জনের আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি বলেছেন, রাজধানী পরিবর্তনের সময় দিল্লী শহরের অসূর্যস্পশ্যা নারী থেকে সকল ব্যক্তিকে দৌলতাবাদে যেতে বাধ্য করা হয়।
সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক রাজ্য ও রাজনীতিতে উলেমাদের হস্তক্ষেপের বিরোধী ছিলেন। এবিষয়ে তাঁর মনোভাব ইবনবতুতার লিখিত রেহেলা বা ভ্রমণকাহিনীর নানা বক্তব্যের মধ্যে সুস্পষ্ট। ইবনবতুতা উল্লেখিত ঘটনাবলীর মধ্যে অন্যতম হল উলেমা আফিফ উদ্দীন সুলতানের খরাপীড়িত এলাকার মানুষের জন্য যেসব কূপ খনন ও অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন সেই বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করাতে সুলতান তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছিলেন সুলতান তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন 'আপনি কেন রাষ্ট্রের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন'? সুলতান রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতাদের প্রভাব সহ্য করতে রাজি ছিলেন না। মহম্মদ বিন তুঘলকের উদারতা ও উলেমাদের প্রতি অবহেলা রক্ষণশীল সমাজের প্রধানদের তাঁর প্রতি বিরূপ হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল।
সুলতানের প্রতি তৎকালীন শাসকশ্রেণীর বিরূপ হওয়ার আরেকটি কারণ হ'ল তিনি বারানীর মতে, নিম্নশ্রেণীদের অর্থাৎ হিন্দুস্তানীদের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। দাক্ষিণাত্যে ও গুজরাটে আমিরন-ই-সদা বা বিদেশাগত অভিজাতরা এই কারণে বিদ্রোহী হয়েছিলেন সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের চরিত্রে নানা সদগুণের সমাবেশ হয়েছিল কিন্তু তাঁর ধৈর্যের অভাব, অপরের চিন্তা ও ভাবনাকে শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি নিয়ে দেখা এবং ধীর ও স্থিরভাবে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করে কাজ করার ও পদক্ষেপ গ্রহণ করার মত দূরদৃষ্টি ছিল না। তাঁর নিজস্ব পরিকল্পনাগুলি কতদূর বাস্তবে রূপায়ন করা সম্ভব এসম্পর্কে তিনি চিন্তা করেন নি এবং কোন কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর তা সম্পূর্ণ করার জন্য সুলতান ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে শেখেননি। তিনি স্বল্পকালের মধ্যেই মানসিক ধৈর্য হারাতেন এবং ক্রোধে আত্মহারা হয়ে নির্দোষীকে পর্যন্ত কঠোর শাস্তিদান করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের অধিকাংশ পরিকল্পনা এইভাবে ব্যর্থ হয়েছিল।** মহম্মদ বিন তুঘলক সম্পর্কে ডঃ এ এল শ্রীবাস্তব মন্তব্য করেছেন যে- 'He lacked balance, practical judgement and common sense*** সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক সঠিকভাবে মানবচরিত্র বিচারে ব্যথ হয়েছিলেন এবং কল্পনাপ্রবণ ছিলেন। সুলতান তাঁর পরিকল্পনাগুলি অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে চালু করতে সচেষ্ট হন। দূরদৃষ্টির অভাবে তিনি বারংবার সাফল্য লাভে বঞ্চিত হয়েছিলেন।
সমকালীন লেখকরা ও শাসকগোষ্ঠী তাঁর উদারতা, পরধর্মসহিষ্ণুতা ও উলেমা এবং রক্ষণশীলদের প্রতি অবহেলার জন্য সুলতানের নিন্দায় পঞ্চমুখ ছিলেন। আর শেষোক্তদের মধ্যে যাঁরা ইতিবৃত্তকার ও ডঃ কে এম আশরফের ভাষায়, যাঁদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী (আহেল-এ-কলম) বলা হয় তাঁরা মহম্মদ বিন তুঘলককে তাঁদের লেখনীর মারফতে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। এইসব অভিযোগ ভিত্তিহীন নাহলেও অতিরঞ্জিত। সুলতানের দুর্ভাগ্য তাঁর রাজত্বকালে দুর্ভিক্ষ ও আর্থিক সমস্যা সাম্রাজ্যের সংকট ডেকে এনেছিল। সুলতানের পরিকল্পনাগুলির ব্যর্থতা এই সংকটকে গভীর করেছিল। প্রজাবিদ্রোহ এবং আমিরদের নিজ নিজ এলাকায় স্বাধীনতা ঘোষণার ফলে সাম্রাজ্যের ধ্বংসের বীজ উপ্ত করেছিল। ডঃ মাহেদী হোসেনের মতে দক্ষিণভারতে সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলে সাম্রাজ্যের সীমা সর্বাধিক বিস্তৃত হয়। কিন্তু সুলতানের অদূরদর্শিতার জন্য অধীন রাজ্যগুলি ও জনসাধারণের মধ্যে বিদ্রোহের প্রসার অত্যল্পকালের মধ্যে দিল্লীর কেন্দ্রীয় শাসনের অবসানের কারণ হয়েছিল। এই বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন কানহাইয়া নায়েক বা কৃষ্ণ নায়েক দক্ষিণের হোয়েসল রাজা তৃতীয় বীর বল্লালের উত্তরসূরীরা, রেড্ডীনেতা প্রলয়ভীমা প্রভৃতি। অবশেষে বিজয়নগরের প্রতিষ্ঠাতা সঙ্গমের পঞ্চম পুত্র, যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হরিহর ও বুক্ক, ১৩৩৬ সালে বিজয়নগর রাজ্যের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। ১৩৪৭ সালে দক্ষিণ-ভারতের আমিরন-ই-সদা বা বৈদেশিক আমিরগণ আলাউদ্দীন বাহমন শাহর নেতৃত্বে স্বাধীন বাহমনী রাজ্য স্থাপন করেন। ১৩৫১ সালে 'তাঘী' নামে এক বিদ্রোহীর অভ্যুত্থান দমন করার জন্য তার পশ্চাদ্ধাবন করার সময় সিন্ধুতে সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মৃত্যু মুখে পতিত হন।
সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের ধ্যানধারণার হদিস সমসাময়িক মানুষের নাগালের বাইরে ছিল। তাঁর বাস্তবজ্ঞানের অভাব ও পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়নের ব্যর্থতা সুলতানের পরিকল্পনা-গুলির রূপায়নের পথে অলংঘনীয় বাধার সৃষ্টি করেছিল। ধৈর্যের অভাব ও নিষ্ঠুরতা ও অসহিষ্ণুতার জন্য তিনি সময় বিশেষে অকারণে সামান্য অপরাধেও কঠোর শাস্তিদানে কুষ্ঠিত হতেন না। কিন্তু তুর্কী-আফগান শাসনের যুগে বহু সুলতান যাদের সম্পর্কে সমকালীন লেখকরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ যথা, সুলতান আলাউদ্দীন খলজী ও অন্যান্যরা, নিষ্ঠুরতার জন্য সর্বজনবিদিত ছিলেন। তাসত্বেও ইসেমী-প্রভৃতি ঐতিহাসিকরা তাঁদের প্রশংসা করতে পিছপা হননি। মহম্মদ বিন তুঘলকের ন্যায় জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তি সুলতানী আমলে দিল্লীর সিংহাসনে আরোহন করেননি। কিন্তু সমকালীন রাজনীতি ও সাম্রাজ্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর অজ্ঞতা, শাসকশ্রেণীর অন্তর্গত শক্তিশালী উলেমা ও আমিরদের অবহেলা, নিম্নকোটির লোকেদের প্রতি পৃষ্ঠাপোষকতা এবং অবাস্তব পরিকল্পনা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় তাঁর জীবনে দুর্যোগ ডেকে এনেছিল। ফলে সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। তাঁর উত্তরসূরী ফিরোজ তুঘলক গোঁড়া সুন্নী মুসলমান ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে ক্রীতদাসের সংখ্যা বৃদ্ধি, বংশানুক্রমিক ইকতার বহুল প্রচলন, দুর্নীতি ও স্বজন-পোষণের প্রসার এবং শাসনতান্ত্রিক দুর্বলতা ও সামরিক ব্যর্থতা সাম্রাজ্যের ধ্বংসের পথ সুপ্রশস্ত করেছিল। পরবর্তীকালের দুর্বল তুঘলক বংশীয় সুলতানদের গৃহযুদ্ধ, বৈদেশিক আক্রমণকারী তৈমুরের আক্রমণ ও লুণ্ঠনের ফলে তুঘলক সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল। মহম্মদ বিন তুঘলকের ব্যর্থতা সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের সূত্রপাত করেছিল।